পারিবারিক ধর্মকর্ম পালনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ। সন্তানের কর্মসাফল্যে গর্ব। গবেষণায় অগ্রগতি। ... বিশদ
স্বয়ংদীপ্ত বাগ
আন্দামান
বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ঝকঝকে নীল সাগরের বুকে সাজানো পান্না সবুজ দ্বীপগুলি। অপার রহস্যে মোড়া। না, শুধু সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য বা প্রাচীন জনজাতি নয়, বেশ কিছু দ্বীপে বিস্ময় বৈচিত্র্যের ডালি সাজিয়েছে নানা ধরনের আগ্নেয়গিরিও।
জীবন্ত আগ্নেয়গিরি:- আন্দামানের ব্যারেন দ্বীপের আগ্নেয়গিরিটি ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র সক্রিয় বা জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। যেটির থেকে নিয়মিতভাবে অগ্ন্যুৎপাত ঘটে চলেছে। এটি উত্তর-পূর্ব ভারত মহাসাগরের ‘সুন্ডা ভলক্যানিক আর্ক সিস্টেম’ বা সুন্ডা আগ্নেয় বলয়ের অন্তর্গত একটি ‘স্ট্র্যাটো ভলক্যানো’ শ্রেণির আগ্নেয়গিরি। অর্থাৎ যে আগ্নেয়গিরিটি স্তরে স্তরে ছাই, লাভা ইত্যাদি জমে শঙ্কুর আকারে গড়ে উঠেছে। পোর্ট ব্লেয়ার থেকে প্রায় ১৩৫ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে, ৩ কিলোমিটার চওড়া দ্বীপভূমির প্রায় ২ কিলোমিটার জুড়েই রয়েছে আগ্নেয়গিরিটির জ্বালামুখ। আগ্নেয়গিরিটি মাটির উপরে ৩৫৪ মিটার এবং মাটির নীচে ২ হাজার ২৫০ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। জ্বালামুখটি তিনদিকে পাথরের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা থাকলেও পশ্চিম দিকটি খোলা। প্রায় ১১ হাজার ৭০০ বছর আগে, ভূতাত্ত্বিক ‘প্লিস্টোসিন যুগ’-এর শেষ দিকে, কোনও বিধ্বংসী অগ্ন্যুৎপাতে এই অংশটি ভেঙে গিয়েছে বলে অনুমান করা হয়। জ্বালামুখের এই খোলা অংশটি দিয়ে আগ্নেয়গিরির জ্বলন্ত লাভা গড়িয়ে সমুদ্রে পড়ে। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে জানা গিয়েছে, ব্যারেন দ্বীপের আগ্নেয়গিরির প্রথম অগ্ন্যুৎপাত হয় প্রায় ১৬ লক্ষ বছর আগে! এরপর দীর্ঘদিন ঘুমিয়ে থাকার পরে আবার সক্রিয় হয় আগ্নেয়গিরিটি। খ্রিস্টপূর্ব আট হাজার বছর আগেও আগ্নেয়গিরিটি বেশ সক্রিয় ছিল। এর পরবর্তী সময়কালটিতে দীর্ঘদিন ঘুমিয়ে থাকার পর আগ্নেয়গিরিটি আবার জেগে ওঠে ১৭৫৭ সালে। তবে ১৮৫২ সালের পর দীর্ঘদিন কোনও অগ্ন্যুৎপাত না হলেও প্রায় ১৫০ বছর পর, ১৯৯১ সালে আবার জেগে ওঠে আগ্নেয়গিরিটি। তারপর থেকে মাঝেমধ্যেই লাভা ও ছাই উগরাচ্ছে। ২০০৫ সালেও অগ্ন্যুত্পাতের ঘটনা ঘটে। ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়া-সুমাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্পের অভিঘাতে প্রলয়ঙ্কর সুনামি ধেয়ে এসেছিল। এর সঙ্গে ২০০৫ সালের অগ্ন্যুত্পাতের ঘটনার সম্পর্ক রয়েছে বলে বিজ্ঞানীদের অনুমান। আগ্নেয়গিরিটি শেষবার সক্রিয় ছিল ২০১৭ সালের ১৫ জানুয়ারি থেকে ১৬ মে-র মধ্যে। সুতরাং সাম্প্রতিক অতীতে বারে বারে মাঝারি থেকে নিচু মাত্রায় ছাই উগরেছে এবং উত্তপ্ত লাভা স্রোত বেরিয়ে এসেছে আগ্নেয়গিরিটির কেন্দ্রীয় প্রধান জ্বালামুখ ও পার্শ্ববর্তী অন্যান্য অপ্রধান জ্বালামুখ থেকে। বন দপ্তরের বিশেষ অনুমতি নিয়ে, দূর থেকে ব্যারেন দ্বীপের জীবন্ত আগ্নেয়গিরিটিকে কিন্তু দেখে আসা যায়। জনশূন্য, প্রায় রুক্ষ, পাথুরে দ্বীপটির প্রতিকূল পরিবেশে এখনও কিছু পাখি, বাদুড়, ইঁদুর ও ছাগলের দেখা মেলে। যদিও কাউকে দ্বীপটিতে নামার অনুমতি দেওয়া হয় না।
