পারিবারিক ধর্মকর্ম পালনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ। সন্তানের কর্মসাফল্যে গর্ব। গবেষণায় অগ্রগতি। ... বিশদ
বিনয় মালাকার
চাঁদকে নিয়ে বহুকাল থেকেই মানুষের কল্পনার অন্ত নেই। নানা রূপকথা, গল্পে উঠে এসেছে চাঁদের কথা। কখনও আবার কবি কল্পনা করেছেন পূর্ণিমার চাঁদকে ঝলসানো রুটি হিসেবে। পৃথিবীর বাইরের মহাশূন্যের অসীম অপার রহস্য জানার আগ্রহ মানুষের চিরকালের। চাঁদ পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ এবং সৌর জগতের পঞ্চম বৃহত্তম উপগ্রহ। চাঁদ পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী। চাঁদকে ঘিরে মানুষের কল্পনা ও অন্যরকম একটা অনুভূতি জড়িয়ে আছে সেই একেবারে সৃষ্টিলগ্ন থেকেই।
মানুষের বসবাসের জন্য চাঁদ একেবারেই উপযুক্ত নয়। সেখানে পাতলা একটা বায়ুমণ্ডল আছে। দিনেরবেলায় চাঁদের তাপমাত্রা প্রায় ১৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় মাইনাস ২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চাঁদে বসবাসের জন্য তাই ভয়ানক এক প্রতিকূল পরিস্থিতি। চাঁদের জন্ম, বিবর্তন ও পৃথিবীর উপর চাঁদের প্রভাব নিয়ে বিজ্ঞানীরা নানা গবেষণা করে চলেছেন। এমনকী, চাঁদে মানুষের জন্য আদৌ বাসস্থান তৈরি করা যায় কি না তা নিয়েও ভাবছেন বিজ্ঞানীরা।
পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে চাঁদের কেন্দ্রের গড় দূরত্ব প্রায় ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার ৩৯৯ কিলোমিটার। চাঁদের ব্যাস পৃথিবীর ব্যাসের এক-চতুর্থাংশের চেয়ে সামান্য বেশি। অর্থাৎ চাঁদ পৃথিবীর প্রায় পঞ্চাশ ভাগের এক ভাগ। চন্দ্রপৃষ্ঠে অভিকর্ষ বলের মান পৃথিবী পৃষ্ঠের অভিকর্ষ বলের তুলনায় মাত্র ১৬ শতাংশ। বসবাসের জন্য এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও চাঁদের মাটিতে হেঁটে বেড়ানোর একটা অনুভূতি মানুষ পেতে চায়— আসলে চাঁদ যে মানুষের জন্য এক রহস্যময় উপগ্রহ। আর এই রহস্য উন্মোচনের জন্যই ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘ইসরো’র এবারের প্রচেষ্টা ‘চন্দ্রযান-৩’।
চন্দ্রযান-৩ হল ভারতের তৃতীয় চন্দ্র অনুসন্ধান অভিযান। এর আগে ভারত চন্দ্রযান-১ ও চন্দ্রযান-২ নামের দুটি চন্দ্র অন্বেষণ যান চাঁদে পাঠিয়েছিল। ২০০৮ সালের ২২ অক্টোবর শ্রীহরিকোটা থেকে পিএসএলভি-১১ দ্বারা উৎক্ষেপণ করা হয় চন্দ্রযান-১। এটি সফলভাবে চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করে এবং চাঁদের দক্ষিণমেরুতে জলের অস্তিত্ব সহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য খুঁজে পায়। এটাই চন্দ্রযান-১-এর সবচেয়ে বড় সাফল্য। চন্দ্রযান-১ শুধুমাত্র একটি অরবিটার মিশন ছিল, এতে কোনও ল্যান্ডার বা রোভার ছিল না। অর্থাৎ চন্দ্রযান-১ কিন্তু চাঁদের পৃষ্ঠ স্পর্শ করেনি।
