পারিবারিক ধর্মকর্ম পালনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ। সন্তানের কর্মসাফল্যে গর্ব। গবেষণায় অগ্রগতি। ... বিশদ
পঞ্চায়েত নির্বাচনে কেন এত মৃত্যু? কেন এত রক্তপাত? এই কি প্রথম রাজ্যে এমন ঘটনা ঘটল? না, বারবার এই রাজ্যে যেকোনও নির্বাচনকে ঘিরেই মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। আজকের কচি সিপিএম নেতাদের দাদু, জেঠুরা রাজ্যে এই সংস্কৃতি শুরু করে গিয়েছিলেন। অতীতের নির্বাচনী ইতিহাস ঘাঁটার চেষ্টা করলেই তা নজরে আসবে। দুর্ভাগ্য এই যে, ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে পরিবর্তন এলেও সবক্ষেত্রে পরিবর্তন সাধিত হল না। ভোটসংস্কৃতির এই অধঃপতন আমরা এখনও রুখতে পারিনি।
সিপিএমের এখন সব লড়াই সোশ্যাল মিডিয়ায়। সেইসব লেখা পড়লে মনে হবে গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি কিংবা জেলা পরিষদ সব তারা দখল করে নিতে চলেছে। কিংবা তারা দখল করে ফেলেছিল, শুধু তৃণমূলের সন্ত্রাস আর ছাপ্পার জন্য পারল না। লড়াইয়ের ময়দানে জনসমর্থন না পেয়ে সেই গোয়েবলসের থিয়োরি এখনও তারা আউড়ে চলেছে। দশচক্রে যেমন ভগবান ভূত হয়, তেমনই ভূতকেও লোকে ভগবান বলে ভাবতে শুরু করে। সত্যি কথা বলতে কী, এখনও পঞ্চায়েতের ত্রিস্তরের সমস্ত আসনে সিপিএম, বিজেপি কিংবা কংগ্রেসের প্রার্থী দেওয়ার ক্ষমতা নেই। সেই দুর্বলতা ঢাকতে তারা শাসানির অভিযোগ তুলছে। শাসানি হয়নি, তা নয়। ভালো রকমই হয়েছে। কিন্তু তার জন্য এত আসনে বিরোধীরা প্রার্থী দিতে পারেনি, সেটা ঠিক নয়। আসলে সব রাজ্যেই যারা ক্ষমতায় থাকে, তারাই মূলত পঞ্চায়েতের বেশিরভাগ আসনের দখল নেয়। সর্বত্র দেখা যায় ৪০-৫০ শতাংশ আসনে রাজ্যের শাসক দল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যায়। এটাই স্বাভাবিক রাজনীতি। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে ত্রিপুরায় বিজেপি ৮০ শতাংশের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছিল। সেটা তাহলে গণতন্ত্র ছিল? গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ কিংবা হরিয়ানাতেও শাসক দল বিভিন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে বহু আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করে। সিপিএম আমলেও এই রাজ্যে এমনটাই হতো। কংগ্রেসকে ভোট দেওয়ার জন্য সিপিএমের হার্মাদরা ভোটারের হাত কেটে নিয়েছিল, কিংবা বন্ধ ঘরে আগুন জ্বালিয়ে মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছিল, সিপিএমের নবীন প্রজন্মরা এসব জানেই না! সাঁইবাড়ি, মরিচঝাঁপির ঘটনা ভুলে গিয়েছে কচি সিপিএমরা। তাদের ভরসা ফেক নিউজ।
