পারিবারিক ধর্মকর্ম পালনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ। সন্তানের কর্মসাফল্যে গর্ব। গবেষণায় অগ্রগতি। ... বিশদ
১৯৩৩ সালের ১৪ মার্চ। গঠিত হল ‘রাইখ মিনিস্ট্রি ফর পিপলস এনলাইটেনমেন্ট অ্যান্ড প্রোপাগান্ডা’। গোয়েবেলস অনেক দিন আগেই ব্রিটেন আর সোভিয়েতকে দেখে বুঝে ফেলেছিলেন চলচ্চিত্র একটি দেশে কী ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই চলচ্চিত্রকে হাতিয়ার করেই গোয়েবেলস শুরু করলেন প্রোপাগান্ডার জাল ছড়ানো। লক্ষ্য একটাই— হিটলারের প্রশংসা এবং জার্মানির একমাত্র শত্রু যে ইহুদিরা, সেটা জনগণের মনে গেঁথে দেওয়া। একের পর এক সিনেমা তৈরি হতে লাগল। জার্মান পরিচালক লেনি রিফেনস্টল বানালেন নাৎসি প্রচারমূলক সিনেমা ট্রায়াম্ফ অব দ্য উইল (১৯৩৫)। সেই ছবি দেখলে তো হিটলারকে একজন সর্বাধিনায়ক এবং পরিত্রাতা হিসেবেই মনে হবে! ভেইট হারলানের পরিচালনায় মুক্তি পায় জুড সুস (১৯৪০)। তবে সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন ফ্রিটজ হিপলার। তাঁর ‘দ্য ইটারনাল জিউ’-তে প্রচার করা হয়েছিল, ইহুদিরা কতটা অসভ্য ও পরজীবী প্রকৃতির। প্রত্যেকটি সিনেমা ছিল জার্মান শৈল্পিক চলচ্চিত্রের থেকে ভীষণ ভাবে আলাদা। এই সময় গোটা জার্মানি জুড়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল চলচ্চিত্র সমালোচনা। জার্মানির হয়ে যুদ্ধ করতে পারা কতটা সৌভাগ্যের বা ইহুদিরা কতটা ‘শয়তান’— এই ছিল সিনেমাগুলির একমাত্র বিষয়বস্তু। ইহুদিদের হত্যা করতে যাতে হাত না কাঁপে সেজন্য সেনাদের নিয়মিত দেখানো হতো এই ধরনের সিনেমা। একাধিক প্রোপাগান্ডা সিনেমা বানিয়ে গোয়েবেলস হিটলারের এমন এক প্রতিচ্ছবি বানাতে সক্ষম হয়েছিলেন, যা ছিল জার্মানির সাধারণ মানুষের কাছে অপরাজেয় ঈশ্বরসম। আসলে প্রোপাগান্ডার উৎস সবসময় ছোট ছোট মিথ্যের উপর ভিত্তি করে। তারপর এত বড় মিথ্যে বলা শুরু হয় যে, মানুষ বুঝতেই পারে না সেটি ডাহা অসত্য। এভাবেই যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন শাসক নিজের স্বার্থে প্রোপাগান্ডার ব্যবহার করে আসছে।
‘প্রোপাগান্ডা’ ছবি তৈরির জন্য ‘পৃষ্ঠপোষক’রা হাজির হন। কখনও সেখানে পরিচালক প্রচারের স্বার্থে মদতপুষ্ট ছবিটি তৈরি করতে রাজি হন। আবার কখনও ব্যক্তিগত দর্শনের কারণেও এই ধরনের ছবি তৈরি করে থাকেন। এই দুই ক্ষেত্রেই ছবিতে ‘সত্য’ তুলে ধরার প্রক্রিয়া ব্রাত্য হয়ে যায়। অথচ, শিল্পের কাজ মানবিকতার বিকাশ ঘটানো। সেখানে চলচ্চিত্রের মতো একটি শিল্পমাধ্যমকে নাৎসি ফ্যাসিবাদী সরকার তাদের অমানবিক কার্যকলাপকে আড়াল করার কাজে ব্যবহার করেছে। মিথ্যে আদর্শ প্রচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছে। ফ্যাসিবাদ বা নাৎসিবাদ এভাবেই শিল্পকে গ্রাস করে। গ্রাস করে শিল্পীর স্বাধীন সত্তা। সুযোগসন্ধানী শিল্পীরা তাঁদের কাছে বিক্রি হয়ে যায়। ফ্যাসিবাদ জাতীয়তাবাদের মুখোশ পরে মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তোলে। যেখানে জীবন বিপন্ন হয়, শিল্পীর স্বাধীনতা বিঘ্নিত হয়, সেখানে কোনও শিল্প সৃষ্টি হয় না। সৃষ্টি হয় ‘প্রোপাগান্ডা’!
