পুরনো রোগের বৃদ্ধিতে স্বাস্থ্যহানির সম্ভাবনা। ব্যবসায় শুভত্ব বজায় থাকবে। আর্থিক প্রগতিও হবে। ... বিশদ
চন্দ্রযান ২ –এর থেকে কতটা আলাদা চন্দ্রযান ৩?
গত ৩ বছর নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন ভারতের মহাকাশবিজ্ঞানীরা। সঙ্গে রয়েছে কয়েকটি সংস্থাও। সংস্থাগুলো বাণিজ্যিক হলেও এই চন্দ্রযান ৩ তৈরির ক্ষেত্রে তাঁরা বুদ্ধি লাগিয়েছেন। চন্দ্রযান ২ আর চন্দ্রযান ৩-এর পার্থক্য হল, প্রথমটিতে ছিল চাঁদকে প্রদক্ষিণকারী একটি যন্ত্র। এবার চন্দ্রযান ৩-এ প্রদক্ষিণকারী কোনও আলাদা উপগ্রহ থাকছে না। রকেট সিস্টেমের মাধ্যমে চাঁদের কাছে পৌঁছে তার থেকে অবতরণকারী যানটিকে (বিক্রম) চন্দ্রপৃষ্ঠে ছেড়ে দেওয়া হবে। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, বিক্রম থেকে প্রজ্ঞান বেরিয়ে চন্দ্রপৃষ্ঠে ঘুরবে। কী করে কাজ করবে এই চন্দ্রযান? আজ দুপুর ২.৩৫ মিনিটে শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার থেকে একটা এলভিএম ৩ রকেটে চেপে চন্দ্রযান পাড়ি দেবে মহাশূন্যে। পাড়ি দেওয়ার পর প্রথমে পৃথিবীকে সে উপবৃত্তাকার কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করবে। তারপর ৫ আগস্ট নাগাদ চাঁদের কক্ষপথের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হবে। চাঁদের কক্ষপথে ওই যান ঘুরবে। তারপর ১৫ আগস্ট নাগাদ চাঁদ থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে উপবৃত্তাকর কক্ষপথ প্রদক্ষিণ করবে। ভারতীয় বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, ২৩ আগস্ট আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, চাঁদের বুকে অবতরণের। গতবার অবতরণকালে সাফল্য আসেনি। এবার বিজ্ঞানীরা যানে ছোটখাটো যন্ত্রাংশ পরিবর্তন করেছেন। এমনকী সেটি কীভাবে নামবে, তার পদ্ধতির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচারও করেছেন। গত এক বছর ধরে কখনও হেলিকপ্টার থেকে কখনও উঁচু ক্রেনের মাধ্যমে এটিকে অবতরণ করানো হয়েছে। চন্দ্রপৃষ্ঠে নামার আগে তার গতিবেগ হবে প্রতি সেকেন্ডে মাত্র দু’মিটার। যানটি ১২০ ডিগ্রি কোণে নামলেও উল্টে পড়বে না। তার জন্য এর চারটি পায়া শক্তিশালী করা হয়েছে। গতবার বিক্রমে ছিল পাঁচটা রকেট। এবছর চারটি রকেট রাখা হয়েছে। এই রকেট নিয়ন্ত্রিত হবে পৃথিবী থেকে। চন্দ্রযান ৩-এর খরচ এখনকার মুদ্রায় ৭২১ কোটি টাকা। শ্রীহরিকোটা ছাড়াও বিজ্ঞানীদের কন্ট্রোলরুম হবে অস্ট্রেলিয়া ও ভারত মহাসাগরের উপর অবস্থিত একটি জাহাজ। অবতরণকারী যানে সাত রকমের সেন্সর থাকবে। এই সেন্সর ঠিক করে দেবে, কীভাবে সঠিক জায়গায় নামা যায়। নামার মুহূর্তে যদি দেখা যায় সেখানে পাথর আছে. তাহলে যানটি নিজেরই সরে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। চাঁদের পৃষ্ঠ দেশের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে চার কিলোমিটার বাই আড়াই কিলোমিটার জায়গায় এটির অবতরণ করবে।
চন্দ্রযানের খুঁটিনাটি
এই যানের তিনটে অংশ রয়েছে। প্রপালশন, ল্যান্ডার (বিক্রম) ও রোভার (প্রজ্ঞান)। এই প্রপালশন ইউনিট বেঙ্গালুরুতে অবস্থিত ইন্ডিয়ান ডিপ স্পেস নেটওয়ার্কের অ্যান্টেনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে। পৃথিবী থেকে এর মাধ্যমেই সঙ্কেত পাঠানো হবে। আবার বিক্রম ডিপ স্পেস নেটওয়ার্ক, প্রপালশন মডেল বা যে চন্দ্রযান ২ এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে তার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। প্রজ্ঞান বলে যে রোভার সেটি বিক্রমের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। প্রপালশন ইউনিট, বিক্রম ও প্রজ্ঞানের ওজন যথাক্রমে ২১৫০ কিলো, ১৭৫২ কিলো ও ২৬ কিলো। প্রত্যেকের মধ্যে সোলার প্যানেলের মাধ্যমে নিজস্ব শক্তি জোগানোর ক্ষমতা আছে। বিক্রম প্রায় ৭৩৮ ওয়াট এবং প্রজ্ঞান মাত্র ৫০ ওয়াট শক্তি তৈরি করতে পারে। এই যন্ত্র কতদিন কাজ করবে? বিজ্ঞানীরা মনে করছেন ১৪ দিন। কারণ, পৃথিবীর ১৪ দিনে চাঁদের এক দিন। চাঁদের দিনের বেলায় সূর্যের আলো পড়বে যানের সোলার প্যানেলে। সেই সময়েই কাজ করবে। বিক্রমে চারটি যন্ত্র রয়েছে। কী করবে এরা? মূলত, চাঁদের পৃষ্ঠদেশ এবং আবহাওয়ামণ্ডলীর রাসায়নিক গঠন, তড়িত্চুম্বকীয় ধর্ম, আবহাওয়ামণ্ডলী সম্পর্কে ধারণা দেবে যন্ত্রগুলি। এমনকী অবতরণকারী স্থলে চাঁদে কোনও ভূকম্প হয় কি না বা চাঁদের উপরের স্তরের সঙ্গে তলার স্তরের প্রতিক্রিয়া হয় কি না সেটা জানার জন্যও যন্ত্র রয়েছে। রয়েছে যা নাসার তৈরি লেসার রেট্রো রিফ্লেক্টরও। এটা কিন্তু নিজের থেকে কাজ করবে না। পৃথিবী থেকে পাঠানো সঙ্কেতে ফলে তার প্রতিফলনের মাধ্যমে চাঁদের গতি পরিবর্তন সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা জানতে পারবে। রোভার বা প্রজ্ঞানের মধ্যে দু’টি যন্ত্র রয়েছে। দু’টিই বর্ণালী বিশ্লেষক যন্ত্র। একটি এক্স-রেতে কাজ করে, যা দিয়ে চাঁদের পৃষ্ঠদেশে কী ধরনের খনিজ রয়েছে সেটি জানা যাবে। মূলত ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, সিলিকন, ক্যালসিয়াম, টাইটেনিয়াম এবং লোহার মতো খনিজ রয়েছে বলে অনুমান। আর একটি যন্ত্র দিয়ে শক্তিশালী লেজার আলো পাথরের উপর ফেললে যে বাষ্প হবে, তা বাষ্প পর্যালোচনা করে বুঝতে পারা যাবে কী ধরনের খনিজ এখানে রয়েছে। নিঃসন্দেহে সফলভাবে অবতরণ করলে ভারতের নিরিখে অনেক নতুন তথ্য উঠে আসবে।
উৎক্ষেপণের মুহূর্ত কেমন হয়?