চন্দ্রপৃষ্ঠ স্পর্শ করার লক্ষ্যে ২০১৯ সালের ২২ জুলাই জিএসএলভি মার্ক-৩ রকেট দ্বারা শ্রীহরিকোটা থেকে উৎক্ষেপণ করা হয় চন্দ্রযান-২-কে। আশা ছিল ৬ সেপ্টেম্বর সেটি চন্দ্রপৃষ্ঠ স্পর্শ করবে। সব ঠিকঠাকই ছিল। চন্দ্রযান-২-এর অরবিটারটি সফলভাবে চন্দ্রকক্ষে প্রবেশও করে। কিন্তু ৬ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে অবতরণের ঠিক আগের মুহূর্তে চন্দ্রযান-২-এর ল্যান্ডারটি চাঁদের মাটিতে ভেঙে পড়ে এবং ল্যান্ডারের সঙ্গে ইসরোর যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যান্ত্রিক গোলযোগের কারণেই এই ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করা হয়। অবতরণ যানটি সম্ভবত প্রয়োজনের তুলনায় বেশি গতিতে অবতরণের জন্যই হয়তো ল্যান্ডার ‘বিক্রম’ চাঁদের বুকে আছড়ে পড়ে।
চন্দ্রযান-৩ হল চন্দ্রযান-২-এর উত্তরসূরি। চন্দ্রযান-৩-এ তিনটি মডিউল থাকছে, ক) প্রোপালশন, খ) ল্যান্ডার ও গ) রোভার। এতে কোনও অরবিটার থাকছে না। প্রোপালশন মডিউল মূলত একটি রকেট (জিএসএলভি মার্ক-৩) যা চন্দ্রযান-৩-কে উৎক্ষেপণ করতে সাহায্য করবে। ল্যান্ডারের কাজ হল চাঁদের কক্ষপথ থেকে রোভারকে চন্দ্রপৃষ্ঠে নামিয়ে আনা। রোভার একটি ছয়চাকা যুক্ত রোবটযান। যেটি চন্দ্রপৃষ্ঠে হেঁটে বেড়াবে এবং গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য ও ছবি পৃথিবীপৃষ্ঠে পাঠাবে। রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে প্রতিটি অংশ যুক্ত থাকবে এবং কাজ করবে। চন্দ্রযান-৩-এর জন্য আলাদা করে কোনও অরবিটার পাঠানো হবে না, চন্দ্রযান-২-এর অরবিটার দিয়েই কাজ হবে। যেহেতু চন্দ্রযান-৩-এ কোনও অরবিটার নেই, তাহলে মহাকাশযানটি চন্দ্রকক্ষে প্রবেশ করবে কীভাবে? পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে যখন কোনও মহাকাশযানকে রকেটের মাধ্যমে উৎক্ষেপণ করা হয়, মহাকাশযানটি প্রথমে জিও-সিংক্রোনশ ট্রান্সফার অরবিট (জিটিও)-এ পৌঁছায়। জিটিও কক্ষপথের একটি সংযোগকারী স্টেশনের মতো। এরপর অরবিটার মহাকাশযানটিকে গন্তব্যের দিকে নিয়ে যায়। কিন্তু চন্দ্রযান-৩-এ যেহেতু কোনও অরবিটার থাকছে না, তাই এটির ল্যান্ডার সহ রোভারকে চন্দ্রকক্ষে পৌঁছে দেওয়ার জন্য থাকছে একটি সার্ভিস মডিউল। সার্ভিস মডিউলে থাকবে শুধু জ্বালানি আর ইঞ্জিন। থাকবে না কোনও পে লোড, ক্যামেরা ইত্যাদি। জ্বালানি সহ মহাকাশযানটির ওজন প্রায় আড়াই হাজার কেজি। চন্দ্রযান-৩ এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। চূড়ান্ত পরীক্ষাও হয়ে গিয়েছে। মহাশূন্যে চন্দ্রযানের সমস্ত যন্ত্রপাতি ঠিকমতো কাজ করছে কি না তা দেখার জন্য বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই পরীক্ষা করে দেখে নিয়েছেন এবং ফলাফল সন্তোষজনক ছিল। চন্দ্রযান-৩-কে পৃথিবীর তড়িৎ চুম্বকীয় ক্ষেত্রের বাইরে বেরিয়ে কাজ করতে হবে। মহাকাশের বৃহত্তর তড়িৎ চুম্বকীয় ক্ষেত্রের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে কর্মক্ষমতা বজায় রাখতে হবে এবং চাঁদের তড়িৎ চুম্বকীয় ক্ষেত্র থেকে তথ্য পাঠানোর জন্য সক্রিয় থাকতে হবে। চন্দ্রযান-২-এ যে ভুল হয়েছিল, সেই ভুল যাতে আর না হয় সেদিকে এবার বাড়তি নজর রাখছে ইসরো। তৃতীয় এই চন্দ্র মিশন আরও অনেক বেশি শক্তিশালী। চন্দ্রযান-২-এ শুধু অটো প্রোগ্রামিং ল্যান্ডিং সফটওয়ারই ছিল, ছিল না কোনও ম্যানুয়াল কন্ট্রোল সিস্টেম। চন্দ্রযান-৩-এ বিজ্ঞানীদের হাতে ল্যান্ডিংয়ের জন্য নিয়ন্ত্রণ থাকছে। যদিও রোভার ‘প্রজ্ঞান’ একই রকম থাকছে।
