পারিবারিক ধর্মকর্ম পালনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ। সন্তানের কর্মসাফল্যে গর্ব। গবেষণায় অগ্রগতি। ... বিশদ
আজ পর্যন্ত কোনও ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট তাঁদের দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতীয় ঐতিহ্য বাস্তিল দিবসের প্রধান অতিথির সম্মান দেননি। এই প্রথম ভারতের কোনও প্রধানমন্ত্রী বাস্তিল দিবসের গেস্ট অফ অনার হিসেবে উপস্থিত থাকছেন। এই বিরল সম্মান কেন? ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ নরেন্দ্র মোদিকে বিশেষ শ্রদ্ধাভক্তি করে তাঁকে রোলমডেল হিসেবে ভাবেন বলে? নাকি খুব শীঘ্রই ভারত বিশ্বের এক নম্বর আর্থিক ও সামরিক শক্তি হবে বলে? ভারতীয় হিসেবে এই সম্মানগুলি আমাদের কি ভালো লাগছে না? আমরা গৌরবান্বিত হচ্ছি না? অবশ্যই হচ্ছি! তবে পাশাপাশি আমাদের মনে একটি করে কূট প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। যখনই ভারতের প্রধানমন্ত্রী খুব উচ্চকিত প্রচারের আলো নিয়ে বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলিতে যান, তখন একটিও কোনও সফর এরকম হয় না কেন, যেখানে সেইসব দেশ ভারতের থেকে মোটা অঙ্কের কোনও আর্থিক মুনাফার অর্ডার পায় না? প্রতিটি সফরেই ভারত কিছু না কিছু বিপুল অঙ্কের অস্ত্র অথবা সামরিক সরঞ্জাম কিংবা বাণিজ্য ডিল করে আসে কেন, যা আদতে ওইসব দেশের সরকার এবং কর্পোরেটকে মুনাফার শিখরে বসিয়ে দেয়? আমাদের মধ্যে তাই প্রশ্ন আসে তাহলে কি ওই মুনাফা পাওয়াই আসল লক্ষ্য এইসব দেশের? সেই কারণেই ক্রেতালক্ষ্মী হিসেবে ভারতের রাষ্ট্রপ্রধানকে এত যত্ন করে বসিয়ে বিশেষ আদর আপ্যায়ন করা হয়?
মার্কিন প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত নৈশভোজের ঝকঝকে স্ট্যাটাসের পাশেই একাধিক বাণিজ্য চুক্তিও হয়েছে আমেরিকা ও ভারতের মধ্যে। আমেরিকা থেকে ভারত ২৫ হাজার কোটি টাকার এমকিউ নাইন বি আর্মড ড্রোন কিনবে। সেই অর্ডার আমেরিকা পেয়েছে এই সফরে। এছাড়াও ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে আমেরিকার কর্পোরেট সংস্থা জেনারেল ইলেকট্রিক এফ ৪১৪ ফাইটার জেটের ইঞ্জিন নির্মাণ করবে। ১২ হাজার কোটি টাকার বিনিময়ে ১০০ শতাংশ টেকনোলজি ট্র্যান্সফার করা হবে এই চুক্তিতে। এর পাশাপাশি অন্য একঝাঁক চুক্তিও আছে।
ফ্রান্সের বাস্তিল দিবসে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর গৌরবময় উপস্থিতির সঙ্গেই ফরাসি সরকার আরও কিছু জাগতিক উপহার পাবে আগামী দিনে। যার অন্যতম হল, ৯০ হাজার কোটি টাকার রাফাল এয়ারক্র্যাফট ফাইটার এবং স্করপিন সাবমেরিন। ভারত কিনবে ফ্রান্স থেকে। কমবেশি ১ লক্ষ কোটি টাকার অর্ডার পাবে ফ্রান্স। ভারতকে ফ্রান্স সর্বোচ্চ সম্মান দেবে না কেন? দেওয়াই তো স্বাভাবিক!
