পারিবারিক ধর্মকর্ম পালনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ। সন্তানের কর্মসাফল্যে গর্ব। গবেষণায় অগ্রগতি। ... বিশদ
তোমরা নিশ্চয়ই রূপকথা, নীতিকথার গল্প পড়। অনেকে আবার বাড়ি বড়দের কাছ থেকে গল্পগুলি শোনে। যেমন— ‘কাঠুরে ও জলদেবতা’র গল্প প্রায় সকলেরই জানা। কাঠ কাটতে কাটতে এক গরিব কাঠুরের কুঠারখানি জলে পড়ে গেল। এই ঘটনায় সে কান্নায় ভেঙে পড়ল। এরপর জলদেবতা এসে হাজির হলেন। তিনি গোটা ঘটনা শুনে জলে ডুব দিয়ে একটি সোনার কুঠার নিয়ে এলেন। তারপর আরও খানিকটা গল্পটি রয়েছে। তবে, সোনার কুঠার অর্থাৎ গোটা কুড়ুলটিই সোনা দিয়ে নির্মিত। এত দামি ধাতু দিয়ে তৈরি কুড়ুল, তাও না হয় কল্পনা করা যায়। কিন্তু যদি বলি, একটা সোনার শহর কল্পনা করতে! কী আসবে মাথায়?
সোনার শহর নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সোনায় মোড়া ‘এল ডোরাডো’র ছবি। সোনার তৈরি শহরটিকে ঘিরে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। অনেকেই এল ডোরাডো শহরটি খোঁজার জন্য দীর্ঘদিন অভিযানও চালিয়েছেন। কিন্তু এল ডোরাডোর অস্তিত্ব কি সত্যিই আছে? নাকি সোনার শহর শুধুমাত্র নিছকই কল্পনা? এটি আজও আমাদের কাছে একটি ধূসর রহস্য। তবে, জেনে নেওয়া যাক ‘এল ডোরাডো’ সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য।
এল ডোরাডোর খোঁজ
এল ডোরাডো হল সেই মিথ নগরী, যা সোনা দিয়ে তৈরি বলে মনে করত স্প্যানিশদের মতো অনেকেই। কিন্তু এই নগরীর সন্ধান আজ পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি। আনুমানিক ৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকেই বিভিন্ন নথিতে এল ডোরাডোর কথা ছড়াতে শুরু করে। ষোড়শ শতকে সবচেয়ে বেশি বিস্তার লাভ করে এই মিথ। ধারণা করা হয় হুয়ান মার্তিনেজ (স্প্যানিশ অভিযাত্রী) প্রথম সোনার শহর এল ডোরাডোর কথা জানান। ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দে তিনি মারা যাওয়ার আগে বলে যান দক্ষিণ আমেরিকার গভীর জঙ্গলে রয়েছে একটি অদ্ভুত শহর এবং সেখানে রয়েছে প্রচুর ধনসম্পদ। তিনি আরও বলেন যে, সেই শহরে এত সম্পদ রয়েছে যে পুরো শহরটাই যেন সোনা দিয়ে মোড়ানো। যা সকলের চোখের আড়ালে রয়ে গিয়েছে। আর সেই থেকেই শুরু হয় এই শহরের খোঁজ। এমনকী অনেক অভিযাত্রী দল এই শহরের খোঁজে অভিযান চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছে। ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে অভিযাত্রী কুয়েসাদা দক্ষিণ আমেরিকার ঘন জঙ্গলে ঘেরা গুয়াতাভিতা হ্রদের জল সেচে বেশ কিছু পরিমাণ সোনার টুকরো ও অলঙ্কার পেয়েছিলেন। সেই থেকেই ধারণা করা হয় সোনার শহর এল ডোরাডো হয়তো পাশেই রয়েছে। এরপর ১৫৪১ সালে আরও দুই অভিযাত্রী ফ্রান্সিসকো দেওরেয়ানা এবং গনসারো পিসারো সোনার শহরের খোঁজ চালিয়েও উদ্দেশ্যসাধনে ব্যর্থ হন। এর আরও