সুপ্ত আগ্নেয়গিরি:- ব্যারেন দ্বীপের উত্তরে নারকোন্ডাম দ্বীপেও কিন্তু আন্দামানের আর একটি আগ্নেয়গিরি আছে। নারকোন্ডাম নামটি সম্ভবত এসেছে তামিল শব্দ, ‘নরক-কুণ্ডম’ থেকে। যার অর্থ ‘নরকের গর্ত’! ধূসর থেকে কালো রঙের এক ধরনের লাভাজাত শিলা অ্যান্ডেসাইট দিয়ে তৈরি হয়েছে আগ্নেয়গিরিটি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭১০ মিটার উঁচু এবং সমুদ্র গভীরে ১০০০ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত ভারতের এই দ্বিতীয় আগ্নেয়গিরিটিকে বিজ্ঞানীরা ‘সুপ্ত আগ্নেয়গিরি’ বলছেন। ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যস্থলের অন্তর্গত নারকোন্ডাম দ্বীপটি পরিবেশের যেন এক জীবন্ত ল্যাবরেটরি! এখানে দেখা মেলে নানা বিরল প্রজাতির প্রাণীর। এদের মধ্যে ‘নারকোন্ডাম হর্নবিল’ পাখিটিকে এই গ্রহে কেবলমাত্র নারকোন্ডাম দ্বীপেই দেখতে পাওয়া যায়।
কাদার আগ্নেয়গিরি:- আন্দামানে কিন্তু আরও একধরনের আগ্নেয়গিরি রয়েছে। এগুলিকে বলে ‘মাড ভলক্যানো’ বা কাদার আগ্নেয়গিরি। ভারতে একমাত্র আন্দামানেই এরকম বিরল প্রকৃতির আগ্নেয়গিরি দেখতে পাওয়া যায়।
স্থানীয় মানুষেরা এগুলিকে ‘জলকি’ বলে থাকেন। এখনও পর্যন্ত মধ্য আন্দামানের বারাটাং অঞ্চলে ১৩টি এবং উত্তর আন্দামানের দিগলিপুর অঞ্চলে ১১টি কাদার আগ্নেয়গিরি চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। এর সবক’টিই সক্রিয় আগ্নেয়গিরি। তবে গনগনে লাভা, ছাই ইত্যাদির পরিবর্তে এগুলি থেকে বেরিয়ে আসে কাদা, জল ও গ্যাস। তাই বিপজ্জনক হলেও কাদার আগ্নেয়গিরিগুলির খুব কাছাকাছি যাওয়া যায় পর্যবেক্ষণের জন্য। ভারী অদ্ভুত এখানকার দৃশ্য। বিস্তীর্ণ জঙ্গলের মধ্যে মাঝে মাঝে কিছুটা এলাকা কাদায় ঢাকা। এর মধ্যে কোনও কোনও কাদার আগ্নেয়গিরি ৩০ মিটারের বেশি ব্যাস নিয়ে এবং ২ থেকে ৩ মিটার উঁচু হয়ে বৃত্তাকার ঢিপি তৈরি করেছে। শঙ্কু আকৃতির ছোট ঢিপির মাঝখানে সিমেন্ট রঙা থকথকে কাদার ভিতর থেকে অনবরত বেরিয়ে আসছে গ্যাসের বুদবুদ। তবে আন্দামানে প্রতি বছর ভারী বৃষ্টিপাত কাদার আগ্নেয়গিরিগুলির উচ্চতা ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জ্যামিতিক আকৃতি অনেকটাই ধুয়ে দেয়। যাইহোক, দিগলিপুরের কাদার আগ্নেয়গিরিতে কাদা বেরনোর সময় একধরনের অস্বাভাবিক গুড়গুড় আওয়াজ শোনা যায়। যা বারাটাং-এর আগ্নেয়গিরিতে শোনা যায় না।
তবে, ‘আমেরিকান জিওফিজিক্যাল ইউনিয়ন’-এর ‘জার্নাল অব জিওফিজিক্যাল রিসার্চ’ থেকে জানা যাচ্ছে যে, ভূ-অভ্যন্তরের কোনও একটি ‘ম্যাগমা সুড়ঙ্গ’ (অগ্ন্যুৎপাতের রসদবাহী নালী) থেকে এই কাদার আগ্নেয়গিরিগুলি কোনওভাবে ‘রিচার্জড’ বা পুনরুজ্জীবিত হয়ে গেলে প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে।