পারিবারিক ধর্মকর্ম পালনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ। সন্তানের কর্মসাফল্যে গর্ব। গবেষণায় অগ্রগতি। ... বিশদ
সেই চাঁদের দেশে আবার পাড়ি দিয়েছে ভারতের চন্দ্রযান-৩। প্রায় ৪০ দিন পরে, আগামী ২৩ বা ২৪ আগস্টের মধ্যে চাঁদের দক্ষিণ মেরুর মাটিতে নামতে পারে তৃতীয় চন্দ্রযান-এর সৌরচালিত ল্যান্ডার ‘বিক্রম’। তা থেকে নামবে রোভার ‘প্রজ্ঞান’। সূর্যোদয়ের সময়ই চাঁদের মাটিতে হবে সেই অবতরণ পর্ব। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে ভারতীয় মহাকাশ অভিযানের ইতিহাস নতুন মাত্রা পাবে। সে ক্ষেত্রে গত এক দশকে চীনের পর আরও কোনও দেশের মহাকাশযান সফল ভাবে চাঁদে অবতরণের নজির গড়বে। আমেরিকা, রাশিয়া, চীনের পরে চতুর্থ দেশ হিসেবে তালিকায় ঠাঁই পাবে ভারত।
প্রশ্ন উঠতে পারে, ভারতের মতো দেশের পক্ষে চাঁদে রকেট পাঠিয়ে লাভ কী? আমরা কি ‘বামন’ হয়ে চাঁদে হাত বাড়াচ্ছি? বিজ্ঞানীরা বলছেন, হাত বাড়ালেই চাঁদ! দূরত্বটা মাত্র ৩ লক্ষ ৮২ হাজার কিলোমিটার। এই সুবিশাল ব্রহ্মাণ্ডে যা নস্যি। আমাদের এত কাছে আর কোনও মহাজাগতিক বস্তু নেই। চাঁদ শুধুই যে আমাদের হাতের নাগালে, তা-ই নয়। এই ব্রহ্মাণ্ড কীভাবে তৈরি হয়েছিল, সেই আদিমতম ব্রহ্মাণ্ডের আচার, আচরণ কেমন ছিল, তা বুঝতে চাঁদের মতো এত কাছের, এত ভালো গবেষণাগার আর নেই। শুধু তাই-ই নয়, আগামী ৩০ বছরের মধ্যে চাঁদে গড়ে উঠতে চলেছে বড় শিল্পাঞ্চলও। চাঁদ-ই বাঁচাবে আমাদের। চাঁদ-ই হয়ে উঠবে আমাদের একমাত্র পরিত্রাতা। পৃথিবীতে শক্তির যাবতীয় চাহিদা মেটাবে চাঁদ-ই। শক্তির প্রয়োজন মেটাতে তখন আর কয়লা পোড়ানোর দরকার হবে না আমাদের। লাগবে না প্রাকৃতিক গ্যাসও। যে জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ে আমাদের এত মাথাব্যথা, যার জন্য হু হু করে বেড়ে চলেছে উষ্ণায়নের বিপদ, পৃথিবীর উত্তাপ বাড়ানো সেই জ্বালানির প্রয়োজনও ফুরবে। একদিন এদেশের মানুষ বুঝবে, আকাশছোঁয়া মূর্তি বানানো, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকায় যুদ্ধাস্ত্র কেনার চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন ছিল ‘মহাকাশ গবেষণার’ পিছনে খরচ করা। বহু দশক আগে যে প্রয়োজনের কথা প্রথম বলেছিলেন প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম। লিখেছিলেন তাঁর বই ‘দ্য সায়েন্টিফিক ইন্ডিয়ান’-এ।