পরে ১৭৯৯-১৮০৪ সালে আলেকজান্ডার ফন হামবোল্ট সোনার শহরের খোঁজে লম্বা অভিযান চালিয়েও কোনও কিছুরই হদিশ করতে পারেননি। এল ডোরাডোর সন্ধান পেতে গত ১০০ বছরে নানা দেশের সংগঠিত অভিযানই হয়েছে অন্তত ১৪টি। এই অভিযানে ইনকা সভ্যতার অনেক নিদর্শন পাওয়া গেলেও দেখা মেলেনি সেই স্বর্ণনগরীর। আবার অনেক সময়েই ঘন জঙ্গল থেকে বের হতে না পেরে হারিয়ে গিয়েছেন অনেক অভিযাত্রী। ১৯৭১ সালে গহিন জঙ্গলে এইভাবেই হারিয়ে গিয়েছেন ফরাসি এবং মার্কিন একদল অভিযাত্রী। ১৯৯৭ সালে নিশ্চিহ্ন হয়ে যান নরওয়ের অভিযাত্রীরা।
স্বর্ণনগরীর রহস্য
এল ডোরাডোর উৎপত্তির কাহিনি মূলত দক্ষিণ আমেরিকার কলম্বিয়ায় বসবাসকারী মুইসকা সম্প্রদায়ের সঙ্গে জড়িত। ‘এল ডোরাডো’ শব্দটি স্প্যানিশ, যার অর্থ ‘সোনার তৈরি’। মূলত, ‘এল হমব্রে ডোরাডো’ (স্বর্ণখচিত মানুষ) বা ‘এল রেই ডোরাডো’ (স্বর্ণখচিত রাজা) এই শব্দগুলো ব্যবহার করত একটা প্রাচীন উপজাতি। কলম্বিয়ার ‘মুইসকা’ জাতির প্রধান ‘জিপা’-কে বোঝাতেই এই স্প্যানিশ শব্দগুলো ব্যবহৃত হতো। প্রচলিত কাহিনি অনুসারে, ‘মুইসকা’রা রাজ্যাভিষেকের সময় নতুন রাজাকে সোনা দানায় সজ্জিত করে নিয়ে যেত গুয়াতাভিতা নামক একটি হ্রদের কাছে। রাজা সেই হ্রদে ডুব দিয়ে তার শরীরে জড়ানো সোনাদানা বিসর্জন দিত সূর্য দেবতাকে খুশি করতে। আর সেই থেকেই এসেছে ‘এল ডোরাডো’ লোককথা। ‘এল ডোরাডো’-কে নিয়ে লোককথা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। এটি শুরু হয় একটা সোনায় মোড়ানো মানুষ দিয়ে, তারপর সোনার শহর এবং অবশেষে সোনার রাজ্যে পরিগণিত হয়ে পরবর্তীতে এটি সোনার সাম্রাজ্যের লোককথায় পরিণত হয়।
আসলে যে কোনও মিথেরই এইরকম দু’টি প্রান্ত থাকে। একদিকে নৈরাশ্য, অন্যদিকে প্রলোভন। গত শতকের ছয়ের দশক পর্যন্ত এমন সোনালোভীদের দেখা মিলেছে সেখানে। ১৯৬৫ সালে রীতিমতো আইন করে কলম্বিয়া সরকার বন্ধ করে দেয় এই ধরনের বেআইনি অভিযান। গবেষকরা মাঝে মাঝেই নানা চাঞ্চল্যকর দাবি করেন। এমনও বিশ্বাস রয়েছে, সাভানা তৃণভূমির অনেক নীচে নাকি রয়েছে সোনার শহর! তবে এত অভিযান সত্ত্বেও আজও কেউ খুঁজে বের করতে পারেনি এল ডোরাডোকে।
‘সোনার কেল্লা’ সিনেমার একেবারে শেষে ফেলুদা জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘গুপ্তধন নেই। পূর্বজন্ম থাকলেও নেই, না থাকলেও নেই।’ এল ডোরাডোও তেমনই। তা নেই। আর নেই বলেই আরও বেশি করে আছে। ঋত্বিক ঘটকের ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ ছবিতে ছোট্ট ছেলে কাঞ্চন বালিশের নীচে লুকিয়ে রাখত এল ডোরাডো নিয়ে লেখা বই। তারপর সকলের চোখ এড়িয়ে প্রদীপের সামান্য আলোয় গিলে খেত সেই কল্পশহরের বৃত্তান্ত! শিংওলা ইউনিকর্ন কিংবা আগুন-নিঃশ্বাসী ড্রাগনের মতো মানুষের মনের কোণে রয়েছে এল ডোরাডোও। সেই সোনার শহর আজও ঘুমের মধ্যে জেগে ওঠে কল্পনাপ্রবণ মানুষের স্বপ্নে।