চন্দ্রযান-৩ ভারতের এক স্বপ্নের প্রকল্প। চাঁদের দক্ষিণ মেরু এখনও মানুষের কাছে অনেকটাই অজানা। চাঁদের এই চির-ছায়াচ্ছন্ন অঞ্চলে জলের অস্তিত্ব থাকতে পারে বলেই বিজ্ঞানীরা মনে করছেন। চাঁদের এই মেরুতেই রয়েছে অনেক গহ্বর— সৌরমণ্ডলের প্রাচীনতম জীবাশ্ম এই গর্তগুলি থেকে পাওয়া যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত যতগুলি চন্দ্রাভিযান হয়েছে তার বেশিরভাগই চাঁদের উত্তর মেরু অথবা নিরক্ষীয় অঞ্চলে হয়েছে। অর্থাৎ চাঁদের দক্ষিণ মেরু এখনও পর্যন্ত অনাবিষ্কৃতই থেকে গিয়েছে। এই অঞ্চলের অজানা তথ্যই আবিষ্কার করবে চন্দ্রযান-৩। চাঁদের যে অংশে চন্দ্রযান-২-এর ল্যান্ডার ‘বিক্রম’ নামার চেষ্টা করেছিল, সেইখানেই অবতরণ করানো হবে চন্দ্রযান-৩-কে। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণের জন্য চন্দ্রযান-২-এর সময় লেগেছিল প্রায় ৪৫ দিন। এবার চন্দ্রযান-৩ অবতরণ করতে বেশ কিছুটা কম সময় নেবে। এবারের যাত্রা সফল হলে চাঁদের বুকে অবতরণ করতে পারা চতুর্থ দেশ হবে ভারত (রাশিয়া, আমেরিকা ও চীনের পরে)। চন্দ্রপৃষ্ঠ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা, জল, খনিজ পদার্থের সন্ধান এবং চাঁদে ভূমিকম্প সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করার
জন্যই চন্দ্রযান-৩-কে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে পাঠানো হবে।
চন্দ্রযান-৩ ভবিষ্যতে আরও আন্তঃগ্রহ মিশন অবতরণের জন্য ভারতের ক্ষমতা যাচাই করবে এবং প্রদর্শন করবে। তাই আন্তঃগ্রহ অনুসন্ধানের জন্য চন্দ্রযান-৩ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে। চাঁদের চেয়ে মঙ্গলের পরিবেশ মানুষের বসবাসের জন্য অনেক বেশি উপযোগী বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। কারণ, কার্বন-ডাই-অক্সাইড থেকে শুরু করে নাইট্রোজেন, জল ইত্যাদির পরিমাণ মঙ্গলে অনেক বেশি। মঙ্গল গ্রহে শস্য ফলানোর মতো যথেষ্ট সূর্যালোকও রয়েছে। পৃথিবী থেকে মঙ্গলগ্রহে যেতে এখনকার প্রযুক্তিতে প্রায় আট মাস সময় লাগতে পারে। এই যাত্রাপথের মধ্যে যদি চাঁদে বিরতি নেওয়া যায়, তাহলে সেটা ভালোই হবে। তাই মঙ্গলে যাওয়ার জন্য চাঁদের পরিবেশ সম্পর্কে জানাটা খুব জরুরি। চন্দ্রযান-২-এর ব্যর্থতাকে মুছে দিতেই চন্দ্রযান-৩-কে হাতিয়ার করে নতুন করে আশায় বুক বেঁধে চন্দ্র জয়ের স্বপ্ন দেখছে ইসরো তথা ভারত। মহাকাশে ফের একবার বিপ্লব ঘটাতে চলেছে ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা।
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর)