পারিবারিক ধর্মকর্ম পালনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ। সন্তানের কর্মসাফল্যে গর্ব। গবেষণায় অগ্রগতি। ... বিশদ
গ্রামের উন্নয়নের চাবিকাঠিটি পঞ্চায়েতের হাতে থাকলে অশান্তি, মারামারি, খুনোখুনি এড়ানো কার্যত অসম্ভব। বছরে পঞ্চায়েত প্রতি দু’ থেকে পাঁচ কোটি টাকা খরচ হয়। এই নির্বাচনে নীতি, আদর্শ, মূল্যবোধ সবই গৌণ। একমাত্র লক্ষ্য, ক্ষমতা দখল। বোর্ড গঠন করতে পারলেই খুলে যায় কামাইয়ের রাস্তা। একেবারে ইনকাম ট্যাক্স ফ্রি রোজগার। তাই পথের ‘কাঁটা’ সরাতে খুন করতেও হাত কাঁপে না! সেটা বাম জমানাই হোক বা তৃণমূলের রাজত্বেই হোক। সরকার বদলালেও ট্র্যাডিশন বদলায়নি।
অতীতের পরিসংখ্যান টেনে কোনও খুনকে লঘু করে দেখানোটা অন্যায়। ঠিক একইভাবে অনুচিত হবে খুনোখুনি ও অশান্তির দায় কেবল একটি দলের উপর চাপিয়ে দেওয়া। তাই স্বাভাবিক প্রশ্নটি হল, এবারের পঞ্চায়েত ভোটে মারামারি, খুনোখুনির দায় কার?
রাজ্যে শান্তি বজায় রাখার মূল দায়িত্ব অবশ্যই শাসক দলের। সেটা প্রযোজ্য পঞ্চায়েত নির্বাচনের ক্ষেত্রেও। কারণ তাদের হাতেই রয়েছে পুলিস ও প্রশাসন। কোথাও অশান্তি হলে আগে আঙুল ওঠে শাসকের বিরুদ্ধেই। এক্ষেত্রেও তৃণমূল কংগ্রেসকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে। কিন্তু তালি তো এক হাতে বাজে না। তাই দায় এড়াতে পারে না বিরোধীরাও। বরং একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, এবারের নির্বাচনের অশান্তি ছিল অনেকটাই পরিকল্পিত।
একুশের নির্বাচন থেকে যত ভোট হয়েছে সবেতেই এরাজ্যের বিরোধীরা নাস্তানাবুদ হয়েছে। ব্যতিক্রম সাগরদিঘি। পঞ্চায়েত ভোটেও শাসক দলের আধিপত্য নিয়ে কারও কোনও সংশয় ছিল না। বিরোধীদেরও নয়। কিন্তু লোকসভা ভোটের আগে তাদের কঙ্কালসার চেহারাটা দেখাতে চাইছিল না। তাই নানাভাবে নির্বাচন বন্ধ করতে উঠেপড়ে লেগেছিল। কিন্তু বন্ধ করতে না পেরেই নিয়েছিল ঘেঁটে দেওয়ার কৌশল।
প্রশ্নটা হল, নির্বাচন সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ হলেও কি ফলের খুব একটা হেরফের হতো? পঞ্চায়েতের পুনর্নির্বাচনের ফলের দিকে তাকালেই মিলবে এর উত্তর। কারণ পুনর্নির্বাচন হয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনীর কড়া নিরাপত্তায়। বিরোধীদের অভিযোগের ভিত্তিতে বীরভূম জেলায় ১৪টি বুথে পুনর্নির্বাচন হয়। তারমধ্যে ১০টি পেয়েছে তৃণমূল। এমনকী, কয়েকটি বুথে তৃণমূল জিতেছে ৩০০ থেকে ৭০০ ভোটে।
পূর্ব মেদিনীপুরে ৩১টি বুথে পুনর্নির্বাচন হয়েছে। তারমধ্যে তৃণমূল ১৮টিতে এবং ১৩টিতে জিতেছে বিজেপি। এই ১৩টি বুথই ময়নার বাকচায়। সেখানে বিজেপির আধিপত্য সীমাহীন। এই পঞ্চায়েতের ২৮টির মধ্যে ২৫টি আসনই পেয়েছে বিজেপি। বাঁকুড়া জেলায় ৮টি বুথে পুনর্নির্বাচন হয়েছিল। ৬টিতে জয়ী হয়েছে তৃণমূল।