স্বভাবতই চন্দ্রযান নিয়ে মানুষের উত্সাহের শেষ নেই। এবার ইসরো তাদের দরজা খুলে দিয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ, ছাত্র-ছাত্রীরা রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে শ্রীহরিকোটা থেকে এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত দেখতে পাবেন। তাঁরা দেখবেন অন্তত ৫-৬ কিলোমিটার দূর থেকে। কারণ, উৎক্ষেপণের সময় রকেট প্রভূত চাপ এবং উত্তাপ বের হবে তা কিন্তু ভয়ানক। এবার শ্রীহরিকোটার দ্বিতীয় লঞ্চিং প্যাড থেকে উৎক্ষেপণ হবে। সেই প্যাডের আশপাশে ইসরোর কর্মীদের কোয়ার্টারও খালি করে দেওয়া হয়। পুরো যানকেই দূর থেকে রিমোটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। অগ্নুত্পাতের সময় চারপাশ থেকে এত উত্তাপ বের হয় যে, আশপাশে কোনও মানুষের বেঁচে থাকা বা যন্ত্রর কাজ করার উপায় থাকে না। এই সময় প্রবল শব্দ হয়। তার ফলে ভূপৃষ্ঠ ছাড়াও, আবহাওয়ামণ্ডলীতেও কম্পন অনুভূত হয়। বিজ্ঞানীরা এবার অত্যন্ত সাবধানী। তাই আশপাশের অঞ্চলে গত কয়েকদিন সমস্তরকমের মাটি খোঁড়া বা নতুন কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রায় এক সপ্তাহ আগে লঞ্চ প্যাডে নিয়ে আসা হয়েছে চন্দ্রযান। গত ২৪ ঘণ্টা ধরে খুঁটিয়ে পরীক্ষাও হয়েছে।
মহাকাশ বিজ্ঞান ও ভারত
মহাকাশ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে চতুর্থ দেশ হিসেবে চাঁদের বুকে ভারত অবতরণের চেষ্টা করছে। প্রচণ্ড ক্ষমতা, শক্তি, বুদ্ধি, ধৈর্য ধরে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা এই কর্মকাণ্ড সফল করার চেষ্টায় রয়েছেন। তার থেকে বোঝা যায়, শুধু মহাকাশ নয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ভারত সঠিক ও বলশালী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে চলেছে আগামী দিনে। এক বছরের মধ্যে গগনযান পাঠানো হবে। আদিত্য এল ১ নামের সূর্যকে দেখার একটি উপগ্রহকেও উৎক্ষেপণ করা হবে। এ পর্যন্ত মাত্র তিনটে দেশ মঙ্গল অভিযান করতে পেরেছে। সেই তালিকায় জুড়েছে ভারত। ভারতের রকেট অত্যন্ত সফলভাবে মহাকাশে যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশ তাদের উপগ্রহ ভারতীয় রকেটের মাধ্যমে পাঠাচ্ছে। এর মাধ্যমে বাণিজ্যিক অগ্রগতিও হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কোনও দেশের নয়, আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্র। সেখানে ভারত শুধু এসে পৌঁছয়নি। অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। এই বিক্রম-প্রজ্ঞান চাঁদের বুকে যে তথ্য পাবে, প্রথমত সেই তথ্য বিশ্লেষণ করতে সময় লাগবে। এর মাধ্যমে আমরা চাঁদ সম্পর্কে আরও তথ্য জানতে পারব। যদিও এখনই তার প্রভাব সমাজজীবনে পড়বে তা নয়। এই ধরনের বিজ্ঞান অভিযানের প্রভাব এক-দু’দিনে বোঝা যায় না। আজ থেকে ১৫-২০ বছর পর হয়তো মানবজীবনের প্রভাব পড়তে শুরু করবে। যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, তা হয়তো কাজে লাগবে। চাঁদে হয়তো একদিন জল না হলেও জলীয় বরফ পাওয়া যাবে। সেই জলকে বিভাজন করে হাইড্রোজেন-অক্সিজেন তৈরি করে কৃত্রিম বায়োস্ফিয়ার তৈরি করা যাবে। সেই হাইড্রোজেন দিয়ে রকেটের জ্বালানি তৈরি করা যাবে। চাঁদের বুকে যে মানুষের উপনিবেশ একদিন ঘটতে চলেছে তা অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু মনে রাখতে হবে, চাঁদ কোনও দেশের নয়। সুতরাং, চাঁদের অধিকার পৃথিবীর সমস্ত দেশের। যখন দেখি, চাঁদের জমি বিক্রি হচ্ছে বলে অদ্ভুত হাস্যকর গল্প, সেটা গল্পই। তার সত্যতা কিছু নেই। চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চল দেখার জন্য ইসরো জাপানের স্পেস এজেন্সি জ্যাকসার সঙ্গে চুক্তি হয়েছে অনেক বছর আগে। তারা লুনার পোলার এক্সপোলেরেশন মিশন নামে আরও একটি অভিযানের কথা বলেছে। সেখানে অবতরণকারী যান তৈরি করবে জাপান। এই প্রজেক্ট সফল করার জন্য ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি যুক্ত হয়েছে। তারা বলেছে সমস্ত যোগাযোগের দায়িত্ব তারা নেবেন। তার আগে ভারতের ক্ষমতাকে সফলভাবে প্রকাশ করার প্রচেষ্টার নাম চন্দ্রযান ৩।