মহাকাশ বিজ্ঞানীরা তো বহু আগেই জানিয়েছেন, চাঁদে রয়েছে যে বিপুল পরিমাণ ‘হিলিয়াম-৩’, তা পৃথিবীতে শক্তির যাবতীয় চাহিদা মেটাতে পারে। অন্তত ১০ হাজার বছরের জন্য। আমাদের গ্রহে ৫ হাজার কিলোগ্রাম ওজনের কয়লা পোড়ালে যতটা শক্তি উৎপাদন হয়, চাঁদের মাত্র ৪০ গ্রাম হিলিয়াম-৩ মৌল থেকে তৈরি হয় ততটাই শক্তি। হিলিয়াম-৩ মৌলটি দিয়ে অপ্রচলিত উপায়ে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে তেজস্ক্রিয়তার বিপদ এড়ানো যাবে পুরোপুরি। তা হবে অনেক বেশি নিরাপদ। পরিমাণে অনেক গুণ বেশি তো বটেই। প্রশ্ন হল, পৃথিবীতে কেন নেই হিলিয়াম-৩? সূর্যের করোনা বা বায়ুমণ্ডল থেকে প্রচুর পরিমাণে বেরিয়ে আসে এই বিশেষ আইসোটোপের মৌলটি। কিন্তু পৃথিবীর পুরু বায়ুমণ্ডল রয়েছে। সেই বায়ুমণ্ডলের কণাদের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে সূর্যের করোনা থেকে বেরিয়ে আসা হিলিয়াম-৩ আইসোটোপের মৌল অন্য মৌলে বদলে যায়। ফলে, পৃথিবী আর হিলিয়াম-৩ মৌলটিকে পায় না। কিন্তু চাঁদের কোনও বায়ুমণ্ডলই নেই। তাই সূর্যের করোনা থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসা হিলিয়াম-৩ মৌল সরাসরি এসে আছড়ে পড়ে চাঁদের পিঠে। তারা চাঁদের পিঠে (লুনার সারফেস) বালিকণার মধ্যেই মিশে থাকে। বায়ুমণ্ডল নেই বলে সূর্য থেকে চাঁদে আসা হিলিয়াম-৩ মৌল অবিকৃতই থেকে যায়। অন্য কোনও মৌলে বদলে যায় না বলে চাঁদে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে এই বিশেষ আইসোটোপের হিলিয়াম মৌল।
চাঁদে আমেরিকা যতগুলি ‘অ্যাপোলো’ মিশন পাঠিয়েছে, তাদের সকলেরই লক্ষ্য ছিল, আমাদের উপগ্রহে ওই তেজস্ক্রিয় মৌলগুলির সন্ধান ও সেগুলি কী পরিমাণে রয়েছে, তার খোঁজ করা। একই কারণে তখন রাশিয়াও (সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন) চাঁদে একের পর এক অভিযান চালিয়েছে। ভারত ও চীনের মতো দেশগুলিও এখন ছুটতে শুরু করেছে চাঁদে। যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করেছে ছোট ছোট উন্নয়নশীল দেশগুলিও। কারণ, তারা বুঝে গিয়েছে, অপ্রচলিত উপায়ে শক্তি উৎপাদনের সেরা হাতিয়ারটি রয়েছে চাঁদেই। হিলিয়াম-৩ মৌল। চাঁদকে ঘিরে আরও বড় স্বপ্ন রয়েছে গোটা দুনিয়ার। যে স্বপ্নটা দেখছে নাসা, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইএসএ বা ‘এসা’), ইসরোর মতো বিশ্বের প্রথম সারির মহাকাশ গবেষণা সংস্থাগুলি। চাঁদে মানব সভ্যতার দ্বিতীয় উপনিবেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন। ২০০৮-এ প্রথম চন্দ্রযান যে অপ্রত্যাশিতভাবেই চাঁদে তরল জলের (হাইড্রক্সিল আয়ন) অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছিল তাতে চমকে উঠেছিল গোটা দুনিয়া। জলের অস্তিত্ব মানেই তো প্রাণ টিকে যাওয়ার স্বপ্ন!
