পুরনো রোগের বৃদ্ধিতে স্বাস্থ্যহানির সম্ভাবনা। ব্যবসায় শুভত্ব বজায় থাকবে। আর্থিক প্রগতিও হবে। ... বিশদ
৩ জুন, শনিবার। ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে ৯টা। লেভেল ক্রসিংয়ের দিকে এগিয়েই চোখে পড়ল রেললাইনের উপর কামরার ধ্বংসস্তূপ। কালো স্টোন চিপসের গায়ে ‘মৃত্যুর দাগ’। চাপ চাপ জমাট বাধা রক্ত। ছড়িয়ে রয়েছে ছেঁড়া ব্যাগ, জুতো, রক্তে ভেজা জামা, ভাঙা খেলনা, বই, খাতা, খাবারের প্যাকেট, মুড়ি আরও কত কী! দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া বগির স্তূপ সরিয়ে চলছে মৃতদেহের খোঁজ। তখনও পর্যন্ত সরকারিভাবে মৃতের সংখ্যা ২৮৮। জখম ৮০৩।
৪ জুন, রবিবারের সকাল ৭টা। ঘটনাস্থল ঘিরে ফেলেছে রেলের নিরাপত্তারক্ষী। ঢোকার মুখে দড়ির ব্যারিকেড। প্রবেশ নিষেধ। কেন? চলছে লাইন মেরামতির কাজ। সঙ্গে ভিআইপি মুভমেন্ট! দেখলাম, সেখানে দাঁড়িয়ে আকুতি-মিনতি করছেন অনেকেই। তাঁরা সবাই নিখোঁজ যাত্রীদের পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-পরিজন। ঘামে ভেজা মুখ। চোখভর্তি জল। করজোড়ে তাঁরা বলে যাচ্ছেন, ‘স্যার, একবার ভিতরে যেতে দিন’। কিন্তু, নিরাপত্তারক্ষীরাও নিরুপায়। সকলকে একই জবাব দিয়ে যাচ্ছেন তারা। বলছে, ‘আন্দার জানে কা পার্মিশন নেহি হে’!
কাঁদতে কাঁদতে বাহানাগা হাইস্কুলে এসে ধুলোর উপর বসে পড়লেন ভাগলপুরের এক যুবক। হাত-পা কাঁপছে তাঁর। মুঠোর মধ্যে ছোট্ট একটা সাদা চিরকুট। কী আছে ওতে? আমার প্রশ্ন শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকালেন। মুঠো খুলে দেখালেন তিনি। তাতে লেখা চারটি নাম। এক ভাই ও তিন ভাইপোর। চারজনই ‘নিখোঁজ’! পাশেই সত্ত্বোর্ধ এক মায়ের কান্না থামাতে পারছেন না কেউ। করমণ্ডলে কলকাতা থেকে কটকে ফেরার কথা ছিল তাঁর ছেলের। যিনি ছিলেন সংসারের একমাত্র ভরসা, তিনিই ‘নিখোঁজ’।
তীরের ফলার মতো মাথার উপর তখন চড়া রোদ। আঁচল লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে। জ্ঞান হারাবার আগে চোখ মুদে আসছিল সেই বৃদ্ধার। মাটিতে পড়ে যাওয়ার আগে হঠাৎ, এক পুলিসকর্মী জাপটে ধরলেন তাঁকে। ডায়েরি, পেন রেখে ব্যাগ থেকে বের করে দিলাম আমার জলের বোতল। হুঁশ ফিরল মায়ের। ‘আপনার ছেলে ফিরে আসবে দিদি’, শান্ত্বনা দিচ্ছিলেন স্কুলের শিক্ষিকারা। তবে, এইরকম হাজার দৃশ্যে নিজেদের চোখের জল আড়াল করতে পারছিলেন না তাঁরাও। ক্লাসরুমের আড়ালে কেউ আঁচলে, কেউ ওড়নায় মুছে নিচ্ছিলেন চোখের জল।
বাগানাগা বাজারের পাশেই লম্বা হাইওয়ে। তার ধারেই নারকেল গাছ ঘেরা বাহানাগা হাইস্কুল। সেখানে তৈরি হয়েছিল অস্থায়ী মর্গ। ক্লাসঘরে মৃতদেহের স্তূপ। পচন শুরু হওয়ায় শনিবার রাতেই দেহ সরানো হয় ভুবনেশ্বর এইমস-এ। কিন্তু, প্রিয়জনকে খুঁজতে রবিবারও ভিড় হাইস্কুলে। অসহায় বাবা এসেছেন সন্তানের ছবি হাতে, মা খুঁজছেন ছেলেকে, দুধের শিশু কোলে এক কাপড়ে দিনরাত ঘুরছেন উদভ্রান্ত স্ত্রী। কিন্তু, কারওর খোঁজ নেই। জীবিত না মৃত সেই উত্তরও দিত পারছেন না কেউ। বাহানাগা থেকে বালেশ্বর, সরো থেকে ভুবনেশ্বর, কটক, সমস্ত হাসপাতালের দরজায় দরজায় এক ছবি। স্বজনহারা কান্নার রোল। ওইদিন রাতেই বালেশ্বর জেলা প্রশাসনের দেওয়া মৃত্যুর রিপোর্ট প্রকাশ করল রেল। ২৮৮ থেকে কমে গিয়ে হল ২৭৫! ততক্ষণে দুর্ঘটনার ৫১ ঘণ্টা সময় অতিক্রান্ত। রেলমন্ত্রীর উপস্থিতিতে চাকা গড়াল মালগাড়ির।
