পারিবারিক ধর্মকর্ম পালনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ। সন্তানের কর্মসাফল্যে গর্ব। গবেষণায় অগ্রগতি। ... বিশদ
দুঃখ এটাই যে, এই নির্দেশমূলক নীতিগুলির উপর কোনও বিতর্কই হয় না। বিতর্ক হয় না সরকারের এজেন্ডার উপরেও। আরএসএস-বিজেপির এজেন্ডা এবং সুপ্রিম কোর্টের কিছু পর্যবেক্ষণের সৌজন্যে ৪৪ নম্বর অনুচ্ছে একাই রাজনৈতিক পরিসর দখল করে আছে।
শব্দের অর্থ আছে
এবার অনুচ্ছেদ ৪৪-এর ভাষাটা খেয়াল করা যাক: ‘রাষ্ট্র ভারতের সমগ্র অঞ্চল জুড়ে নাগরিকদের জন্য একটি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি (ইউনিফর্ম সিভিল কোড) সুরক্ষিত করার চেষ্টা করবে।’ শব্দদের নিজস্ব অর্থ আছে। অ্যালিসের উদ্দেশে হাম্পটি ডাম্পটির উত্তরের মতো—‘এটা বোঝাতে আমি যা বেছে নিই’ একটি শব্দের সেটাই অর্থ নয়। ‘ইউনিফর্ম’ এখানে ‘কমন’ নয়। ‘সুরক্ষিত করার চেষ্টা করা হবে’ কথার অর্থ ‘সুরক্ষিত হবে’ নয়। বাবাসাহেব আম্বেদকর এবং তাঁর সহকর্মীরা নির্বোধ ছিলেন না। ভারতীয় জনগণের ইতিহাস, ধর্ম, বর্ণের পার্থক্য, সামাজিক ও পারিবারিক ব্যবস্থা, সংস্কৃতির চর্চা এবং রীতিনীতি সম্পর্কে তাঁদের গভীর জ্ঞান ও উপলব্ধি ছিল। তাই চতুর্থ অধ্যায়ের শব্দগুলি তাঁরা যত্নসহকারেই বেছে নিয়েছিলেন।
ইউনিফর্ম সিভিল কোড বা অভিন্ন দেওয়া বিধি (ইউসিসি) কথাটি—ব্যক্তিগত আইনগুলির সংক্ষিপ্ত রূপ। এটা চারটি ক্ষেত্রের আইনের সঙ্গে সম্পর্কিত: বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার (সাকসেশন ও ইনহেরিট্যান্স), নাবালকত্ব ও অভিভাবকত্ব এবং দত্তক ও প্রতিপালন। শত শত বছর ধরে, দেশের বিভিন্ন শ্রেণি এবং ভৌগোলিক অঞ্চলের মানুষের ব্যক্তিগত আইন নানা উপায়ে উন্নততর হয়েছে। জনগণের শাসকরা ব্যক্তিগত আইনের এমন বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এই ক্ষেত্রে ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়ে গিয়েছে। ভূপরিচয়, বংশবিস্তার, বিজয়, অভিবাসন এবং বৈদেশিক প্রভাবও ব্যক্তিগত আইনগুলিকে প্রভাবিত করেছে।
সংস্কারের সূচনা ১৯৫৫ সালে
ব্যক্তিগত আইনগুলি আজ যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে লিঙ্গবৈষম্যের পাশাপাশি রয়েছে লিঙ্গভিত্তিক নয় এমন ক্ষেত্রগুলিতেও বৈষম্য। রয়েছে অবৈজ্ঞানিক ও অস্বাস্থ্যকর প্রথা। আর আছে সামাজিকভাবে নিন্দনীয় কিছু প্রথা ও অভ্যাস। ব্যক্তিগত আইনের এই দিকগুলির অবশ্যই সংস্কার দরকার।
ব্যক্তিগত আইনের সংস্কার নতুন কিছু নয়। এটা জাতীয় এজেন্ডায় রয়েছে সংবিধান প্রণয়নের পর থেকেই। ভারতের প্রথম সংসদের (১৯৫২-৫৭) সবচেয়ে বড় চিন্তার মধ্যেই এটা ছিল। সংস্কারের হোতাদের মধ্যে ছিলেন জওহরলাল নেহরু এবং বাবাসাহেব আম্বেদকর। জনগণের গোঁড়া এবং রক্ষণশীল অংশের বিরোধিতা সত্ত্বেও, হিন্দু আইন সংশোধন ও বিধিবদ্ধ করার সাহস দেখিয়ে পাশ করা হয়েছিল চারটি প্রধান আইন:
হিন্দু বিবাহ আইন, ১৯৫৫
হিন্দু উত্তরাধিকার (সাকসেশন) আইন, ১৯৫৬
হিন্দু নাবালকত্ব ও অভিভাবকত্ব আইন, ১৯৫৬
হিন্দু দত্তক ও প্রতিপালন আইন, ১৯৫৬
একটি নতুন জাতি তার সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত আইনগুলির সংস্কারে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ করেছিল। কাজটি ছিল বৈপ্লবিক, তবে কিছু পুরনো দিক বজায় রাখাতেও সায় ছিল সেই বিপ্লবের। সমস্ত বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার অপসারণ করা হয়নি। একটি আইনি সত্তা হিসেবে হিন্দু অবিভক্ত পরিবারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। বিবাহের প্রথা ও ব্যবহার স্বীকৃতি পেয়েছিল ব্যতিক্রম হিসেবে। পদবিটা (লাস্ট-নেম) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ভারতে বেশিরভাগ বিবাহ সম্পন্ন হয় প্রথা অনুযায়ী।
আরও কিছু সংশোধন করা হয়েছিল ১৯৬১, ১৯৬২, ১৯৬৪, ১৯৭৬, ১৯৭৮, ১৯৯৯, ২০০১ এবং ২০০৩ সালে। ইউপিএ জমানায়, ২০০৫ ও ২০০৮ সালের মধ্যেও কিছু সংস্কার করা হয়। সংশোধন করা হয়েছিল উপরে তালিকাভুক্ত চারটি আইনের মধ্যে তিনটির। বৈপ্লবিক পরিবর্তন যেটা হয়েছিল তা হল—সম্পত্তির উপর কন্যা ও পুত্রদের সমান অধিকার প্রদান। নতুন তৈরি আইনগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: পারিবারিক হিংসা থেকে নারীর জন্য সুরক্ষা আইন, ২০০৫; বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ আইন, ২০০৬; এবং পিতা-মাতা ও প্রবীণ নাগরিকদের প্রতিপালন ও কল্যাণ আইন, ২০০৭। যেসব ক্ষেত্রে আইন প্রণয়নকারী সংস্থাগুলির (পার্লামেন্ট ও বিধানসভা) দ্বিধা ছিল সেখানে পদক্ষেপ করেছিল আদালতগুলি। মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত তালাক-ই-বিদাত (তিন তালাক) প্রথাটি, ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট অসাংবিধানিক আখ্যাসহ বাতিল করে দেয়।
২১তম আইন কমিশনের দিকে মনোযোগ দিন
জনজাতিদের ব্যক্তিগত আইনের মুখোমুখি হলে আমরা থেমে যাই। উপরে বর্ণিত চারটি আইনের কোনওটিই—সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৬৬, ধারা ২৫-এর অধীনে প্রজ্ঞাপিত তফসিলি জনজাতিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিল যোগ করা হয়েছিল অসম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামের জনজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলির প্রশাসনের জন্য। সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির জেলা ও আঞ্চলিক সংসদগুলিকে উত্তরাধিকার, বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদ এবং সামাজিক প্রথা সংক্রান্ত আইন তৈরির ক্ষমতা প্রদানসহ ওইসঙ্গে একটি অনুচ্ছেদও যুক্ত হয়। বিশেষ বিধান যোগ করা হয় নাগাল্যান্ড (অনুচ্ছেদ ৩৭১এ), সিকিম (অনুচ্ছেদ ৩৭১এফ) ও মিজোরামের (অনুচ্ছেদ ৩৭১জি) ক্ষেত্রে ধর্মীয় বা সামাজিক অনুশীলন এবং প্রথাগত আইন রক্ষার উদ্দেশ্যে। অনুরূপ বিশেষ বিধান পাওয়ার দাবি তোলা হয়েছে ছত্তিশগড় এবং ঝাড়খণ্ডের জনজাতি সংস্থাগুলির তরফেও।
ব্যক্তিগত আইনগুলির ক্ষেত্রে আরও কিছু সংস্কার জরুরি। ২১তম আইন কমিশন মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছে: ‘তাই কমিশন একটি ইউসিসি প্রদানের পরিবর্তে বৈষম্যমূলক আইনগুলিরই মোকাবিলা করছে, কারণ ইউসিসি এই পর্যায়ে প্রয়োজনীয় বা কাম্য নয় ... যখন অভিন্নতা নিজেই দেশের আঞ্চলিক অখণ্ডতার পক্ষে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, তখন আমাদের কাঙ্ক্ষিত সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের সঙ্গে আপস করা যাবে না।’
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইস্যুটিকে এমনভাবে সাজিয়েছেন যাতে একটি বাইনারি বা দুটিমাত্র মতের বিষয় হয়ে ওঠে—ইউসিসির ‘পক্ষে’ অথবা ‘বিপক্ষে’। এই দৃষ্টিভঙ্গি ভারতের জনগণকে নির্বোধ বিবেচনা করে। এই ব্যাপারে যথার্থ উপায় হল—মুসলিম আইনসমেত সমস্ত ব্যক্তিগত আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিষয়ে একটি অর্থপূর্ণ আলোচনা শুরু করা। মূল শব্দটি হল সংস্কার (রিফর্ম), অভিন্ন (ইউনিফর্ম) নয়।