পারিবারিক ধর্মকর্ম পালনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ। সন্তানের কর্মসাফল্যে গর্ব। গবেষণায় অগ্রগতি। ... বিশদ
কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, এত হানাহানি, অস্ত্রের আস্ফালন, বোমাবাজি আর লাঠিসোটা নিয়ে দৌড়দৌড়ি করে এরাজ্যের গরিব মানুষ কী পেল? পঞ্চায়েত ভোট আক্ষরিক অর্থেই গ্রাম বাংলার ভোট। এরাজ্যের মোট জনগণের প্রায় অর্ধেক, সাড়ে পাঁচ কোটি ভোটার। গত এক দেড় মাসের হিংসায় কী মিলল? কিছু পরিবার তাঁদের একমাত্র রোজগেরে সদস্যকে হারিয়ে আরও অন্ধকারে তলিয়ে গেল। বাড়ি ভাঙল, জীবন বিপন্ন হল, সম্পত্তি নষ্ট হল, লাভের লাভ কিছুই হল না। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হল কে? কোনও রাজনৈতিক দল নয়, নেতানেত্রীও নয়, বাংলার খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। স্বভাবতই আবারও সেই একই জিজ্ঞাসা, রাজনীতিকদের ক্ষমতা দখলের এই নোংরা লড়াইয়ে আর কতদিন ক্রীড়নক হয়ে থাকব আমরা, আম ভোটাররা? আমাদের চৈতন্য ফিরবে কবে?
আর বাংলার সামগ্রিক অগ্রগতি? যুব সমাজের ভবিষ্যৎ? একটা পঞ্চায়েত ভোট ঘিরেই এত মারামারি আর হাঙ্গামার ছবি। মনোনয়ন জমা পড়ার পর থেকে ভোটের দিন পর্যন্ত কয়েক ডজন মানুষের প্রাণহানি। এ লেখা শেষ হলেও মৃত্যুর খতিয়ান থামে না। সংখ্যাটা বাড়তেই থাকে। কেউ আবার মনে করিয়ে দেয়, এখনও গণনা তো বাকি। অর্থাৎ পিকচার আভি বাকি হ্যায়। কিন্তু কোন আদর্শকে তুলে ধরার জন্য? কোন রাজকর্ম সাধনের জন্য? শুধুই ক্ষমতা দখল, পঞ্চায়েতের অর্থের ভাগ উসুল করার জন্য? এই প্রশ্নের মুখোমুখি হলেই বুকটা কেমন হু হু করে ওঠে। কোথায় চলেছে বাংলা! উন্নয়ন নয়, মূল্যবৃদ্ধির বিরোধিতা নয়, চাকরির সংস্থান নয়, নতুন কোনও ব্যবসা কিংবা শিল্প স্থাপনের দিশাও নয়। যেভাবে একের পর এক রাজ্যে মোদিজির সৌজন্যে জনপ্রতিনিধি কেনাবেচা হচ্ছে, তার প্রতিবাদও নয়, হয় ভোট লুট কিংবা তা রুখে দেওয়ার জন্য রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ! যাঁরা গ্রামে রকে বসে, মাটির দালানে, পাড়ার মাঠে একসঙ্গে আড্ডা দেয়, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চাষবাস করে, ভোট এলেই তাঁরা দুটি শিবিরে বিভক্ত। শাসক বনাম বিরোধী, যেন হিন্দুস্তান আর পাকিস্তান।
