পারিবারিক ধর্মকর্ম পালনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ। সন্তানের কর্মসাফল্যে গর্ব। গবেষণায় অগ্রগতি। ... বিশদ
একটা আবিষ্কার বদলে দিতে পারে গোটা বিশ্বকেই। আদিম যুগ থেকেই মানুষ মেতে রয়েছে আবিষ্কারের নেশায়। যুগে যুগে বিজ্ঞানীদের ক্ষুরধার মস্তিষ্ক, কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায় সাফল্য এনে দিয়েছে। মানুষের জীবন ধারণ সহজ করার লক্ষ্যেই অবিরাম গবেষণা করে গিয়েছেন। তবে, আকস্মিকভাবে বড়সড় বেশ কিছু আবিষ্কার মানব সভ্যতার গতিপথই বদলে দিয়েছে। এমন সব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পেছনে রয়েছে মজাদার ঘটনাও। এমনকী, সেই আবিষ্কারের ফল কতটা সুদূর প্রসারী হতে পারে, সেই সম্পর্কেও ছিল না কোনও ধারণা। এখন আমরা চিকিৎসাবিজ্ঞানে এমনই ভুল করে হওয়া তিনটি আবিষ্কার সম্পর্কে জেনে নেব।
এক্স রে
সময়টা ১৮৯৫ সাল। জার্মানির অধ্যাপক উইলহেম রন্টজেন গবেষণা করছিলেন বায়ুশূন্য টিউব নিয়ে। ক্যাথোড রশ্মি কাচের ভেতর দিয়ে ভেদ করতে পারে কি না, তাই-ই দেখার চেষ্টা করছিলেন তিনি। টিউব থেকে যেন আলো বেরিয়ে আসতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে তিনি টিউবের চারদিক কালো কার্ডবোর্ড দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন। টিউবটির মধ্যে দিয়ে বিদ্যুৎপ্রবাহ চালানোর সময় একটা জিনিস দেখে চমকে উঠলেন তিনি। দেয়ালে রাখা একটি ‘বেরিয়াম প্লাটিনো-সায়ানাইড’ পর্দায় অদ্ভুত কালো দাগ পড়েছে। এ রকম দাগ তো শুধু পর্দার ওপর আলো পড়লেই তৈরি হতে পারে। কিন্তু কালো কার্ডবোর্ড দিয়ে ঢাকা টিউব থেকে আলো বেরিয়ে আসার কোনও উপায় ছিল না। তাই এ আলো কোত্থেকে আসছে? সবকিছু ছেড়ে আলোর উৎস খুঁজতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। প্রচুর পরীক্ষার পর উইলহেম নিশ্চিত হলেন, বাইরের কোনও আলো নয়। টিউবের ভিতর থেকেই বেরিয়ে আসছে অদৃশ্য কোনও আলো। বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে যান অধ্যাপক। ডেকে আনেন স্ত্রী। পর্দার সামনে তাঁকে হাত মেলে ধরতে বললেন উইলহেম। তারপর দেখলেন দেওয়ালে যেন ভৌতিক হাতের ছবি ফুটে উঠেছে। ছবিতে হাতের মাংসগুলো স্বচ্ছ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু হাড়গুলি স্পষ্টভাবে চিত্রিত হয়ে উঠেছে। আর হাতের আঙুলের আংটির জায়গায় গাঢ় কালো রঙের ছায়া। তিনি বুঝতে পারেন এই অদ্ভুত আলোক রশ্মি অধিকাংশ বস্তুর মধ্যে দিয়েই ভেদ করে যেতে পারে। এই অদ্ভুত ক্ষমতার জন্য অজ্ঞাত রশ্মিটির নাম উইলহেম দিলেন ‘x-ray’ অর্থাৎ ‘অজানা রশ্মি’। আর এক্স রে-র নাম শোনেননি এমন লোক এখন মেলা ভার। যুগান্তকারী এই আবিষ্কার চিকিৎসা ব্যবস্থায় যুগান্তর এনে দেয়। চিকিৎসার ব্যাপারে যে পরীক্ষাগুলি করা হয়, সেগুলির মধ্যে বহুল প্রচলিত পরীক্ষা হল এক্স-রে।
ক্লোরোফর্ম
অনেক আগে যখন ক্লোরোফর্ম ছিল না, তখন অস্ত্রোপচার হতো রোগীদের অজ্ঞান না করেই। ফলে রোগীকে অমানুষিক যন্ত্রণা ভোগ করতে হতো অপারেশন থিয়েটারে। আর এই যন্ত্রণার অবসান ঘটে ক্লোরোফর্ম আবিষ্কারের পরে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, ক্লোরোফর্ম আবিষ্কারের ঘটনাটি দুর্ঘটনার চেয়ে কম কিছু নয়! উনিশ শতকের মাঝামাঝি নাগাদ অস্ত্রোপচারে ক্লোরোফর্মের ব্যবহার শুরু হয়। সেজন্য স্কটিশ চিকিৎসক জেমস ইয়াং সিম্পসনের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। অস্ত্রোপচারের সময় রোগীদের ওই দুঃসহ কষ্ট