ধরুন পরিচালক সুদীপ্ত সেনের ছবি ‘দ্য কেরল স্টোরি’র কথাই। যেসব ভারতীয় মহিলা জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটে নাম লেখাতে তাদের জন্মভূমি ছেড়ে সুদূর আফগানিস্তান, সিরিয়া বা পশ্চিম এশিয়ার অন্য কোনও দেশে পাড়ি দিয়েছে, তাদের নিয়েই এই সিনেমা। ছবিটির প্রথম ‘টিজার’-এ বলা হয়েছিল— ‘কেরলের ৩২০০০ মহিলার হৃদয়বিদারক কাহিনি’। মামলার ধাক্কায় পরে নির্মাতারা টিজার থেকে ৩২০০০ সংখ্যাটি সরিয়ে দেন। কিন্তু, এই ছবির পরতে পরতে লুকিয়ে আছে আরও নানা সন্দেহজনক পরিসংখ্যান। যেমন, ছবিতে বার বার দাবি করা হয়েছে যে, কেরলের ৩২ হাজার মহিলা ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে। একটি দৃশ্যে নিমা নামের চরিত্রটি এক পুলিস অফিসারকে বলে, ‘লাভ জেহাদের শিকার হয়ে নিখোঁজ, কেরলের এমন ৩০ হাজার মেয়ের সন্ধান আমরা পেয়েছি। আমাদের অনুমান, সংখ্যাটি ৫০ হাজারের কাছাকাছি।’ ৩০ হাজার? ৫০ হাজার? সরকারি তথ্য কি ছবির এই পরিসংখ্যানকে মান্যতা দেয়? প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, যেখানে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য অনুয়ায়ী কেরল থেকে ‘হারিয়ে যাওয়া’ মানুষের সংখ্যা যখন মেরেকেটে হাজারখানেক, সেখানে ত্রিশ বা পঞ্চাশ হাজার মহিলা জঙ্গি সংগঠনে যোগ দিয়েছে— এই সংখ্যাগুলি কোথা থেকে পেলেন ছবির নির্মাতারা? দেশের গোয়েন্দা ও গুপ্তচর সংস্থাগুলির চোখ এড়িয়ে এত মহিলার পক্ষে কি সীমান্ত পেরিয়ে ইসলামিক স্টেটে যোগ দেওয়া সম্ভব? সিনেমা মানে কি যা খুশি বলে দেওয়া যায়? এই কঠিন সময় সমস্ত রাস্তা শাসকের মগজধোলাই করা অবৈতনিক সিপাইদের দখলে। মগজ ধোলাইয়ের মন্ত্র এক দল মানুষের মাথার এতই গভীরে কাজ করছে যে, তাঁরা এসব বুঝতে অপারগ।
আসলে কাশ্মীর ফাইলস বা কেরল স্টোরি তৈরি হয়েছে হিন্দুত্ববাদী মতবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে। সংখ্যালঘু বিদ্বেষ ছড়িয়ে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের লক্ষ্যে। নির্দিষ্ট একটা ধর্মের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ঐতিহাসিক সমস্যাকে। প্রধানমন্ত্রী যখন কর্ণাটকের নির্বাচনের প্রচার চলাকালীন বলেন, ‘দ্য কেরল স্টোরি’ সকলের দেখা উচিত, যখন বেশ কিছু বিজেপি-শাসিত রাজ্যে এই সিনেমাটিকে কর-মুক্ত ঘোষণা করা হয়, তখন এই ছবিটি আর ‘শিল্পকর্ম’ থাকে না, হয়ে ওঠে প্রচারের হাতিয়ার। একইভাবে গুচ্ছ গুচ্ছ ছক-ষড়যন্ত্র করেও যখন কাশ্মীরকে হিন্দুত্বের কাছে মাথা নোয়ানো যাচ্ছিল না, তখন গোটা দেশে কাশ্মীরকে ঘৃণিত-নিন্দিত করতে হাতিয়ার করা হয়েছিল একপেশে এবং অর্ধসত্য তথ্যভিত্তিক সিনেমা— কাশ্মীর ফাইলসকে। কাশ্মীরের মতো কেরলও ‘প্রোপাগান্ডা’-র শিকার। গত কয়েক বছরে কেরল থেকে দু’-একটি মহিলার সন্ত্রাসবাদে যোগ দেওয়ার ঘটনাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে গল্প বানিয়ে এটা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা হয়েছে যে কেরল সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটি। তারা কেরলের মেয়েদের ফুসলিয়ে নিয়ে যায় এবং হয় বিদেশে চালান করে অথবা সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীতে ঢুকিয়ে দেয়। কিন্তু ঘটনা হল, খোদ প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর রাজ্য গুজরাত থেকে গত পাঁচ বছরে ৪১ হাজার মহিলা নিখোঁজ হয়েছেন। এই তথ্য সরকারেরই দেওয়া। পুলিস তাদের কোনও হদিশ দিতে পারেনি। তবে কি এরাও সন্ত্রাসবাদী হয়ে গিয়েছে?
