পারিবারিক ধর্মকর্ম পালনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ। সন্তানের কর্মসাফল্যে গর্ব। গবেষণায় অগ্রগতি। ... বিশদ
নরেন্দ্র মোদি সেই স্লোগান পছন্দ করেন। বস্তুত তিনি রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায় ইন্দিরা গান্ধীর বিরোধিতা করেন ঠিকই। কিন্তু তাঁর একান্ত আফশোস হল, কেন তিনি ইন্দিরা গান্ধীর মতো হতে পারলেন না। ইন্দিরা গান্ধী যা যা করে গিয়েছেন, মোদি ঠিক সেগুলিই করতে পারলে প্রচণ্ড খুশি হতেন। যেমন ভারতে প্রথম পরমাণু বোমার পরীক্ষা। এমনকী আমেরিকার অজান্তে। পাকিস্তানকে দু টুকরো করে দেওয়া। বাংলাদেশ গঠনের মাধ্যমে। বিরোধীদের দলে দলে জেলে পাঠানো।
এর কোনওটাই মোদি এখনও পারেননি। তাই একটু ঘুরিয়ে ‘তিনিই ভারত’ এই প্রচারটিকে নিজের নামের সঙ্গে সংযুক্ত করার তাড়না তাঁর। কেন? কারণ, তিনি কিছুদিন শাসন করার পর বুঝে গিয়েছিলেন যে, তাঁর পক্ষে এই দেশের নানাবিধ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। তিনি যা কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার একটিও যে পালন করার মতো মুন্সিয়ানা তাঁর অথবা তাঁর টিমের নেই, অথবা সম্ভবই নয়। সেটা দ্রুত বুঝতে পেরে মোদি বিকল্প প্রচারের দিকটাই বেছে নিয়েছেন। দুটি ইস্যুকে তিনি বিজেপির একক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে অনেকটাই সমর্থ হয়েছেন। প্রথমত, হিন্দুত্ববাদ এবং দ্বিতীয়ত ভারতীয়ত্ব। একটি ধর্ম। অন্যটি রাষ্ট্রীয় আবেগ। এই দুইয়ের কম্বিনেশন আম জনতার বড় অংশকে যেসব সমস্যা থেকে চোখ সরিয়ে নিতে সাহায্য করে এটা বারংবার ইতিহাসই বলে দিয়েছে। অর্থাৎ জিনিপত্রের দাম বাড়ছে? হিন্দু খতরে মে হ্যায়। কর্মসংস্থান নেই? তাতে কী হয়েছে! ওই দেখুন ভারতকে অপমান করছে বিরোধীরা। প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা? সে তো দেশেরই সমালোচনা। সেই সমালোচনাকারী তাহলে নির্ঘাৎ অ্যান্টি ন্যাশনাল। এভাবে ধীরে ধীরে বিজেপি নিজেদের হিন্দুত্ব এবং জাতীয়তাবাদের স্বঘোষিত পাহারাদার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রবল চেষ্টা করেছে এবং এখনও করে চলে।
বিরোধীরা অবশ্য প্রশ্ন করে, ২০১৪ সালে মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে। ২০১৩ সাল পর্যন্ত হিন্দুরা সুরক্ষিত ছিল। আর হঠাৎ ২০১৪ সাল থেকে হিন্দুর বিপদ বাড়ছে কেন? এখন তো অনেক বেশি হিন্দুর সুরক্ষিত থাকার কথা। তবে এসব সমালোচনা অগ্রাহ্য করে যতই ইস্যু উত্থাপিত হোক, এই দুইটি বিষয় কিন্তু বিজেপিকে ঠিক নিয়ম করে এগিয়ে রেখেছে। এই ধারণা পাল্টানোর জন্য যে বিকল্প যুক্তি অথবা প্রবল প্রচার করে বিজেপিকে অস্বস্তিতে ফেলার দরকার ছিল, সেটি বিরোধীরা পারেনি। তাই বিজেপি নিশ্চিন্ত ছিল, যাই হয়ে যাক, আমাদের দুটি পাশুপত অস্ত্র তো আছেই। ওই দুটি ব্যবহার করলেই সবাইকে মোকাবিলা করা যাবে!
ঠিক এরকমই সময়ে আচমকা নরেন্দ্র মোদি দেখতে পাচ্ছেন যে, এবার তো অস্ত্র ছিনতাই হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি এসেছে! তাঁর এবং দলের অস্তিত্বপরিচয়ের প্রধান শব্দটিই হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে। শব্দটি হল ইন্ডিয়া। বিরোধীরা নিজেদের জোটের নাম রেখেছে ইন্ডিয়া। এই প্রথম ১০ বছরে বিজেপিকে টেক্কা দেওয়া অথবা আদর্শগতভাবে তাদেরকে পিছনে ফেলে দেওয়ার কোনও স্লোগান এনে বিরোধীরা সত্যিই বিজেপিকে বিপদে ফেলতে সক্ষম হয়েছে।
বিরোধীরাই এখন এই জোটের নাম সামনে এনে প্রচার শুরু করেছে। একদিকে ইন্ডিয়া অন্যদিকে এনডিএ। বিরোধীরা ভোটের ময়দানে প্রশ্ন করবে আম জনতাকে যে, তারা কোনদিকে? স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রীয় আবেগ এবং স্বদেশপ্রেমের এই আহ্বানে বিজেপির অতি বড় সমর্থক অথবা ভক্তও সরাসরি ইন্ডিয়া নামক জোটের নাম ধরে বিরোধিতা করতে পারছে না। এই প্রথম বিজেপি স্লোগান আর চমকপ্রদ প্রচারকৌশলে ব্যাকফুটে। জোটের নাম ইন্ডিয়া হলে বিজেপি মোদির হয়ে একথা আর বলতে পারবে না যে, ভোট ফর মোদি, ভোট ফর ইন্ডিয়া। কারণ ভোট ফর ইন্ডিয়া স্লোগানের অর্থ হতেই পারে যে, বিরোধী জোটকে ভোট দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। সুতরাং এতদিন বিজেপি যে জনপ্রিয় স্লোগান আর প্রচারের উদ্ভাবন করে এসেছে এবং বিরোধীরা দিশাহারা হয়ে ভেবেছে ওই প্রচার আর স্লোগানের পাল্টা কী স্লোগান দেওয়া যায়, হঠাৎ চিত্রটি সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে যাচ্ছে। এখন বিজেপিকে ভাবতে হবে যে, ইন্ডিয়া শব্দের বিরুদ্ধতা কীভাবে করা সম্ভব?
সুতরাং ২০২৪ সালের লোকসভা ভোট বিজেপির কাছে সবথেকে কঠিন হতে চলেছে। কারণ, এখন আর এই জোট কতটা শক্তিশালী, শেষ পর্যন্ত কতটা আসন সমঝোতা হবে, কারা শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবেন, কারাই বা হঠাৎ জোট ছেড়ে চলে যাবেন, এসব জল্পনাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে জোটের নাম। বিজেপি জোটের কাঠামো নিয়ে কটাক্ষ করেছে। ইন্ডিয়া জোটে যাদের শরিক হিসেবে দেখা যাচ্ছে, তারা রাজ্যস্তরে পরস্পরের বিরোধী। তাহলে কীভাবে জোট সরকার গঠন করা হবে? কীভাবেই বা জোটের শরিক পরস্পরবিরোধীরা থাকতে পারবে? স্বাধীনতার পর নির্বাচনগুলির ইতিহাসে দেখা গিয়েছে যে, শক্তিশালী শাসকের বিরুদ্ধে জোট আজ পর্যন্ত সমমনস্ক দলগুলির মধ্যেই হয়েছে এমন নয়। বরং উল্টোটা। পারস্পরিক আদর্শগত বিরোধিতা সত্ত্বেও জোট হয়েছে। ১৯৭৭ সালের জনতা দল, ১৯৮৯ সালের তৃতীয় ফ্রন্ট, ১৯৯৬ সালের যুক্তফ্রন্ট, ১৯৯৮ সালের এনডিএ অথবা ২০০৪ কিংবা ২০০৯ সালে ইউপিএ। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে পরস্পরের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা একই জোটে কেন্দ্রীয়ভাবে আছে। ইউপিএ সরকারকে সমর্থন করার জন্য মায়াবতী এবং মুলায়ম সিং দুজনেই উদগ্রীব হয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়েছিলেন চিঠি দিতে। সুতরাং জোটের কাঠামো নয়, জোটের নাম এবং প্রচার ২০২৪ সালে হতে চলেছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
কেন ইন্ডিয়া নামক জোটের নামকরণ নরেন্দ্র মোদিকে এতটা ভাবাচ্ছে? কারণ, এতকাল ইন্ডিয়া অথবা ভারত ছিল মোদি তথা বিজেপির একান্ত নিজস্ব স্লোগানের হাতিয়ার। মেক ইন ইন্ডিয়া। সক্ষম ভারত। ডিজিট্যাল ইন্ডিয়া। খেলো ইন্ডিয়া। স্বচ্ছ ভারত। এমনকী ট্রেনের নাম বন্দে ভারত। বিরোধীরা দূর থেকে বসে বসে দেখেছে এই মাস্টারস্ট্রোকগুলি। নামের মাহাত্ম্য। হঠাৎ মোদি দেখছেন তাঁর নিজের স্বদেশিয়ানার অস্ত্র প্রতিপক্ষের হাতে! যে ইন্ডিয়া শব্দটি ছিল তাঁর বল-ভরসা, সেই শব্দই এখন আচমকা প্রতিপক্ষ! এতদিন বিরোধীরা চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে মোদিকে। তারা সরাসরি বার্তা দিচ্ছে যে, একদিকে মোদি, আর অন্যদিকে আমরা ইন্ডিয়া। কে জিতবে? নিছক বিরোধী দল নয়। এই প্রথম মোদি একটি শব্দের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি! শব্দের নাম ইন্ডিয়া!