আমেরিকা ও ফ্রান্সের আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী কোন দেশে গিয়েছিলেন? জাপান। সেই সফরে জাপানের কী লাভ হয়েছে? জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি নামক সংস্থা থেকে ভারত প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার চুক্তি করেছে। সেই টাকা ভারতকে ঋণ দিয়ে জাপানের সংস্থা মুনাফা করবে দুভাবে! যা নাকি এই সংস্থা করে থাকে। যেসব প্রজেক্টের জন্য এই লোন নেওয়া হয় সেগুলি রূপায়ণে অনেকটাই যুক্ত করা হয় জাপানের সংস্থাকে। মোট সাতটি প্রকল্পের জন্য লোন নেওয়া হচ্ছে। সে তালিকায় কী নেই? ডেডিকেটেড ফ্রেট করিডর থেকে বেঙ্গালুরুর ওয়াটার প্রজেক্ট। এমনকী উত্তরাখণ্ডের হর্টিকালচার প্রকল্প! আবার একইসঙ্গে জাপান ভারতের সঙ্গে চুক্তি করেছে যে তারা ভারতে ৩ লক্ষ কোটি টাকা লগ্নি করবে। ৩ লক্ষ কোটি টাকা লগ্নিতে থাকবে একটি দেশের সরকার যা যা করে সেইসব কাজ। শহরের পরিকাঠামো নির্মাণ, বিশুদ্ধ বিদ্যুৎ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সস্তার আবাসন, ইনটেলিজেন্ট ট্র্যান্সপোর্ট সিস্টেম ইত্যাদি।
চীন ও পাকিস্তানের পরম বন্ধু রাশিয়া। ভারত আবার রাশিয়ার সবথেকে বড় বন্ধু! কেন? কারণ, ভারত গোটা বিশ্ব থেকে যত অস্ত্র ক্রয় করে তার মধ্যে সিংহভাগ রাশিয়া থেকে। ভারত গোটা বিশ্ব থেকে এখন যত পেট্রল ডিজেল কেনে, তার সিংহভাগই রাশিয়া থেকে নেয়। আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্স ভারতের জন্য কে আগে প্রাণ করিবে দান নীতি নিয়েছে কেন? ভারত যত অস্ত্র আমদানি করে তার ৮৫ শতাংশ এই তিন দেশ থেকে।
এই যে ভারত একজন বিশ্বক্রেতা হয়ে উঠেছে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মার্কেটে ভারতের মতো সোনার ডিম দেওয়া হাঁসকে নিয়ে রীতিমতো টানাটানি চলে, এটাই তো স্বাভাবিক চিত্র প্রফেশনাল বিশ্বে। কারণ একটি দেশের মূল চালিকাশক্তি অস্ত্র নয়, অর্থনীতি। আর অর্থনীতি আসে টাকা রোজগার করা থেকে। এই দেশগুলি তাই বুঝে গিয়েছে চীন ও পাকিস্তানের জুজু দেখিয়ে ভারতকে বন্ধু বন্ধু বার্তা দিলেই ভারত শয়ে শয়ে অস্ত্র কিনবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নিজেকে বিশ্বগুরু হিসেবে দেখতে ও দেখাতে পছন্দ করেন। তাঁর দল ও সরকার সেকথা উচ্চকিতভাবে প্রচারও করে।
ক্রেতার তো উচিত শর্ত আরোপ করা। অর্থাৎ আমার কী লাভ হবে তোমার দোকান থেকে মোবাইল কিনলে? তোমার থেকে গাড়ি কিনলে? এটাই তো হয়ে থাকে প্রাত্যহিক জীবনে! অর্থাৎ দর কষাকষি! অথচ ভারতের কী লাভ হয়েছে? মনমোহন সিং-এর আমলেও ভারত রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী আসন পায়নি। নরেন্দ্র মোদির আমলেও পাচ্ছে না। নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ার্স গ্রুপের এলিট ক্লাবে ভারত আগেও ছিল না। এখনও নেই। আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্স কতটা কোণঠাসা করেছে পাকিস্তানকে? কতটা ধমক দিয়েছে চীনকে?
ভারত থেকে আমেরিকার মুনাফা অন্তহীন। শুধুমাত্র একটি আমেরিকান সংস্থার মুনাফার উদাহরণ দেখা যাক। গুগল ইন্ডিয়ার আয় ভারত থেকে ২০২০ সালে হয়েছিল ৫৫০০ কোটি টাকা। ২০২২ সালের শেষে সেই আয় হয়েছে ৯৫০০ কোটি টাকার কাছাকাছি। ভারতের সবথেকে প্রতিভাবান ছাত্রছাত্রীদের সিংহভাগের গন্তব্য কী হয়? বিদেশ যাওয়া। সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী ভারতের দেড় কোটি ছাত্রছাত্রী ৮৫টি দেশে পড়াশোনা করছে। তার মধ্যে ৫২ শতাংশ আমেরিকায়। ২০২৪ সালের মধ্যে ২ কোটির বেশি ছাত্রছাত্রী যাবে বিদেশে। যাদের সম্মিলিত ইনভেস্টমেন্টের সিংহভাগ পাবে আমেরিকার সরকারি ও বেসরকারি ইনস্টিটিউটগুলি। কয়েক লক্ষ কোটি টাকার বেশি।
ভারত সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রক মাঝেমধ্যেই আত্মনির্ভর ভারত, মেক ইন ইন্ডিয়ার আত্মসন্তোষের হুংকার দেয়। চীনকে আগামী দিনে নাকি ভারত ছাপিয়ে যাবে বাণিজ্যে, এরকম একটি দাবি করা হয়। চীন অনেক দূর। ভারত আগে বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়াকে ছাপিয়ে যাক! রেডিমেড গার্মেন্ট অর্থাৎ পোশাক রপ্তানিতে ভারতের থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে আর্থিক বিচারে। চীন সর্ববৃহৎ রপ্তানিকারী। হাই টেকনোলজি ম্যানুফ্যাকচারিং এক্সপোর্ট ক্ষেত্রে ভারতের তুলনায় শতকরা হিসেবে ভিয়েতনাম এগিয়ে। মালয়েশিয়া পাল্লা দিচ্ছে বহু ক্ষেত্রে।
চীন যখন ২০২০ সালে লাদাখে প্রবেশ করে ভারতের ভূমিদখলে উদ্যত হয়েছিল এবং সংঘাত শুরু হয়, তখন ভারত সরকার হুংকার দিয়েছিল চীনকে বয়কট করা হবে। চীনের পণ্য ক্রয় কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে ঘোষণাটি করোনাভীত ভারতবাসী শুনতে পেয়েছিল ঘরে বসে। সেই গর্জনের পরিণতি বর্ষণে পর্যবসিত হয়েছে? তিন বছর পর আমরা কী দেখছি? বেশিদূর যেতে হবে না। এই বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত মাত্র চার মাসের সময়সীমায় দেখা যাচ্ছে চীন থেকে ভারতের পণ্য আমদানি বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ। প্রতি চার মাসেই বাড়ছে। তিন বছর ধরে বেড়েই চলেছে। কী কী পণ্য? ফার্মাসিউটিক্যাল উপাদান, কেমিক্যাল, ইলেকট্রিক্যাল, মেকানিক্যাল মেশিনারি, অটোমোবাইল উপকরণ এবং চিকিৎসা পণ্য।
‘বসন্ত বিলাপ‘ সিনেমায় পুকুরপাড়ে বসে সিধুরূপী চিন্ময় রায় বান্ধবীকে বলেছিলেন, ‘আমাকে বলো উত্তমকুমার!’ আমরা আজও সেই নির্মল কৌতুকের কথা উল্লেখ করে হাসি! ক্রমেই বিশ্ব কূটনীতির জগতে ‘আমাকে বলো বিশ্বগুরু’ নামক ঘোষিত আর অঘোষিত সংলাপটি সেরকম কোনও কমেডিতে পর্যবসিত হচ্ছে না তো!