না, শুধু স্বপ্ন নয়, আসলে এই অভিযানগুলির পিছনে রয়েছে বিজ্ঞান ও বাণিজ্য— দুই-ই। ইসরো প্রমাণ করেছে, চন্দ্রাভিযানের মতো অভাবনীয় প্রকল্পও অনেক কম খরচে করা যায়। ভাবতে পারেন, দু’মাস আগে রিলিজ হওয়া ‘আদিপুরুষ’ ছবিটি তৈরি করতেই খরচ হয়েছিল ৭০০ কোটি টাকা। সেই তুলনায় চাঁদে অভিযানের খরচ ‘মাত্র’ ৬১৫ কোটি টাকা। যা একটি দৃষ্টান্ত। একটি নজির। শুনলে অবাক হবেন, ৫৪ বছর আগে আমেরিকা যখন অ্যাপোলো-১১ চাঁদে পাঠায় এবং তখন খরচ হয়েছিল ভারতীয় মুদ্রায় ২৮৭১ কোটি ৬১ লক্ষ টাকা। নাসা, ইসা (ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি বা ইএসএ), জাক্সা (জাপান স্পেস এজেন্সি)-র মতো বিশ্বের বড় মহাকাশ গবেষণা সংস্থাগুলি ভারতের চন্দ্রাভিযানের খরচ শুনে তাজ্জব। এতে ইসরো ও ভারতের মহাকাশ বিজ্ঞানের গবেষণা দুই’ই উপকৃত হবে। কারণ, সুলভে চোখ টানার মতো নতুন নতুন প্রযুক্তি প্রকৌশলে আগ্রহী হয়ে ছোট ছোট দেশগুলি যত বেশি করে ইসরোর দিকে ঝুঁকবে, ততই সরকারের উপর নির্ভরতা কমবে ইসরোর। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থাকে তা আরও বেশি করে স্বনির্ভর হয়ে ওঠার দিশা দেখাবে। ইসরোর বাণিজ্য বাড়বে। সেই লভ্যাংশ ইসরো আরও বেশি করে খরচ করতে পারবে মহাকাশ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণায়। যা ১৯৯৬ সালে ইসরো প্রথম শুরু করেছিল ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’ প্রকল্পের চিন্তাভাবনা শুরুর মাধ্যমে। আলট্রাভায়োলেট ও এক্স-রে তরঙ্গে জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণার জন্য মহাকাশে এত ভালো অবজারভেটরি আর পাঠাতে পারেনি কোনও দেশই। সেই সময় ইসরো ঠিক করেছিল, নিজেদের আর শুধুই আবহাওয়া ও প্রতিরক্ষা গবেষণায় বেঁধে রাখবে না। নজরদার উপগ্রহ বানানো ও পাঠানো ছাড়াও মহাকাশ গবেষণাতেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকবে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার। সেই পথেই এগচ্ছে ইসরো।
১৯৮৪ সালের ৩ এপ্রিল রুশ মহাকাশযানে চড়ে মহাকাশে দিয়ে নজির গড়েছিলেন ভারতীয় নভশ্চর রাকেশ শর্মা। তিনিই ছিলেন প্রথম ভারতীয় মহাকাশচারী। চার দশক পরে দেশে তৈরি মহাকাশযানে চাপিয়ে ভারতীয় মহাকাশচারীদের মহাকাশে পাঠানোর লক্ষ্য নিয়েছে ইসরো। নাম দেওয়া হয়েছে ‘গগনযান মিশন’। ২০২৫ সালের মধ্যে এই পরিকল্পনা সফল করতে চায় ইসরো। পাশাপাশি, নাসার সঙ্গে যৌথ ভাবে ইসরোর মহাকাশ অভিযানের লক্ষ্যে ‘আর্টেমিস চুক্তি’তে সই করেছে ভারত। সূত্রের খবর, আর কয়েক বছরের মধ্যেই ইসরোর সঙ্গে যৌথ ভাবে মঙ্গল, শুক্র ও চন্দ্রাভিযানে নামবে আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (এসা)-র সঙ্গে এখন যে ধরনের যৌথ মহাকাশ অভিযানে নামে নাসা, ঠিক সেই রকম ভাবেই পরিকাঠামো এবং প্রযুক্তিগত সহযোগিতা গড়ে তোলা হবে ইসরোর সঙ্গে। ভবিষ্যতে চাঁদে কে যাবে, কারা সেখানে গিয়ে খনিজ আনবে বা মহাকাশ স্টেশন বানাবে, সেই সব প্রশ্ন এখনও কেউ তুলছেন না। কিন্তু এখন একবার গিয়ে খুঁটি গেড়ে না এলে পরে এই নিয়ে কোনও আলোচনায় কেউ ভারতকে পাত্তা না-ও দিতে পারে। সেই কথা ভেবেই চন্দ্রযান পাঠানোর তোড়জোড়। এটা নিশ্চিত, এই প্রজন্মের ভারতীয়রা একটা অন্ধকার অতীত পিছনে ফেলে মহাকাশ অভিযানের পথে এগিয়ে চলেছেন। চোখের সামনে তাঁদের শুধু স্বপ্ন আর স্বপ্ন!
এদেশ ভোলেনি ‘মিসাইল ম্যান অব ইন্ডিয়া’ কালামের সেই শিক্ষা: স্বপ্ন পূরণ না হওয়া পর্যন্ত স্বপ্ন দেখে যাও। স্বপ্ন সেটা নয় যা তুমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখ, স্বপ্ন হল সেটাই যা তোমাকে ঘুমোতে দেয় না।