পারিবারিক ধর্মকর্ম পালনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ। সন্তানের কর্মসাফল্যে গর্ব। গবেষণায় অগ্রগতি। ... বিশদ
নির্বাচনে একটিমাত্র প্রাণহানিও সমর্থনযোগ্য নয়। সমর্থনযোগ্য নয় বুথের বাইরে ব্যালট পেপার নিয়ে দৌড়াদৌড়ি। বোমা, গুলির বৃষ্টি। বিরোধী এজেন্টদের ভয় দেখিয়ে কাউন্টিং সেন্টার থেকে বের করে দেওয়াও সুস্থ গণতন্ত্রের বিজ্ঞাপন হতে পারে না। অর্থকরী এবং লাভজনক এই পঞ্চায়েত যজ্ঞে জিততে ব্যালট খেয়ে নেওয়াও এক নিষ্ঠুর প্রহসনই বটে। সেই কথা এজলাসে বসে বলেছেন স্বয়ং হাইকোর্টের মহামান্য বিচারপতিও। কিন্তু তাই বলে ৩৫৫ ধারা? কোন মুখে বলছেন বিরোধীরা? এ তো রাজ্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। দিল্লির সরকারের বিরুদ্ধে কিছু করলেই বলবেন ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’। জামিন অযোগ্য ধারা দিয়ে গারদে পুরে দেওয়া হবে। আর পূর্ব ভারতের এক অঙ্গরাজ্যের নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে সেই একই ষড়যন্ত্র রচিত হলে সাতখুন মাফ! বহাল তবিয়তে তিনি হাইকোর্টের রক্ষাকবচ নিয়ে ঘুরে বেড়াবেন। এই দ্বিচারিতার অর্থ কী?
আসলে খেলতে নেমেই গোল পোস্টটাকে নিজেদের দিকে টেনে নেওয়াটা এরাজ্যের বিরোধীদের পুরনো খেলা। বিগত একবছরেরও বেশি সময় ইডি আর সিবিআইয়ের কাঁধে বন্দুক রেখে নিজেদের প্রাসঙ্গিক করে তোলার চেষ্টা হল। কিন্তু তা বিন্দুমাত্র কাজে এল না। বুথওয়াড়ি সংগঠন গড়ে তোলার দিকে নজর না দিয়ে শুধু বিবৃতি আর মিডিয়া-সর্বস্ব নেতারা আবারও ব্যর্থতা ঢাকতে ফল বেরনোর দিন থেকেই তাই ৩৫৫ ধারা জারির ‘পরিবেশ তৈরি’তে মন দিয়েছেন। লজ্জার মাথা খেয়ে সে-কথা প্রকাশ্যে দাঁড়িয়ে বলছেনও। যাতে ওই ছদ্মবীরত্বের দোহাই দিয়ে আপাতত দীনদয়াল মার্গের চাকরিটা বেঁচে যায়! কারণ বিজেপি নেতৃত্ব ছুড়ে ফেলে দিলে আস্তাকুঁড়েও ঠাঁই পাওয়া মুশকিল হবে। রাজনীতিতে ব্যর্থ রাজাকে কেউ পোঁছে না! তার উপর তিনি যদি সুবিধাবাদী ‘দলবদলু’ বলে সমাজে চিহ্নিত হন, তাহলে তো কথাই নেই।
দু’দিন আগেই রাজ্যপাল দিল্লিতে গিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের হাতে বাংলার আইনশৃঙ্খলা নিয়ে রিপোর্ট তুলে দিয়েছেন। সেদিনই সন্ধ্যায় দেখা করেছেন রাষ্ট্রপতির সঙ্গেও। আমাদের বর্তমান রাজ্যপাল অত্যন্ত বিদ্বান, পণ্ডিত। তাই তিনি প্রায়ই যা বলেন, তার যেকোনও রকম অর্থ করা যায়। দিল্লিতে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছেন, ‘ভোরের আগে শেষ প্রহরেই সবচেয়ে অন্ধকার বিরাজ করে। তবে এবার ভালো হবে।’ দার্শনিক সেই ধাঁধার আসল অর্থ খুঁজে মরুক বাঙালি। তবে ওই ঘটনার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই বিরোধী নেতার মন্তব্য, রাজ্যে ৩৫৫ ধারা জারির পরিবেশ তিনি তৈরি করতে জানেন। নিঃসন্দেহে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ উক্তি। দু’য়ে দু’য়ে চার করলে একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের তত্ত্বই সামনে আসে, যা শুধু রাজনৈতিক পরিসরেই সীমাবদ্ধ নেই, বিস্তৃত দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দেও।
