পারিবারিক ধর্মকর্ম পালনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ। সন্তানের কর্মসাফল্যে গর্ব। গবেষণায় অগ্রগতি। ... বিশদ
—জানলা বন্ধ করে রাখলেই হয়!
সোমুর কথায় উত্তেজিত হয়ে বাচ্চু বলল, ‘ছোট্ট রান্নাঘর। জানলা বন্ধ করে রাখলে মায়ের দমবন্ধ হয়ে যাবে না! তার চেয়ে চল দোলা আন্টির ফ্ল্যাটে যাই। সেদিন রাস্তায় তেলকালি মাখা কান কাটা হুলোটাকে খুব আদর করছিল আন্টি। গায়ে হাত বুলিয়ে বলছিল সুইট বেবি। ইউ আর সো কিউট।’
সোমু ভরসা পেল একটু। বলল, ‘তাহলে চল আগে গিয়ে আন্টির সঙ্গে কথা বলি।’
আন্টির বাড়ি এই গলির একেবারে পিছনের দিকে। মাঠের পাশেই একটা অভিজাত আবাসন পর্ণশ্রী, সেখানেই একটা ফ্ল্যাটে দোলা
আন্টি থাকে।
ফ্ল্যাটের বেল বাজাতে দোলা আন্টিই দরজা খুলে দিল।
ঘরের ভেতরটা খুব সুন্দর। দারুণ সাজানো। সোমুর কেন জানি না মনে হল দোলা আন্টি কিছুতেই বেড়াল বাচ্চা নেবে না। বাচ্চুটা বেশ স্মার্ট। চট করে কাজের কথায় এল।
‘আন্টি, সোমুদের গ্যারেজে বেড়ালের দুটো কিউট বাচ্চা হয়েছে।’ ‘কিউট’ কথাটার উপরে যতটা পারা যায় জোর দিল বাচ্চু। ‘গায়ের রং তুলোর মতো সাদা। মাঝেমাঝে কালোর ছিটেফোঁটা আছে।’
—ওমা! সো কিউট!
—হ্যাঁ, আন্টি খুবই কিউট। আপনি ছানা দুটোকে পুষবেন? আপনি রাজি থাকলে আমরা এক্ষুনি বাচ্চা দুটোকে এনে দেব।
—ওহ্ মাই গড! আমি কীভাবে নেব সোনা! মর্নিংয়ে অফিস বেরিয়ে যাই, ফিরি সেই সন্ধেবেলা। কে দেখবে ওদের? বেবিদের অনেক যত্ন দরকার। বুঝলে সোনারা!
আন্টি অফিস যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে দেখেই বুঝতে পারল ওরা। বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই দেখল আন্টি একটা সুন্দর প্লেটে অনেকরকমের বিস্কুট আর সন্দেশ এনে চমৎকার কাঠের কাজ করা টেবিলটার উপরে রাখল। ‘এগুলো খেয়ে নাও সোনারা। কোন ক্লাসে
পড় তোমরা?’
বাচ্চু বলল, ‘আমরা দু’জনেই ক্লাস সিক্সে পড়ি। আমরা খুব ভালো বন্ধু।’ শেষের কথাটা বলার প্রয়োজন ছিল না। তবুও আপনা থেকেই বেরিয়ে এল। সত্যিই তো ওরা খুব ভালো বন্ধু। একসঙ্গে স্কুল যায়, একসঙ্গে ফেরে। মাঠে ফুটবল, ক্রিকেট খেলতেও একইসঙ্গে যায়। দুর্গাপুজোর সময় প্রতি বছর আশপাশের ঠাকুরগুলো দেখতে ওরা একসঙ্গে বেরয়। জামা-প্যান্টও প্রায় অনেকটা একইরকমের কেনে ওরা।
বিস্কুট মিষ্টি খেয়ে দোলা আন্টির ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এল সোমু ও বাচ্চু। বাচ্চু বলল, ‘চল একবার বেড়ালের বাচ্চা দুটোকে দেখে আসি। বাচ্চা দুটোর মাটা কি ওখানে আছে?’
