পুরনো রোগের বৃদ্ধিতে স্বাস্থ্যহানির সম্ভাবনা। ব্যবসায় শুভত্ব বজায় থাকবে। আর্থিক প্রগতিও হবে। ... বিশদ
২ জুন, শুক্রবার। সন্ধ্যাতেও নিউজ রুমে ছিলাম। যথারীতি তুমুল ব্যস্ততার মধ্যে। এমন সময় একটা ফোন এল চিফ রিপোর্টারের কাছে। মেদিনীপুর থেকে আমাদের সাংবাদিক পিনাকী ধোলে—‘দাদা, বালেশ্বরে বড় রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে... শুনছি, করমণ্ডল এক্সপ্রেসের সঙ্গে একটা মালগাড়ির মুখোমুখি ধাক্কা লেগেছে। অনেক লোক মারা যেতে পারে। আমি বেরিয়ে পড়ছি।’ মুহূর্তে বদলে গিয়েছিল নিউজ রুমের ছবিটা। সিনিয়র সাংবাদিকরা ফোনাফুনি শুরু করলেন। কিছুক্ষণ পর আমাকে ডাকা হল। বলা হল, প্রস্তুত হয়ে নাও। যেতে হবে।
বাড়িতে একবার ঢুঁ মারারও সুযোগ মিলল না। পাঁচ-দশ মিনিটের মধ্যে অফিসের গাড়ি আমাকে নিয়ে রওনা হল। গন্তব্য হো চি মিন সরণির এমএলএ হস্টেল। খবর পেয়েছি, রাজ্যের মন্ত্রী মানস ভুঁইয়া তখন ওখানেই রয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে তাঁর ঘটনাস্থলে যাওয়ার কথা। বরাতজোরে তাঁর কনভয়েই একটা জায়গা হয়ে গেল। মন্ত্রীকে অনুরোধ করে চড়ে বসলাম নিরাপত্তারক্ষীদের গাড়িতে। ততক্ষণে অফিস থেকে ফোন এসে গিয়েছে, ‘পিনাকী বালেশ্বর রওনা হয়ে গিয়েছে। ওর সঙ্গে যোগাযোগ কর।’
কোলাঘাট পেরিয়ে ঝড়ের গতিতে এগচ্ছে কনভয়। পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতন, জলেশ্বর হয়ে বালেশ্বরগামী রাস্তা ধরব। আমাদের বেশ কিছুটা আগে কয়েকজন রিপোর্টারের সঙ্গে একটি গাড়িতে রয়েছে পিনাকী। কিন্তু পৌঁছতে পারেনি। রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ ফোন করে জানাল, ওরা জলেশ্বর ছাড়িয়ে এগিয়ে গিয়েছে। আর ওদের গাড়ির সামনে-পিছনে নাকি ছুটে চলেছে অনেক অ্যাম্বুলেন্স। ততক্ষণে সবার জানা হয়ে গিয়েছে, বালেশ্বরের কিছুটা দূরে বাহানাগা বাজার স্টেশনের কাছে ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনার কথা। দু’টি নয়, তিনটি ট্রেন দুর্ঘটনার কবলে। যশবন্তপুর-হাওড়া এক্সপ্রেসেরও দু’টি বগি লাইনচ্যুত। অন্তত ১০০ জন মারা গিয়েছেন। জখম অসংখ্য। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে বাংলা থেকে অ্যাম্বুলেন্স পাঠানো হচ্ছে। ঘটনাস্থলে পৌঁছে গিয়েছে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী, এনডিআরএফ সহ উদ্ধারকারীরা।
রাত সাড়ে ১২টা নাগাদই বালেশ্বর ছাড়িয়ে বাহানাগা পৌঁছে যায় পিনাকীরা। নিয়মিত যোগাযোগ রেখে গিয়েছি দু’জনে। আমাদের পৌঁছতে তখনও ঘণ্টাখানেক দেরি। পিনাকী জানাল, ‘জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের কাজ চলছে। সেই জন্য জায়গায় জায়গায় যান নিয়ন্ত্রণ ও ডাইভারশন করা হয়েছে। আমরা অ্যাম্বুলেন্সগুলির পিছু নিয়েছিলাম দ্রুত বেরিয়ে যাওয়ার জন্য।’ অ্যাম্বুলেন্স, পুলিসের গাড়ি, স্থানীয় মানুষের স্রোত দেখে ঘটনাস্থল চিনতে ওদেক দেরি হয়নি। একপ্রস্থ ধারাবিবরণী শুনে নিলাম পিনাকীর থেকে—‘জাতীয় সড়কের উপরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে হেঁটে যেতে বলল পুলিস। ২০০ মিটার মতো হাঁটলেই বাহানাগা বাজার লেভেল ক্রসিংয়ের কাছে ঘটেছে ঘটনাটা। গাড়ি থেকে নেমে বাঁ দিকের সরু পিচ রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম দাদা। দেখি রাস্তার নীচে সাদা কাপড় ঢাকা দিয়ে রাখা আছে একের পর এক নিথর দেহ। কোনও কোনওটি থেকে পা বেরিয়ে আছে। ঢাকা দেওয়া সাদা কাপড়ের জায়গায় জায়গায় রক্তের ছোপ।’ বেশিক্ষণ ওর কথা শুনতে পারিনি। শিউরে উঠেছি। পিনাকী পরে জানায়, ওই জায়গাটা থেকে আরও কয়েক পা এগিয়ে অপেক্ষা করছিল হাড়হিম করা একটা দৃশ্য। একটি ম্যাটাডরে নাকি আলুর বস্তার মতো করে ছুড়ে ছুড়ে ফেলা হচ্ছিল একের পর এক ডেডবডি। আর চারদিকে বুকফাটা চিৎকার। এক ঝলক ওর মনে হয়েছিল, মৃত্যুপুরীরর প্রবেশদ্বার বোধ হয় এমনই হয়!