আরামবাগ মহকুমায় ২৮টি আসনে পুনর্নির্বাচন হয়। তারমধ্যে খানাকুল-২ ব্লকেই ১৪টিতে। সেখানে বিজেপি ১১টি, তৃণমূল ২টি ও নির্দল একটিতে জিতেছে। এই খানাকুল-২ ব্লকের পঞ্চায়েত সমিতি দখল করেছে বিজেপি। এমনকী ১১টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ৭টি গিয়েছে বিজেপির দখলে। আর সেটা হয়েছে ৮জুন হওয়া ভোটের ভিত্তিতেই।
এই সমস্ত পরিসংখ্যান কী প্রমাণ করছে? যেখানে যে শক্তিশালী সেখানে সেই দলই জয়ী হয়েছে। কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিরাপত্তায় হওয়া পুনর্নির্বাচনের সঙ্গে ৮ জুনের ভোটের ফারাক প্রায় কিছুই নেই। থাকার কথাও নয়। সেটা বিরোধী দলের নেতারাও জানেন। তা সত্ত্বেও তাঁরা গলার শিরা ফুলিয়ে সন্ত্রাস, সন্ত্রাস বলে চিৎকার করছেন। কারণ কর্মীদের বোঝাতে হবে, এটা জনগণের রায় নয়। আর সেটা বোঝাতে না পারলে কর্মীরা হতাশ হয়ে যাবে। তাহলে লোকসভা ভোটে কর্মীদের মাঠে নামাতে পারবে না।
সাগরদিঘি উপনির্বাচনের জোট প্রার্থী জেতার পর বিরোধীরা একযোগে প্রচার করেছিল, সংখ্যালঘু
ভোট মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে সরে গিয়েছে। তার আগে আনিস খানের রহস্যমৃত্যুকে ঘিরে উত্তাল হয়েছিল রাজ্য রাজনীতি। আনিসের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুকে বিরোধীরা রাজনীতির উপাদান বানানোর
চেষ্টা করেছিল। বিশেষ করে সিপিএম। সংখ্যালঘু ভোটে থাবা বসানোর আশায় বামেরা আনিসের দাদাকে প্রার্থীও করেছিল। কিন্তু সিপিএমের
অভিপ্রায় পূরণ হয়নি। কারণ আনিসের দাদা হেরেছেন। জিতলে হয়তো আনিসের দাদাই হয়ে যেতেন সিপিএমের সংখ্যালঘু মুখ।
বিরোধীদের এখন একটা সংখ্যালঘু মুখের বড়ই প্রয়োজন। যাঁর কথায় সংখ্যালঘুরা তৃণমূল
ছেড়ে হুড়মুড়িয়ে তাদের দিকে চলে যাবে। তাই বিরোধীরা ‘যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই/ পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন’ নীতি নিয়ে নেতা খুঁজে বেড়াচ্ছে।
বগটুইয়ে স্বজনহারা মিহিলাল শেখকে ‘মুখ’ করতে চেয়েছিল বিজেপি। তাঁকে বিজেপিতে যোগদান করিয়ে রাজ্যবাসীকে চমক দিয়েছিল গেরুয়া শিবির। শুধু যোগদান করায়নি, স্বজনহারাদের দু’জনকে প্রার্থী পর্যন্ত করেছিল। মিহিলাল বুক বাজিয়ে বলেছিলেন, বগটুইয়ে জিতবে বিজেপিই। আর তৃণমূল হবে থার্ড। কিন্তু বগটুইয়ের মানুষ জানিয়ে দিয়েছে, স্বজনহারাদের জন্য তাদের সহানুভূতি আছে, কিন্তু ভোট নেই। মিহিলালের বুথে বিজেপি প্রার্থী হয়েছিলেন তাঁরই দিদি। তিনি ভোট পেয়েছেন ৩১টি, তৃণমূল পেয়েছে ৫০৫টি।
পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলকে হারানোর জন্য বিরোধীরা ‘সাগরদিঘি মডেল’কে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলেন। সাগরদিঘি মডেল মানে ‘রামধনু জোট’। বহু জায়গায় সেই জোট হয়েছে এবং সাফল্যও পেয়েছে। কিন্তু ‘সাগরদিঘি মডেল’ মুখ থুবড়ে পড়েছে সাগরদিঘিতেই। এই ব্লকে গ্রাম পঞ্চায়েতের সংখ্যা ১১টি। তারমধ্যে ১০টিতে তৃণমূলকে জিতিয়ে এলাকার মানুষ বুঝিয়ে দিয়েছে, সাগরদিঘির আস্থা মমতাতেই।
গত বিধানসভা নির্বাচনে পুরুলিয়ার বলরামপুর বাদে জঙ্গলমহলের সব আসন পেয়েছিল তৃণমূল। তাই এবার জঙ্গলমহলে থাবা বসানোর জন্য কুড়মিদের সামনে রেখে সাজানো হয়েছিল নতুন গেমপ্ল্যান। ‘আদিবাসী কার্ড’ খেলে কুড়মিদের পাশে টানার চেষ্টা করেছিল বিরোধীরা। সেই কাজে কিছুটা সফলও হয়েছিল। কুড়মিদের একটা অংশ সরাসরি তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট না দেওয়ার ডাক দিয়েছিল। বহু জনপ্রতিনিধি ও নেতাকে দল ছাড়তে বাধ্য করেছিল। তবে, ভোটের ফলে প্রমাণ হয়েছে, সেই ডাকে সাড়া দেয়নি কুড়মিদের একটা বড় অংশ। তাঁরা সামাজিক সংগঠনের নেতাদের নির্দেশের চেয়ে জীবনজীবিকাকেই গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি।
পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার প্রভৃতি জেলায় ভোটে তেমন কোনও অশান্তির খবর ছিল না। বিরোধীরা অভিযোগও করেনি। এই সমস্ত এলাকার অধিকাংশ বিধায়ক এবং সাংসদ বিজেপির। তা সত্ত্বেও প্রতিটি জেলাতেই শাসক দল বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছে।
বিরোধীদের চিৎকার থামিয়ে দিতে পারে দিলীপ ঘোষের একটা ইন্টারভিউ। তখন তিনি বঙ্গ বিজেপির মুখ। দলের রাজ্য সভাপতি। দিলীপবাবু বলেছিলেন, ‘যে মানুষের সঙ্গে থাকবে, মানুষের কথা বলবে সে রাজনীতিতে থাকবে। অনেকে অনেক কিছু করেছেন। তাঁরা হারিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আছেন। মানুষ তাঁকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটাই রাজনীতি। সাময়িক অস্বস্তি হতে পারে, অশান্তি হতে পারে। মনান্তরও হতে পারে। কিন্তু দিনের শেষে এটাই শেষ কথা যেটা পাবলিক বলবে।’
পঞ্চায়েত ভোটের পর তাঁর এই কথাগুলো ফের ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। কুৎসা, অপপ্রচারে মানুষ হয়তো সাময়িক প্রভাবিত হয়। কিন্তু ভোট দেওয়ার আগে অভিজ্ঞতার আতস কাচে ভালো-মন্দ যাচাই করে নেয়। তাতেই বুঝে যায়, কে জিতলে তাদের লাভ। তার ভিত্তিতেই নেয় সিদ্ধান্ত। সেই কারণেই বাজারে, পথেঘাটে, সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনার সঙ্গে ভোটের ফলাফলের কোনও মিল পাওয়া যায় না। শেষ কথা বলে জনগণই। দিলীপবাবুর ভাষায়, ‘পাবলিক’।