এবারের নির্বাচনে আগামী ২৪-এর লোকসভা ভোটের একটা মহড়া হয়ে গেল বলা যায়। না, সেটা সন্ত্রাসের নয়, জনমতের। এবারের নির্বাচনকে ঘিরে যেভাবে সন্ত্রাস আর ছাপ্পার অভিযোগ তুলেছে বিরোধীরা, সার্বিক প্রতিফলন বোধহয় তেমনটা নয়, ১০-১৫ শতাংশ আসনে অবশ্যই গোলমাল হয়েছে, মারধর, ছাপ্পা হয়েছে। সব থেকে বড় কথা প্রাণ গিয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তা অত্যন্ত নিন্দনীয় ঘটনা। শুধু শাসক দল নয়, এই অনভিপ্রেত খেলায় মেতে উঠেছে বাংলার সব দলই। অভিযোগ, দিল্লির কলকাঠিতে আসরে নেমে পড়েছেন রাজ্যপালও। আমরা দেখেছি, যে যেখানে শক্তিশালী, সেখানে তারই অস্ত্রের ঝনঝনি বেশি। এবারের মৃত্যুর ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তৃণমূল কর্মীই বেশি খুন হয়েছেন। বিরোধীরা বলছে, তাদের কর্মীদের তৃণমূল খুন করেছে, আর তৃণমূল কর্মীদের খুন নিয়ে তাদের যুক্তি, ওগুলো জনরোষ। ভাঙড়ে কাদের হাতে অস্ত্র বেশি, কারা ভোটের দিন দাপিয়ে ছাপ্পা, সন্ত্রাস করেছে, সেটা সবাই জানে। ভোটের দিন কার্যত সেখানে তৃণমূল ঢুকতেই পারেনি। তারই পাল্টা লড়াই হয়েছে। ব্যাপারটা একতরফা হয়নি। কিন্তু যা হয়েছে, সেটা মোটেই কাম্য নয়।
এরপরেও রয়েছে এই নির্বাচনের একটি রাজনৈতিক দিক। সেই দিকের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, আগামী নির্বাচনে বিজেপির আসল লড়াই সিপিএমের সঙ্গে। কেন? এর আগের নির্বাচনগুলিতে মূলত লড়াই ছিল তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির। কিন্তু এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচন বুঝিয়ে দিল, বাম থেকে উজানে যেসব ভোট রামে ঢুকেছিল, সেই ভোট আবার ভাটার টানে ফিরে আসছে বামে। আসলে এখানে বিজেপির নিজস্ব ভোটব্যাঙ্ক বলে কিছু নেই। সিপিএমের আচরণে ক্ষুব্ধ বামেরা একদিন বিজেপির বাক্সে ভোট ঢালত। সেই ভোট ফিরে আসায় একদিকে যেমন বাম শিবির চাঙ্গা ও উল্লসিত, উল্টোদিকে চাপে পদ্মশিবিরও। যদিও বিজেপি দ্বিতীয় স্থানে আছে, তবে তারা স্বস্তিতে নেই। কেননা সিপিএম তাড়া করেছে বিজেপিকে। যে দূরত্ব ছিল, পঞ্চায়েত ভোটে সিপিএম-কং জোট তা কমিয়ে ফেলেছে। আগামী ২৪-এর ভোটে আরও কিছু ভোট বামে ফিরবে। সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থান দখলের লড়াই হবে সিপিএম-কং জোট বনাম বিজেপির। যত এই লড়াই গভীর হবে, তৃণমূলের পথ ততই নিষ্কণ্টক হবে। ড্যাং ড্যাং করে তাদের জেতার পথ পরিষ্কার হয়ে যাবে।
বিজেপি থিঙ্কট্যাঙ্কদের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার। তাঁরাও কৌশল নির্ধারণের চেষ্টা করছেন। আপাতত তাঁরা বুঝেছেন, বঙ্গের এই শূন্যগর্ভ আওয়াজ সর্বস্ব নেতাদের পিছনে ঘোড়ার বাজি রেখে ম্যাচ জেতা যাবে না। এই ফল দেখে আড়ালে হাসছেন বিজেপির পুরনো নিষ্ক্রিয় বন্ধুরা, যাঁদের সামনের সারি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাই এই মুহূর্তে রাজ্য বিজেপিতে বড় রদবদলের চেষ্টা চলছে। এই ফলের পরে ডানা ছাঁটা হতে পারে বঙ্গ বিজেপির আসর গরম করা কয়েকজন অতিসক্রিয় নেতার। হারানো জমি পেতে পুরনো নেতৃত্বের দিকে হাত বাড়াতে পারেন শীর্ষ নেতারা। কেননা বোঝা গেছে, টিভিতে বাহাদুরি দেখানো এইসব নেতা আসলে অশ্বডিম্ব, এদের জনভিত্তি কম। সেটা বুঝেই দম হারানো কিছু পান্ডা লোকসভার টিকিটের সন্ধান করে সটকে পড়তে চাইছেন। তবে রাজ্যে বিজেপির এই ফলের দায় মোদি, অমিত শাহকেও নিতে হবে।
মোদি, অমিত শাহ বাংলাকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে যে রাজনীতি করেছেন, যেভাবে বাংলাকে ভাতে মারার চেষ্টা করেছেন, ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে হেরে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার বাংলার সঙ্গে যেভাবে প্রতিহিংসার রাজনীতি করেছে, এই ভোট তার বিরুদ্ধে প্রথম জবাব। বিজেপি কী ভেবেছে, টাকা আটকে রাজ্যকে জব্দ করবে? দুর্নীতির অভিযোগে একশো দিনের কাজ, আবাসন প্রকল্পের টাকা আটকে দেবে, আর মানুষ গদগদ হয়ে হনুমান চালিশা পড়তে পড়তে পদ্মফুলে ছাপ মারবে? শুধু এবার নয়, এরাজ্যে যতবার ভোট হবে, ততবার বিজেপির বিরুদ্ধে রাজ্যের পঞ্চাশ শতাংশের বেশি মানুষ রায় দেবেন। এটাও বিজেপি নেতারা জানেন। তাই তাঁরা আরও বাঙালি-বিরোধী খেলার পথে পা বাড়ালেন।
ফল বেরনোর পরই বিজেপি রাজ্যসভার প্রার্থী হিসাবে অনন্ত মহারাজের নাম ঘোষণা করে পরোক্ষে যেন বাঙালিকে বলতে চাইল, দেখ কেমন লাগে! অর্থাৎ উস্কানি দিয়ে বাংলা ভাগের পক্ষে নেমেছে তারা। বিচ্ছিন্নতার চাষ করা ছাড়া বিজেপি যে আর কোনও রাজনীতি করে না, তা ফের প্রমাণিত হল। অথচ এই পঞ্চায়েতে উত্তরবঙ্গের মানুষ তৃণমূলকে ভোট
দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, তারা বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে।
শুধু বাংলা ভাগই নয়, এই ভোটে অনেকগুলো প্রশ্নে বাংলা বিজেপিকে ‘না’ বলে দিল। তার মধ্যে আছে রাজ্যভাগ, শিক্ষায় গৈরিকীকরণ, জাতপাতের বিভেদ, সংখ্যালঘু পীড়ন ইত্যাদি। পঞ্চায়েতে বিজেপির ভোট কমার প্রথম কারণ হল মানুষের মধ্যে মোদি-বিরোধী আবেগ তৈরি হয়েছে। বাংলা আজ বলছে, ‘নো ভোট টু বিজেপি’। বাংলার মানুষের ক্ষতি করার রাজনীতি করছে বিজেপি। আজ গেরুয়া নেতারা বুঝতে পারছেন না, আগামী দিনে তাঁদের সাধের অনন্ত মহারাজ কতখানি গলার কাঁটা হয়ে উঠতে পারেন।
পঞ্চায়েত স্তরের ভোট হলেও ওরই মাঝে লুকিয়ে আছে ‘কালপুরুষের সুগভীর পরামর্শ’। এই ভোট ২৪-এর ইঙ্গিতবাহী। আগামী এক বছরে আরও ধস নামবে বিজেপি শিবিরে। টাকার থলি বা দেশাত্মবোধের আবেগ উস্কে আর কাজ হবে না। ফলেন পরিচিয়তে। বিজেপি কেমন ফল, তা দুই টার্মের শাসনে বোঝা হয়ে গিয়েছে। সুতরাং এরাজ্যে কিংবা সারা দেশে বিজেপির পরিণাম স্রেফ নির্বিকল্প সমাধি। হরি ওম্!