দেখে একটা কার্যকরী চেতনানাশকের খোঁজে গবেষণা শুরু করেছিলেন তিনি। ১৮৩১ সাল নাগাদ একদিন তাঁর এডিনবার্গের বাড়িতে বেশ কয়েক আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব এসেছিলেন। ততদিনে তাঁর গবেষণার কাজ অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে। তিনি যেটা আবিষ্কার করেছেন তা তাঁদের দেখাতে ব্যগ্র হয়ে ওঠেন সিম্পসন। যেমন কথা, তেমন কাজ। একটি শিশিতে করে ক্লোরোফর্ম অতিথিদের সামনে আনলেন। ছিপি খোলার পর আর কারও কিছু মনে ছিল না! হুঁশ ফিরল পরদিন সকালে। শুরুতে বিজ্ঞানী ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলেন। পরে সবার জ্ঞান ফিরলে আশ্বস্ত হন। অবশেষে ১৮৪৮ সালে এই আবিষ্কারের কথা তিনি জানান সবাইকে। এরপর থেকে বড় ধরনের অপারেশনে ক্লোরোফর্ম ব্যবহার করা হয়।
পেনিসিলিন
স্কটল্যান্ডের চিকিৎসক আলেকজান্ডার ফ্লেমিং পেনিসিলিন আবিষ্কার করেছিলেন আকস্মিক এক ঘটনাক্রমে। চিকিৎসক হলেও জীবাণুতত্ত্বের দিকেই তাঁর আগ্রহ ছিল সবচেয়ে বেশি। তাই জীবাণু সম্পর্কিত বিভিন্ন দিক নিয়ে তিনি সারাজীবন গবেষণা করে গিয়েছেন। ১৯২৮ সালে তিনি আবিষ্কার করেন বিশেষ এক ধরনের ছত্রাকে জীবনরক্ষাকারী পেনিসিলিনের অস্তিত্ব। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছুদিন আগে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন চিকিৎসক হিসেবে। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন আহত সৈনিকদের ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণে ভুগতে দেখে ব্যথিত হয়ে ওঠেন তিনি। অনুভব করলেন শক্তিশালী কোনও ব্যাকটেরিয়ানাশকের প্রয়োজনীয়তা। বিশ্বযুদ্ধ শেষে ইংল্যান্ডে ফিরে লন্ডনের সেন্ট মেরি মেডিক্যাল স্কুলে ব্যাকটেরিওলজির অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এরপর বেশ কয়েক বছর কেটে গেল। ১৯২৭ সালে ফ্লেমিং স্টেফাইলোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া নিয়ে কাজ শুরু করেন। ১৯২৮ সালের আগস্ট মাসে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতে কাজ করছিলেন। এরইমধ্যে হঠাৎ বাইরে ঘুরতে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে একটি ভুল করে গেলেন। তাঁর সেই ভুলই বিশ্বকে বদলে দিয়েছিল। ল্যাবরেটরিতে রেখে গিয়েছিলেন স্টেফাইলোকক্কাস ব্যাকটেরিয়ার প্লেট। কিন্তু ল্যাবরেটরির জানলাটা বন্ধ করতে ভুলে যান। দুই সপ্তাহ ছুটি কাটিয়ে ল্যাবরেটরিতে ঢুকেই অবাক ফ্লেমিং। ঝোড়ো বাতাসে এলোমেলো ল্যাবরেটরি। বাইরে দমকা হাওয়ায় ঢুকে পড়েছে ঘাস, পাতা। কিছু ঘাস এসে পড়েছে ব্যাকটেরিয়ার প্লেটেও। এরইমধ্যে ঘাসভর্তি একটি প্লেটে বেশ বড়সড় পরিবর্তন দেখে অবাক হয়ে গেলেন ফ্লেমিং। প্লেটের সব ব্যাকটেরিয়া খতম। কিন্তু কীভাবে মারা গেল? এই অনুসন্ধিৎসুই জন্ম দিল চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক মহান আবিষ্কারের। পরীক্ষা করে জানতে পারলেন, প্লেটের উপরে পড়া ঘাসের গায়ে একধরনের ছত্রাক আছে। পেনিসিলিয়াম নোটেটাম ছত্রাক। সেই ছত্রাকগুলো মেরে ফেলেছে জীবাণুগুলিকে। তাহলে কি পেয়ে গিয়েছেন এতদিনের সাধনার ফল? মিলেছে শক্তিশালী ব্যাকটেরিয়ানাশক? এব্যাপারে একটা ব্রিটিশ জার্নালে গবেষণাপত্র লিখলেন তিনি। ফ্লেমিং সর্বপ্রথম পেনিসিলিন আবিষ্কার করলেও একে মানবদেহে ব্যবহারের উপযোগী করে তোলেন হাওয়ার্ড ফ্লোরি ও আর্নস্ট চেইন নামে দু’জন বিজ্ঞানী। ১৯৩৮ সালে তাঁরা পেনিসিলিনের নিষ্কাশন ও বিশুদ্ধকরণের কাজ সম্পন্ন করেন।