কিন্তু এখানেই প্রশ্ন, মণিপুরে কি ৩৫৫ কিংবা ৩৫৬ জারি হয়েছে? মে মাস থেকে ধরলে টানা ১০০ দিনেরও বেশিকাল ধরে ওই ছোট্ট রাজ্যে মেইতেই ও কুকিদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী জাতিদাঙ্গা চলছে। ইন্টারনেট পরিষেবা দীর্ঘসময় বন্ধ রাখা হয়েছে। রাহুল গান্ধীকে পর্যন্ত সড়কপথে শহরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। অথচ, বাংলায় দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে বিজেপির ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিম। কোনওরকম বাধা ছাড়াই উত্তেজক মন্তব্যও করছে। মণিপুরের জনসংখ্যা সব মিলিয়ে ৩০ থেকে ৩৫ লক্ষ। আমাদের অধিকাংশ জেলার জনসংখ্যার চেয়ে ঢের কম। অথচ এর মধ্যেই ওই রাজ্যে দশ হাজার সেনা নামিয়েও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়নি। ইতিমধ্যেই শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। অথচ এত ঝড় তোলার পরও অর্ধেকেরও কম মৃত্যু হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। ভুললে চলবে না, এই বাংলার জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে দশ কোটি। পঞ্চায়েত ভোটে অংশ নিয়েছেন প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষ।
প্রথমেই বলেছি, আমরা হানাহানির রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে সমর্থন করি না। সিদ্ধার্থবাবুর সময় থেকে বাম আমল পেরিয়ে সেই উত্তরাধিকার কোনওভাবেই বয়ে চলা উচিত নয়। একইসঙ্গে এই প্রশ্নও সমান প্রাসঙ্গিক, যে উত্তরবঙ্গকে বিজেপি নিজেদের ‘গড়’ ভাবতে শুরু করেছিল, সেখানেই মোদির পার্টির এমন ভরাডুবি হল কেন? কেন রাজবংশীরা, আলিপুরদুয়ারের চা বাগানের শ্রমিকরা, সাধারণ গরিব মানুষ এভাবে পদ্ম শিবির থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন? বঙ্গভঙ্গ চান না বলে? কোচবিহারেও বড় বিপর্যয় হয়েছে। কিন্তু দিনহাটা ছাড়া তেমন গণ্ডগোলের খবর তো নেই। বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের নিজের জেলায় গ্রাম পঞ্চায়েতে তাঁর দল প্রায় নিশ্চিহ্ন! দিলীপ, লকেট, নিশীথের কেন্দ্রের অবস্থাও শোচনীয়। শুধু সন্ত্রাসের কথা বলে এই ব্যর্থতা ঢেকে দেওয়া যাবে? বোধহয় না, তাই বার বার ৩৫৫ ধারার জুজু দেখানো শুরু করেছে পদ্মফুল শিবির। পার্টির সঙ্গে সম্পর্কহীন তথাকথিত এক ‘মহারাজ’কে রাজ্যসভায় মনোনয়ন দিয়ে রাজবংশী ভোটব্যাঙ্ক ফেরানোর খোয়াব দেখা শুরু হয়েছে। সেই বেলুন চুপসে যেতেও সময় লাগবে না। মহারাজের নানা অতীত কীর্তি নিয়ে ইতিমধ্যেই রাজবংশী সমাজ কিন্তু ভিতরে ভিতরে উত্তাল।