‘নেই। বাচ্চা দুটোকে রেখে কোথায় যেন হাপিশ হয়ে গিয়েছে! ভীষণ চেঁচাচ্ছে বাচ্চা দুটো। হরলিকস বিস্কুট গুঁড়ো করে দিয়েছিলাম, খায়নি। আমাদের ড্রাইভার কাকু বলল দুধ দিতে। গুঁড়ো দুধ জল দিয়ে গুলে দিলে নাকি খাবে! আমি কি ছাই জানি কোথায় গুঁড়ো দুধ থাকে! মা তো ওসব লুকিয়ে রাখে! চায়ের জন্য একটা ডেগচিতে দুধ ছিল, একটা কাপে কিছুটা তুলে নিয়ে এসে বাচ্চা দুটোর সামনে রেখে এসেছি।’
বাচ্চু হাসল। বলল, ‘তুই একটা মাথামোটা। ওই টুকুনি বাচ্চা কী করে কাপ থেকে দুধ খাবে? ওদের খাইয়ে দিতে হবে। আমাদের কোকোকে একেবারে এতটুকুনি বয়সে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনেছিল দিদি। ড্রেনের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। ওর জন্য মিল্ক কিনে আনা হতো। কুকুর বেড়ালদের জন্য আলাদা রকম মিল্ক কিনতে পাওয়া যায়।’
সোমুদের গ্যারাজে গিয়ে দেখা গেল বাচ্চা দুটো দুধের কাপটাকে কাত করে ফেলে দিয়েছে। খেয়েছে কি না বোঝা যাচ্ছে না! বাচ্চা দুটো নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে।
‘কী সুন্দর দেখতে রে সোমু!’
‘তুই বাড়ি নিয়ে যা। কোকোর সঙ্গে থাকবে,’ সোমু বলল।
ধমকে উঠল বাচ্চু। ‘কোকো আজকাল ভীষণ দুষ্টু হয়েছে। আমাদের সোফা, দরজার পর্দা ছিঁড়ে ফর্দাফাই করে দিয়েছে। বাবার একজোড়া দামি জুতোর অর্ধেকটা খেয়ে ফেলেছে। মায়ের ফোনের চার্জারটা অক্ষত নেই। এরমধ্যে দুটো বেড়াল বাচ্চা নিয়ে গেলে কী হবে ভেবে দেখেছিস! দাঁড়া রুমালটা জলে ভিজিয়ে একটু জল খাওয়াই ওদের।’ উঠোনের কল খুলে রুমাল ভিজিয়ে এনে বাচ্চা দুটোর মুখে ধরতেই বাচ্চা দুটো ভেজা রুমাল চাটতে শুরু করল।
বাচ্চু উৎসাহের চোটে চিৎকার করে উঠল, ‘সোমু খাচ্ছে খাচ্ছে!’
সোমু হাঁটু মুড়ে বাচ্চুর পাশে বসে পড়ল।
বাচ্চু বলল, ‘আর একটু দুধ নিয়ে আয় না!’
সোমু আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বলল, ‘আর সম্ভব না। ওই যে কাত হয়ে যাওয়া কাপের তলায় যেটুকু আছে, ওইটুকু খাওয়া। কাল আবার আনব।’
কাপে খুব সামান্যই দুধ ছিল। রুমালটা দুধের মধ্যে ভিজিয়ে বেড়ালছানা দুটোর মুখে ধরতেই চুক চুক করে খেতে শুরু করল ওরা।
‘দেখলি খিদে কী জিনিস! কীসের দুধ, কে দিচ্ছে এসবের আর ধার ধারল না বাচ্চা দুটো,’ বাচ্চু বিজ্ঞের মতো কথাগুলো বলল।
বাচ্চা দুটো গ্যারেজের একটা কোণে গিয়ে একে ওপরের গায়ে গা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। সোমু ও বাচ্চু ঘুমন্ত ছানা দুটোর দিকে অনেকক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তার পাশে একটা বড় জামগাছের নীচে দাঁড়াল দু’জনে। গরমে চারদিক পুড়ে গেলেও জামগাছের তলাটা বেশ শীতল। গাছের নীচে পাকা জাম ফেটে পড়ে আছে। যে যে জায়গায় জাম থেঁতলে পড়েছে, সেই জায়গার মাটিটুকু জামরঙা হয়ে গিয়েছে। অসংখ্য পাখির কলকাকলিতে জায়গাটা সরগরম হয়ে আছে। বেড়াল ছানা দুটোকে নিয়ে কী করা যায় সেটা নিয়েই দুই বন্ধু আলোচনা করতে লাগল।
সোমু বাচ্চুকে বলল, ‘তোর দিদির তো স্মার্ট ফোন আছে! বাচ্চা দুটোর ছবি তুলে ফেসবুকে একটা পোস্ট দিলে কেউ না কেউ নিশ্চয় নিয়ে নেবে! এই দুনিয়ায় অনেকে ক্যাট লাভার আছে।’
‘হ্যাঁ দোলা আন্টির মতো ক্যাট লাভার! সবাই মুখে বলবে হাউ সুইট! কিউট বেবি! কিন্তু কেউ বাড়িতে রাখবে না। তাছাড়া দিদির এখন সেমেস্টারের পরীক্ষা চলছে। মা দিদির কাছ থেকে ফোন কেড়ে নিয়েছে।’
বাচ্চুর কথায় সোমু হতাশ হয়ে বলল, ‘তাহলে কী হবে? বাচ্চা দুটোকে কি কোনওভাবেই বাঁচানো যাবে না?’