সিনেমা নিয়ে এই জোরালো বিতর্কের মধ্যেই আপাত নিরীহ একটি প্রশ্ন সামনে চলে আসে। যে প্রযোজক-পরিচালকরা ‘কাশ্মীর ফাইলস’ বা ‘কেরল স্টোরি’র মতো সিনেমা তৈরি করেছেন তাঁরা কি তেমনভাবেই ‘গুজরাত স্টোরি’ নাম দিয়ে একটি সিনেমা বানাবেন? কাশ্মীর ফাইলস এবং কেরল স্টোরি প্রচারে খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেমন বাজারে নেমে পড়েছিলেন ঠিক তেমনই কি গুজরাত স্টোরির প্রচারে মাঠে নামবেন? সদ্য প্রচারিত বিবিসি’র তথ্যচিত্র নিয়ে তো রে রে করে তেড়ে এসেছিল গেরুয়াবাহিনী। অথচ গুজরাত গণহত্যা নিয়ে এই ছবি ঘোষিতভাবেই তথ্যচিত্র। মনগড়া কাহিনি চিত্র নয়। সত্য ও তথ্যের ভিত্তিতে দাঁড়িয়েই তথ্যচিত্র তৈরি হয়েছে। তাতে বিপদ বেড়েছে মোদিদের। তাই বিবিসিকে নাজেহাল ও সন্ত্রস্ত করতে নামানো হয়েছিল সরকারি সংস্থাকে।
অথচ, দুয়ারে ভোট থাকলেই এদেশে বাড়ে ‘প্রোপাগান্ডা’ ছবির সংখ্যা। বিনোদন সিনেমার মূল কথা হলেও এখন তার পিছনে জুড়ে গিয়েছে রাজনীতি। সিনেমার মাধ্যমে লোকশিক্ষার অজুহাতে এখন ভোট টানার তাগিদ। যে তাগিদ থেকেই জন্ম হয় ‘প্রোপাগান্ডা’ ছবির। ঠিক যেমন বীর সাভারকরের বায়োপিক। নির্মাতাদের ‘ভয়ঙ্কর’ দাবি, নেতাজি, ভগৎ সিং এবং ক্ষুদিরাম বসুর মতো স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন নাকি সাভারকর। সংস্কৃতি ও ইতিহাস থেকে মানুষ যত বেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, কোনও ঘটনায় কল্পিত একটি ভাষ্য নির্মাণ করা তত সহজ হয়। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনকে মাথায় রেখে বিজেপি এমন ছবি তৈরির ‘খেলা’য় মেতেছে। তৈরি হয়েছে ‘আজমের ৯২’। ১৯৯২ সালে আজমেরে এক গণধর্ষণকাণ্ডের উপর তৈরি হয়েছে এই ছবি। অভিযোগ, সিনেমা এবং সমাজমাধ্যমকে ব্যবহারের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে নিশানা করে তার সঙ্গে যাবতীয় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে জুড়ে দেওয়াই এসব সিনেমার কৌশল। এসব ছবি শাসক দলের স্বার্থসিদ্ধি করে, তাই তাকে জনদরবারে যথাসম্ভব পৌঁছে দিতে, এবং সম্ভব হলে তা নিয়ে উন্মাদনা তৈরি করতে তারা একান্ত উদ্গ্রীব। তা আর এখন নিছক শিল্প নয়— প্রচার। সেখানে পাথুরে প্রমাণের চেয়ে আবেগ ও ব্যক্তিগত বিশ্বাসের আবেদন শতগুণে অধিক।
গেরুয়া শিবির চায়, বেঁচে থাক শুধু বলিউডি জাতীয়তাবাদ, যেখানে সরকারের পালে লাগা বাতাসই সত্য-মিথ্যার নির্ণায়ক। এই সময়ের বলিউডের স্বরূপকে বুঝতে হলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে ফিরে যেতে হয়— ‘তখন হিংসেয় জ্বলছে শহর, মানুষের হাতের ছুরি গেঁথে যাচ্ছে/ মানুষেরই বুকে/ রাস্তায় বসে লাশের আগুনে পুড়িয়ে খাচ্ছে ধর্ম/ রক্তবমির মতন ওগরাচ্ছে দেশপ্রেম।’