উত্তরবঙ্গে যখন এই অবস্থা, তখন দক্ষিণবঙ্গও কিন্তু বিরোধীদের খুব আশার কথা শোনায়নি। জঙ্গলমহল সম্পূর্ণ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আদিবাসী ও কুড়মিরা এবার আর গেরুয়া প্রার্থীদের ভোট দেননি। প্রত্যাখ্যান করেছেন মতুয়ারাও। আবার খুব সামান্য হলেও গেরুয়া শিবিরের কিছু ভোট চালান হয়ে গিয়েছে বামেদের দিকে। কিন্তু বঙ্গ বিজেপির প্রতি এরাজ্যের ভোটারদের এত অনীহা কেন? উত্তরটা কিন্তু সহজ। একই মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বার বার ভোট কেনা যায় না। এনআরসি আর সিএএ’র খুড়োর কল ঝুলিয়ে আর কতদিন রাজনীতি করবেন? ‘ঠাকুরবাড়ি’র মানুষ তা সহ্য করবে তো? আর ‘অসাম্প্রদায়িক’ সিপিএম এবার স্বপ্ন দেখেছিল তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। তা করতে আলিমুদ্দিনের কর্তারা আগুন নিয়ে খেলতেও পিছপা হননি। কিন্তু সেই অঙ্কও মেলেনি। বরং বামেদের উস্কানির জেরে বহু সংখ্যালঘু মানুষের প্রাণ গিয়েছে। এই সহজ সরল সত্যটা কি স্বীকার করার সৎ সাহস আছে আলিমুদ্দিনের?
বলা বাহুল্য, এবার ভোট হয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রায় ৮০ হাজার জওয়ানের তত্ত্বাবধানে। একটা পঞ্চায়েত ভোটের ক্ষেত্রে এই জিনিস অভূতপূর্ব। অন্যদিকে, মণিপুরের আইনশৃঙ্খলা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়া সত্ত্বেও সেখানে মোতায়েন হয়েছে মাত্র দশ হাজার! সেখানে ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকার রয়েছে বলেই ইম্ফল থেকে দিল্লি—কারও মুখে ৩৫৫ কিংবা ৩৫৬-র কথা শোনা যাচ্ছে না। যত আক্রোশ এই বাংলাকে ঘিরে। কিন্তু তা করলে আবারও মস্ত বড় ভুল করবে মোদি-শাহদের সরকার। অনর্থক ভয় দেখালে, নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গর্জন করতে ছাড়বেন না। কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ‘অগ্নিকন্যা’ যখন উত্তর থেকে দক্ষিণ—একটার পর একটা জেলায় যাবেন, তখন তা সামাল দেওয়ার ক্ষমতা ও হিম্মত এরাজ্যের কোনও বিরোধী নেতার হবে তো! আসন্ন লোকসভা ভোটে যে দু-একটি আসন জেতার সম্ভাবনা বিরোধীদের আছে, তার অবস্থাও নিমেষে বদলে যাবে। বাংলার মানুষ কোনও অবস্থাতেই অবাঞ্ছিত কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ মেনে নেবে না। তাই নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচাতে যে কতিপয় বিরোধী নেতা ৩৫৫ ধারা জারির দুঃস্বপ্ন দেখছেন, অবিলম্বে তা ত্যাগ করুন। অন্যথায়, আপনাদের কপালে নাচার জন্য আরও বড় শনি অপেক্ষা করছে। কে না জানে, আঘাত করলে মমতা কতটা ভয়ঙ্কর! বিজেপি, সিপিএম ও কংগ্রেস হাজার জোট করেও তখন তাঁর সামনে খড়কুটোর মতো উড়ে যাবে।