প্রাথমিক ঘোর কাটিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল পিনাকীরা। তারপর যে দৃশ্য ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল, সেটা কারও বিশ্বাস হবে না। পিনাকীর জবানিতে, ‘জেনারেটরের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনকে কেউ যেন দেশলাই বাক্সের মতো তুলে এনে বসিয়ে দিয়েছে মালগাড়ির উপর। রেললাইন, কংক্রিটের স্লিপার সব ভেঙে চুরমার। এদিক-ওদিক থেকে তখনও ভেসে আসছে গোঙানি, বেঁচে থাকার জন্য শেষ আর্তনাদ। একের পর এক কামরা হেলে বা উল্টে পড়ে রয়েছে রেললাইন বরাবর। প্রচুর ব্যাগ ছড়িয়ে। লাইনের উপর পড়ে রয়েছে রক্তমাখা বিরিয়ানি, রুটি। কোনও শিশুর এক পাটি জুতো আর খেলার পুতুল পড়ে রয়েছে পাশাপাশি। এলোমেলো রয়েছে ঢাউস সাইজের অজস্র ব্যাগ—যা নিয়ে হয়তো ভিন রাজ্যে ভাগ্য ফেরাতে যাচ্ছিলেন কোনও হতভাগ্য তরুণ। উল্টে যাওয়া কামরাগুলির জানালা থেকে ঝুলছে বিচ্ছিন্ন হাত, কাটা পা। এনডিআরএফ, সেনাকর্মী, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হাজার হাজার উদ্ধারকারীর ছোটাছুটি করছেন। গ্যাস কাটার দিয়ে বগি কেটে দেহ উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। কর্কশ শব্দের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে পোড়া মাংসের গন্ধ।’
রাত দেড়টা নাগাদ আমরাও ঢুকে যাই ঘটনাস্থলে। সহকর্মী ফোনে যতটা জানাতে পেরেছিল, তা চোখে দেখার পর যেন বীভৎসতা টের পাওয়া গেল। ম্যাটাডরে মৃতদেহ তুলতে দেখে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ওড়িশা পুলিসের এক কর্মীকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘মৃতদেহগুলি কোথায় রাখা হচ্ছে?’ তিনি জানালেন, আপাতত এক কিলোমিটার দূরে একটি স্কুলে রাখা হচ্ছে সেগুলিকে। অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজে কান পাতা যাচ্ছে না। কোথা থেকে যেন বিশাল বিশাল ক্রেন আনা হয়েছে। আমাদের বেশি এগতে দেওয়া হল না। এক জায়গায় দাঁড়িয়েই কেটে গেল বাকি রাত।
শনিবার ভোরের আলো ফোটার আগেই হেঁটে পৌঁছে গেলাম সেই স্কুলে। সেখানকার ভিড় যেন দুর্ঘটনাস্থলের লোকসংখ্যাকেও হার মানাবে। দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনে যাঁদের পরিজন ছিলেন, কিন্তু তখনও খোঁজ পাননি, এরকম বহু মানুষ দিশেহারা হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন। স্কুলের একটি ঘরে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছে দেহগুলি। কোনও এক অসহায় বাবা একটার পর একটা দেহের মুখের ঢাকনা সরিয়ে খুঁজছিলেন সন্তানকে!
সকাল হতে বাড়ল নেতামন্ত্রীদের আনাগোনা। দিনের আলোয় ঘটনার ভয়াবহতা আরও স্পষ্ট হল। তখনও চলছে দেহ উদ্ধার। বেলাইন কামরা থেকে বেরিয়ে আসছে থেঁতলে যাওয়া বিকৃত দেহ। মৃত্যুর সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, কেউ নিশ্চিত বলতে পারছে না। সেই সঙ্গে শুরু হয়েছে ক্রেন দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বগিগুলি সরিয়ে লাইন পরিষ্কার করার কাজ। আওয়াজে কান পাতা যাচ্ছে না। কামরার ভিতরে পড়ে থাকা দেহ বা দেহাংশে পচন ধরেছে। উদ্ধারকারীদের অনেকে নাকে রুমাল বেঁধে কাজ করছেন। আরও একবার গেলাম বাহানাগা হাইস্কুলের ‘লাশকাটা ঘরের’ দিকে। ওড়িশা সরকারের তরফে দেহগুলির ময়নাতদন্ত করে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছিল ভুবনেশ্বর, কটক, বালেশ্বরের বিভিন্ন হাসপাতাল বা পুলিস মর্গে। কারণ, স্বাভাবিকভাবেই স্কুলে মৃতদেহ সংরক্ষণের কোনও ব্যবস্থা ছিল না। ভিড়ে মিশে থাকা স্থানীয় বাসিন্দারা তখন রেল দুর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণে মগ্ন। কেউ বলছেন, সিগন্যাল ছিল না। কেউ বলছেন, মোটরম্যানের দোষ। তবে শত জল্পনা ছাপিয়ে বারবার ভেসে আসছিল স্বজনহারার গগনবিদারী কান্না। এমন এক জায়গায় নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকাও যেন এক কঠিন পরীক্ষা!