অন্য রাজ্যে তো এমন হয় না। উত্তরপ্রদেশ, কর্ণাটক, রাজস্থান এমনকী বিহারে পর্যন্ত নির্বাচন ঘিরে হালে আর সেই পুরনো ছবি চোখে পরে না। রাজনৈতিক রেষারেষি যাই থাক মোটের উপর বিহারেও গত বিধানসভা ভোট রক্তপাতহীনই ছিল। হালের নির্বাচনে কর্ণাটকও তাই। পরিসংখ্যান বলছে, বিগত পঞ্চায়েত ও পুরসভার ভোটে দেশের অন্যতম বড় রাজ্য উত্তরপ্রদেশেও এমন প্রাণহানি, ভোট লুটের খবর মেলেনি। বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচন বাকি রাজ্যগুলিতেও হয়। মানুষ নির্বিঘ্নে প্রয়োগ করে তার অধিকার। কিন্তু প্রায় এক মাসের উপর এরাজ্যে এমন উত্তেজনা আর আগুন জ্বলতেই দেখা যায়। বাইরের শত্রুর আক্রমণের চেয়েও গৃহযুদ্ধ ভয়ঙ্কর। এতে একটা জাতি ভিতর থেকে নিঃস্ব হয়ে যায়, আর ফায়দা লোটে বাইরের হার্মাদরা। বাংলার আজ সেই শোচনীয় দশা। আর আমরা নীরব দর্শক মাত্র।
এখানে বিরোধীদের সংগঠন নেই, লোকবল নেই বলেই ভোট এলেই তারা আদালতে ছোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়ে। অন্য আর কোথায় বিশাল ৮২২ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে সামান্য পঞ্চায়েত ভোট করতে হয়, জানা নেই। বাইরের বাহিনীর আসা নিশ্চিত করতে দফায় দফায় আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। আদালতের নির্দেশের পরও বাহিনী এসে পৌঁছয় না। অগত্যা ভোটের আগের রাতে সুদূর লে থেকে আধাসেনা উড়িয়ে নিয়ে আসতে হয়। রাজ্যপালকে রাজনৈতিক নেতার মতো সকাল বিকেল ক্লিশে বিবৃতি দিয়ে সন্ত্রাস দেখতে বেরতে হয় না অন্য আর কোথাও। প্রচার শেষ হয়ে যাওয়ার পর, এমনকী ভোটের মধ্যেও গণ্ডগোলের খবর পেয়ে দূর জেলায় ছুটে যেতে হয় না তাঁকে।
কিন্তু এর ময়নাতদন্ত কি কোনও রাজনৈতিক দল কিংবা প্রশাসন করবে? এককথায় না। নির্বোধ ছাড়া কেউ এ প্রশ্নের শিকড়ে পৌঁছতে আগ্রহী নন। প্রায়শই বলা হয়, বাংলায় শিল্প হয়নি, চাকরির প্রয়োজনীয় সুযোগ নেই বলেই যুব সমাজের একটা বড় অংশ ভিনরাজ্যে চলে গিয়েছে। দুর্ভাগ্য, আমরা মেধা ধরে রাখতে পারিনি, যুব সমাজকে ন্যূনতম চাকরির সুযোগও করে দিতে পারিনি। অথচ বোমা, গুলি, বারুদ আর হানাহানির সেই সংস্কৃতি বিগত নকশাল আমলেরও অর্ধশতক পরও দিব্যি বহন করে চলেছি সগৌরবে। পরের অর্ধশতকে অমৃতকালই আসুক কিংবা কর্তব্যকাল আমরা দেখে যেতে পারব না সত্যি। কিন্তু হলফ করে বলা যায়, শাসন ক্ষমতায় যেই আসুন, এই বঙ্গে রাজনৈতিক রক্তারক্তির এই ধারাবাহিক মেগা সিরিয়াল মঞ্চস্থ হতেই থাকবে। এবং গরিব মানুষের মাটির ঘর ভাঙচুর হবে। গরিবের দাওয়ায় ভোটের ২৪ ঘণ্টা আগে বোমার সঙ্গে ধূপ, গীতা, আর থান কাপড়ের অদ্ভুত সহাবস্থানও অবলীলায় দেখতে পাওয়া যাবে। সেই ঘৃণার আবর্তে জাতিটার মেরুদণ্ডটাও হয়তো আরও দুর্বল হয়ে যাবে!
আর আমরা কিঞ্চিৎ সুবিধাবাদী মধ্যবিত্ত যাঁদের রেস্তো আছে তাঁরা ভিডিও কল করে সন্ধ্যায় আমাদের প্রবাসী সন্তান-সন্ততিকে সাবধান করব, ভুলেও যেন এই বাংলায় ফিরে না আসে! ঘুরতে আসা ছাড়া পা না রাখে। এটাই এই মুহূর্তে আমাদের চারপাশের শহুরে মধ্যবিত্ত শহুরে সমাজের মনের কথা। এমনকী গ্রামের সম্পন্ন পরিবারেও তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এক একটা ভোট আসে নেতারা বুক ফুলিয়ে লড়াই করে। কার ভাগে ল্যাজা আর কার ভাগে বড় কাতলা মাছের মুড়োটা পড়বে তা নিয়ে সংঘাত প্রকাশ্য রাস্তায় নেমে আসে। মধ্যবিত্ত স্বচ্ছল পরিবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পরবর্তী প্রজন্ম সকলের অজান্তেই একটু একটু করে এরাজ্যের সীমানা ছেড়ে অন্যত্র কেটে পড়ে। এই ঝোঁক শুরু হয়েছে বিগত আশির দশকের শেষ থেকে। কার ভোটবাক্সে রক্তক্ষরণ বাড়ল আর কার পক্ষে সমর্থনের জোয়ার সব তুচ্ছ করেই এই বাংলা ছাড়ার হিড়িক আজ আরও ঊর্ধ্বমুখী।
এত গণ্ডগোল হয়, এত রক্তপাত। নেতা উপনেতার এলাকা থেকে পাড়ায় দখলদারির স্বপ্ন কিংবা পুনর্দখলের খোয়াব? কিন্তু তাঁদের গায়ে আঁচড়টি পড়ে না, সংঘর্ষে সবসময়ই প্রাণ যায় উলুখাগরার। একটা নেতাকেও আক্রান্ত হতে দেখেছেন বিগত পাঁচ দশকে। এই নির্বাচনেও গরিবের মাটির দাওয়ায় বসে সদ্য বিধবা হওয়া রমণীর আকুলিবিকুলি কান্না আর আর্তনাদ নেতানেত্রীদের পাঁচমহলা প্রাসাদের অন্দরমহলে পৌঁছয় না। যাঁরা প্রাণ হারালো তাঁদের জন্য মাসিক চাল ডাল, সামান্য কিছু টাকা আর বাৎসরিক শহিদ তর্পণ ব্যস, কর্তব্য শেষ। স্বজন হারানো পরিবারটার প্রতিদিনকার বিড়ম্বনার খোঁজ কেউ রাখে না। ফল বেরলে রং বেরংয়ের আবির, বেলুন পতাকা ফেস্টুনের আড়ালে চাপা পড়ে যায় সবকিছু। নতুন করে আবার রোজগারে মন দেয় নেতা থেকে তার আশ্রিত অনুগামীরা। এভাবেই চলতে থাকে বঙ্গ রাজনীতির অলস বারোমাস্যা। মাঝে মাঝে মনে হয়, যেনতেন ক্ষমতা দখল কিংবা তা অক্ষুণ্ণ রাখাই বুঝি এরাজ্যের ক্ষমতাধর তথা বিরোধীদের ডিএনএতে গেঁথে আছে। তার থেকে রেহাই পাওয়ার কোনও সুযোগই নেই। উন্নয়ন হোক না হোক, চাকরি জুটুক না জুটুক হরেক কিসিমের নেতার বসন্ত যে!
বিরোধীদেরও সংগঠন নেই বলে ক্রমাগত কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়ে আবেদন দেখে মনে হয়, বহিরাগত জওয়ানরাই বুঝি তাঁদের দুর্বলতা ঢেকে দেবে। না হলেই তাঁরা মহাশূন্যে মিলিয়ে যাবে। সেই জন্যই ভোটের ফল বেরনোর দশদিন পরও রাজ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন রাখার কথা বলেছে হাইকোর্ট। এর উদ্দেশ্য একটাই তিক্ততা শেষে ফল বেরলে যেন অযথা আক্রোশ নতুন করে প্রাণহানি না ঘটে। কিন্তু বাহিনী তো চিরদিন থাকতে পারে না। সবে ভোট কাটল, এখনও গণনা বাকি। তারপর আছে ফলাফলের প্রতিক্রিয়া, নির্বাচনোত্তর গণ্ডগোল। প্রার্থনা একটাই, বাংলার একটা ঘরেও যেন স্বজন হারানোর কান্না শোনা না যায়, নিশ্চিত করুক নির্বাচন কমিশন। ব্যর্থ প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনার গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক। বাংলা উন্নয়নে এগিয়ে থাক, গোলাগুলি আর রক্তপাতে নয়।