বাচ্চু বলল, ‘একটা কাজ করলে হয়। ওই চারমাথার মোড়ে একটা পাগল থাকে দেখেছিস?’
‘যে এই প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও কম্বল গায়ে দিয়ে থাকে! হ্যাঁ দেখেছি,’ সোমু উদগ্রীব
হয়ে বলল।
‘আশপাশের দোকানদাররা পলিথিনে করে খাবার দিয়ে যায়।’
‘হ্যাঁ । ঠিক।’
‘ওই পাগলটার সঙ্গে অনেক ক’টা কুকুর-বেড়াল থাকে। একই পলিথিন থেকে খাবার খায়। বাচ্চা দুটোকে ওখানে ছেড়ে দিয়ে
এলে হয়!’
সোমু বলল, ‘তা কী করে হয়! ছানা দুটো তো ভীষণই ছোট! রাস্তার কুকুরগুলো ওদের মেরে ফেলবে। ভগবান বলে কেউ নেই মনে হয়! ভগবান থাকলে ওইটুকুনি বাচ্চাদের এত কষ্ট পেতে হতো না। ওদের তো কোনও দোষ নেই! তবুও কষ্ট পাচ্ছে। আমার ঠাম্মা বলে ভগবান নেই। থাকলে বিনা দোষে কাকাইকে এত শাস্তি পেতে হতো না!’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোমু।
এমন সময়ে ডাক্তার জেঠুর বাড়ি থেকে কাজকাম সেরে কমলিকে বেরতে দেখা যায়। এই পাড়ার অনেক ক’টা বাড়িতে বাসনমাজা আর কাপড় কাচার কাজ করে কমলি। অন্যদিন আরও সকালে তার কাজ হয়ে যায়। রবিবার বলে একটু দেরি করে আসে আর দেরি করে বাড়ি যায়।
জামগাছতলায় দুই বন্ধুকে দেখে কমলি বলল, ‘দুই বন্ধুতে মিইলে কী এত শলাপরামর্শ হচ্ছে শুনি! গভীর সমস্যা মুনে হচ্ছে!’
‘হ্যাঁ, কমলিদি খুব সমস্যা,’ বাচ্চু বলল।
‘আমাকে বুলা যাবে?’
সোমু বলল, ‘তুমি কি কিছু করতে
পারবে কমলিদি?’
‘আগে সমস্যাটা শুনি।’
সোমু কমলির হাত ধরে টানতে টানতে গ্যারেজের ভেতর নিয়ে গিয়ে বাচ্চা দুটোকে দেখিয়ে বলল, ‘এই যে প্রবলেম!’
‘উ মা! কী সুন্দর বাচ্চাগো। ইয়াদের
মা কুথায়?’
বাচ্চু বলল, ‘জানি না। তাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না!’
‘ইস! অতটুন বাচ্চা মা ছাড়া কী করে থাইকবে!’
একটু চুপ হয়ে গেল কমলি। হঠাৎ কমলির দু’চোখের তারায় খুশির ঝিলিক ছলকে উঠল। বলল, ‘আমার বাড়ির বিড়ালটার একটা বাচ্চা হয়েছিল! বেশ এত্ত বড় হয়েছিল। গেল হপ্তায় কিড়মির বিমারিতে মরে গেল বাচ্চাটা। আমার বিড়ালটা এখুনো কেঁদে কেঁদে বেড়ায়! আমি এই দুটোকে লিয়ে যাব। আমার বিড়ালটা খুশ
হয়ে যাবে।’
‘অন্য বেড়ালের বাচ্চাকে তোমার বেড়াল কেন নেবে কমলিদি?’ সোমু জিজ্ঞেস করল।
‘লেবে। মায়ের জাত যে! ও তুমরা বুজবা না। ... যাও দিকি একটা ঝুড়ি লিয়ে এসো। উয়াতে করে বাচ্ছা দুটোরে নে যাব।’
সোমু আর বাচ্চু লাফাতে লাফাতে ঝুড়ি জোগাড় করতে গেল। বাচ্চু সোমুর ঘাড়ে হাত দিয়ে বলল, ‘দেখলি! ভগবান আছেন।’