পারিবারিক ধর্মকর্ম পালনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ। সন্তানের কর্মসাফল্যে গর্ব। গবেষণায় অগ্রগতি। ... বিশদ
দুবাই। ঝকঝকে রাস্তাঘাট, উঁচু উঁচু ঘরবাড়ি, কাচে মোড়া ট্রাম বাস, বিদেশি গাড়ির ঝকমারি, বিলাসবহুল জীবনযাপন। এমন ঝাঁ চকচকে দেশে খাদ্যবিলাস যে ভিন্ন মাত্রা পাবে তাতে আর সন্দেহ কী? সম্প্রতি সামার ফ্যাম ট্রিপে দুবাই পর্যটনের আমন্ত্রণে দুবাই ঘোরার সুযোগ হল। ফ্যাম ট্রিপ অর্থাৎ ‘ফ্যামেলিয়ারাইজিং ট্রিপ’। অচেনাকে চেনার অবকাশ। মরুভূমির দেশকে একটু নতুনভাবে চেনার ও দেখার সুযোগ ঘটল এই ভ্রমণের মাধ্যমে। দুবাইয়ের খাদ্যবিলাসের ঝলক চেখে দেখা গেল।
মিশলিন স্টার
রেস্তরাঁ অবতার
দুবাইয়ের প্রথম ও একমাত্র মিশলিন স্টার রেস্তরাঁর কথা দিয়েই শুরু করা যাক। মিশলিন স্টার হল রেস্তরাঁর সর্বোচ্চ খেতাব। অবতার রেস্তরাঁর সাজপোশাক থেকে খাবার পরিবেশন সবকিছুই আলাদা। নিরামিষ এই রেস্তরাঁয় একটা পুজো পুজো ভাব লক্ষ করা যায়। দেওয়াল থেকে টেবিল ক্লথ, ন্যাপকিন সবেতেই শ্বেতশুভ্র ছোঁয়া। খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে ব্রোঞ্জ, তামা, বাঁশ ইত্যাদির পাত্রে। এখানে আমাদের জন্য ছিল ষোড়শোপচারের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা। মেনুর তালিকাটি শুরু হল পঞ্চামৃত দিয়ে, শেষ হল পুষ্পাঞ্জলিতে। নৈবেদ্যর মধ্যে ছিল মাখন, মালাই, মিছরি ইত্যাদি। মুখে দিতেই গলে গেল। এরপর এল উদ্দীপকা। শসা, বিট ও ছানা দিয়ে তৈরি একটি পদ। এটি নাকি অ্যাপেটাইজার। তারপর রক্তফালম, টম্যাটো দিয়ে তৈরি স্যুপের মতো একটি পদ। এটি সামান্য ঝাঁঝালো। তাই সঙ্গে পাতলা সাবুর ক্র্যাকার। ঝাঁঝ লাগলে ওই ক্র্যাকার বা পাঁপড় দাঁতে কাটলে নিমেষেই ঝাঁঝ গায়েব! এরপর এল জারণ। এটি মাটির তলার সব্জি দিয়ে তৈরি। মাটির সঙ্গে আত্মার যোগাযোগ রাখতে এই খাবারটি সাহায্য করে। এরপর একটু স্বাদবদল দরকার। তাই খাবারে এবার আচারি সুগন্ধ। এই পদটি ভিটামিন সি সমৃদ্ধ। পরবর্তী পদগুলোর মধ্যে কৃষ্ণ ফল বা প্যাশন ফ্রুট দিয়ে তৈরি ভেল, ভিটামিন ও মিনারেলস-এ ঠাসা গ্রিঞ্জম, ডালের নতুন রূপ ইত্যাদি সবই ছিল। এরপর মিষ্টিমুখ। এক্ষেত্রে পুজোর ছোঁয়ায় পায়েস ও মধুরম (হিমাচলি মিষ্ট বালমিঠাই) দিয়ে খাওয়াদাওয়ায় ইতি টানব ভেবেছিলাম। ও মা! শেষ হইয়াও হইল না শেষ-এর মতো পান বনবন এসে হাজির হল পাতে। পানের পাতা হজমশক্তি বাড়ায়। পেটপুজোর শেষে তাই পান মাস্ট। এখানেও ইতি টানা গেল না। একেবারে শেষে এসে পুষ্পাঞ্জলি অর্থাৎ জ্যাসমিন টি।
শুধু খাবারের নাম, স্বাদ ও পরিকল্পনাই নয়, পরিবেশনার কায়দাও বেশ অভিনব। প্রতিটি পদের সঙ্গেই পরিবেশনকারীর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। রেস্তরাঁর এগজিকিউটিভ শেফ রাহুল রানা বললেন ‘অতিথি দেব ভব। আমরাও সেই মন্ত্রে দীক্ষিত। তাই এখানে যাঁরা খেতে আসেন তাঁদের তৃপ্তিই আমাদের পরম কাম্য।’
চীনে স্বাদের হুতং
দুবাইয়ের পর্যটন থেকে খাওয়াদাওয়া এবং কেনাকাটা সবেতেই বিভিন্ন দেশের ছোঁয়া লেগেছে। জামাকাপড়ে বিদেশি ধাঁচ যেমন লক্ষণীয়, তেমনই খাবারেও বিদেশি পদ ও রেস্তরাঁর প্রাচুর্য চোখে পড়ল। প্রথম দিন সান্ধ্যভোজে যে রেস্তরাঁয় উপস্থিত হলাম তার নাম হুতং। নামেই স্পষ্ট এটি চীনে রেস্তরাঁ। হুতং চীনে গলি। এখানে স্ট্রিট ফুড বিখ্যাত। এই রেস্তরাঁয় হুতং ফ্রায়েড রাইস বা ক্রিস্পি ফ্রায়েড ডাম্পলিং-এর মতো পরিচিত পদ যেমন পাবেন তেমনই পাবেন পিকিং ডাক রোস্ট, ক্রিস্পি এগপ্লান্ট, মাশরুম বাও-এর মতো নতুনত্বে ভরা পদও। পিকিং ডাক এল বড় ট্রে-তে করে ভিন্ন সাজসরঞ্জাম সহ। পাতলা স্লাইস করে কাটা ডাক খেতে হয় রাইস পেপারে মুড়িয়ে। সঙ্গে থাকে নোনতা ও ঝাল স্যস। মাশরুম বাও-এর দেখনদারির সীমা নেই। একদম গোল বাটন মাশরুমের মতো তার চেহারা। কাঁটা গেঁথে খেতে গিয়ে দেখি ময়দা আর ব্রেড ক্রাম্ব দিয়ে বানানো বাও-এর খোলের মধ্যে মাশরুমের পুর। রেস্তরাঁর জেনারেল ম্যানেজার জো সি বলেন, তাঁরা রেস্তরাঁর মেনুই শুধু নয়, তার অন্দরসজ্জাতেও চীনে ধাঁচ বজায় রেখেছেন। চীনে সংস্কৃতিতে ফেংশুই একটা বড় জায়গা দখল করে রেখেছে। সেই মতো রেস্তরাঁর অন্দর সজ্জায় একটা উইশিং ট্রি রাখা হয়েছে। এই গাছে তাগা বাঁধলে নাকি মনের কামনা বাসনা ফলে যায়। অতিথিদের একটা করে সুতোয় বাঁধা কার্ড দেওয়া হয়, তাঁরা নিজের ইচ্ছের কথা সেখানে লিখে গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেন।
কোকলে রেস্তরাঁয়
ফরাসি খাবার
দুবাইয়ের আর এক ভিনদেশি রেস্তরাঁ কোকলে। ফরাসি এই রেস্তরাঁর নামের অর্থ বহমান ধারা। রেস্তরাঁর এমন নামকরণের কারণ জিজ্ঞেস করলে শেফ ফাদি নাইম বললেন, ‘রেস্তরাঁয় সর্বক্ষণ অতিথিদের যাতায়াত লেগে থাকে। একটা বহমান স্রোতের সাক্ষী থাকি আমরা। সেই থেকেই এমন নামকরণ।’ রেস্তরাঁর অন্দরসজ্জায় আধুনিকতার ছাপ স্পষ্ট। এখানে আমাদের খাবার শুরু হয় স্টার্টার দিয়ে এবং শেষ হয় ডেজার্টে। স্টার্টারে ছিল শামুকের একটি পদ। নাম এসকারাগো। প্লেটে পাঁচটা খোল সহ শামুক, তার ভিতর শ্বাসটা পুদিনা ও অন্যান্য সবুজ শাকপাতা সহ রান্না করে ভরে দেওয়া হয়েছে। খাবার জন্য বিশেষ যন্ত্রপাতিও দেওয়া হয়। একা দু’ফলা যুক্ত কাঁটা শ্বাস বার করার জন্য আর একটা সাঁড়াশির মতো কাঁচি খোলটা ধরার জন্য। খুবই সাবধানে খেতে হয়। একটু এদিক ওদিক হলেই আপনার শামুক গিয়ে কোথায় পড়বে তার কোনও ঠিক নেই। এরপর মেন কোর্সে চিকেন, ফিশ, ল্যাম্ব, বিফ সবই পাবেন। চিকেন নিলে সঙ্গে আবার স্প্যাগেটিও দেওয়া হয়। আমি বরাবরের মাছভক্ত, স্যামন দেখে আর অন্য দিকে চোখ ফেরালাম না। এরপর মধুরেণ সমাপয়েৎ। অর্থাৎ শেষ পাতে ডেজার্ট। বিবিধ মেনু থেকে তিরামিসু আর ব্রাউনি উইথ আইসক্রিম এই দু’টিই মনে ধরল। ব্রাউনি এখানে একটু ভিন্ন স্বাদ ও আকারে তৈরি। গোলাকার ব্রাউনি ভাঙলেই ভেতর থেকে লাভার মতো হট চকোলেট বেরিয়ে আসে।
দুবাইয়ের খাবারে খেজুরের প্রাধান্য
সব শেষে দুবাইয়ে এমিরেটি খাবারের কথা সামান্য না বললে খাওয়া বৃত্তান্ত অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এখানে ল্যাম্ব তেহিতি বিখ্যাত। দুবাইয়ের যে কোনও রান্নায় মেওয়া, দই আর খেজুর ব্যবহার করা হয়। ল্যাম্ব তেহিতিতে ভাতের দু’টি স্তরের মাঝখানে মেওয়া সহযোগে রাঁধা মাটন থাকে। এছাড়াও এখানে খেজুর বাটা দিয়ে তৈরি মিল্ক শেকও খুব জনপ্রিয়। খেজুরের মিষ্টিও পাবেন নানারকম। খেজুরের দানা ফেলে তার মধ্যে মেওয়া ভরা হয়। রয়েছে বিভিন্ন স্বাদের কাবাবও। শিকে গাঁথা ল্যাম্ব, বিফ কাবাবের পাশাপাশি চিজ ও মেওয়া দেওয়া নিরামিষ কাবাবও পাবেন।