৫ জুন, সোমবার হোটেল থেকে বেরিয়ে সাত সকালেই পৌঁছলাম বাহানাগা বাজার স্টেশনে। ছোট্ট টিকিট কাউন্টার। ক্যামেরার ফ্ল্যাসের ঝলকানি। লাইন মেরামতি প্রায় সম্পন্ন। ধীর গতিতে একে একে ভুবনেশ্বর-নয়া দিল্লি রাজধানী, হাওড়া-পুরী বন্দে ভারত এক্সপ্রেস সহ চলতে শুরু করেছে একাধিক দূরপাল্লার ট্রেন। ভিতরে গুটি কয়েক যাত্রী। বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন জানালার দিকে। উল্টে পড়ে থাকা ভাঙাচোরা বগিগুলি দেখে শিউরে উঠছিলেন তাঁরা। কেউ কেউ নমস্কার করে বলে উঠলেন, ‘জয় জগন্নাথ, রক্ষা করো’।
সেদিন দুর্ঘটনাস্থলে ঢুকতে আটকানো হল সাংবাদিকদেরও। ধ্বংসস্তূপের ছবি আড়াল করতে রেললাইনের দু’পাশে টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল সবুজ পর্দা। মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে টানাপোড়েন চলছিলই। পর্দা দেওয়ার পর বেশিরভাগ এলাকার বহু মানুষ জ্বলে উঠলেন তেলে-বেগুনে। তাঁদের প্রশ্ন, কীসের এত ‘লুকোচুরি’? হাইওয়ের ধারে অখ্যাত এলাকা বাহানাগা। সরল সাধারণ মানুষজন। অল্প দূরত্বেই বাগদা বীচ, চাঁদিপুর বিচ, পঞ্চ লিঙ্গেশ্বর মন্দির। শুক্রবারের আগেও বাহানাগা ছিল অচেনা একটা গ্রাম। এক দুর্ঘটনা বদলে দিয়েছে এলাকার ছবি। প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী সহ ঝাঁকঝাঁক ভিভিআইপিদের চলছে যাতায়াত। দেশের সঙ্গে হাজির বিদেশের সাংবাদিকরাও। গ্রামের এক প্রবীণ বললেন, বাহানাগা স্টেশনে কোনও এক্সপ্রেস দাঁড়ায় না। কেউ চিনতেও না এই স্টেশনের নাম। আমরা বাইরে গেলে বলতাম, বালেশ্বরে বাড়ি!
সোমবার রাত। বাহানাগা থেকে গাড়ি করে রওনা দিলাম ভুবনেশ্বরে। ৬ জুন, মঙ্গলবারের ভোররাত। চোখ কচলাতে কচলাতে হোটেলের দরজা খুলে দিলেন সিকিউরিটি। সকালের আলো ফুটতেই হোটেল থেকে বেরিয়ে সোজা এইমস হাসপাতাল। সেখানে তখনও শতাধিক মৃতদেহ শনাক্তই হয়নি। মর্গের সামনে টেবিলে নামানো ক্যাটালগ। অ্যালবামের মতো পাতায় পাতায় মৃতদেহের ছবি। পরিবারের সদস্যরা সজল চোখেই খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাঁদের প্রিয়জনকে। প্রচণ্ড গরম। ভেজা গামছায় জলের বোতল বেঁধে রেখেছেন ঝাড়খণ্ডের দুমকা থেকে আসা এক ব্যক্তি। এক হাতে ছেলের আধারকার্ড। অন্যহাতে শুকনো দু’টি বিস্কুট। ‘আপনার কে ছিল ট্রেনে’? মুখের দিকে তাকিয়ে হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন। বললেন, ‘ছেলে ছিল গো। মৃতদেহের ক্যাটালগে দেখলাম, ছবি আছে। কিন্তু, দেহ নিয়ে চলে গিয়েছে অন্য লোক’!
মর্গে হাজির রমামণি দেবী। হাতে স্বামীর ছবি। মাটিতে বসিয়ে রেখেছেন দুধের শিশুকে। চারদিন পরেও খোঁজ পাননি স্বামীর। বাড়ি বালেশ্বরে। যশবন্তপুরে ফিরছিলেন। পরের স্টেশনই ছিল বালেশ্বর। তার আগেই খেলনার মতো ছিটকে গিয়েছে তাঁর অসংরক্ষিত কামরা।
এইমসে যেন উপচে পড়ছে মৃতদেহ। মর্গে জায়গার আকাল। পারাদ্বীপ থেকে এসেছে ‘ই-কন্টেইনার’। প্যাকেটে মুড়ে ভিতরে ঢোকানো হল শতাধিক দেহ! বেশিরভাগই পরিচয়হীন! শুধু নম্বর সাঁটানো হয়েছে প্যাকেটের গায়ে। মর্গের সামনে লম্বা শিরিষ গাছ। তার নীচে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন এক অসহায় বাবা। এসেছেন সুদূর নেপাল থেকে। ‘কে ছিল আপনার’? প্রশ্ন শুনে মুখ তুললেন। ‘ছেলে’, এই বলে হাত বাড়ালেন। মুঠোয় ছোট্ট একটা সাদা কাগজ। তাতে লেখা—৩৪ নম্বর!