পুরনো রোগের বৃদ্ধিতে স্বাস্থ্যহানির সম্ভাবনা। ব্যবসায় শুভত্ব বজায় থাকবে। আর্থিক প্রগতিও হবে। ... বিশদ
আসলে একটা রাজ্যের পঞ্চায়েত ভোটে ৮২২ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী চাওয়াটাই কতটা বাস্তবসম্মত তা নিয়ে পরের নির্বাচন পর্যন্ত বিতর্ক চলতেই থাকবে, সহজে শেষ হবে না। সব বাহিনী যদি পূর্বের অঙ্গরাজ্য বাংলাতেই চলে আসে তাহলে বাকি দেশটা তো কার্যত অরক্ষিতই থেকে যাবে। একদিন, দু’দিন নয়, মণিপুর রাজ্যটা জ্বলছে টানা প্রায় দু’মাসের উপর। ডাবল ইঞ্জিনের সৌজন্যে সেখানে এই ক’দিনে শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। সাধারণের কথা ছেড়েই দিলাম, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বাড়ি পর্যন্ত লণ্ডভণ্ড। প্রাণ বাঁচাতে মন্ত্রী আশ্রয় নিয়েছেন ভিনরাজ্যে। সরকারি অফিস, গাড়ি রাস্তার দু’পাশে সার দিয়ে জ্বলছে। সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ। তবু কারও কোনও ভ্রুক্ষেপই নেই। দিল্লি থেকে সুদূর ইম্ফল, সবাই নিরোর মতো বেহালা বাজাচ্ছেন কিংবা একনিষ্ঠ নীরব শ্রোতার মতো শ্মশানের ভেসে আসা কান্না শুনছেন। কারও কোনও হেলদোলই নেই। বাংলায় পঞ্চায়েত ভোটও নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কঠোর নিরাপত্তাতেই সর্বত্র ভোট হওয়া উচিত। জনমতের সঠিক প্রতিফলনও জরুরি। কিন্তু যে কোনও সুস্থ মানুষ বলবেন, বাহিনী পাওয়ার অগ্রাধিকার মণিপুরেরই। বাংলা যদি ৮২২ কোম্পানি পায় মণিপুর কেন ১২ হাজার কোম্পানি কিংবা তারও বেশি পাবে না? সঙ্গে কয়েক হাজার সেনা। বাংলায় যেটুকু হাঙ্গামার ছবি আমরা দেখেছি তা তো সীমাবদ্ধ খুব বেশি হলে ২২টা জেলার মধ্যে ৪-৫টিতে। এখন অমিত শাহের দপ্তর না পাঠানোয় বুথের ভিতর আধাসেনা দেওয়াও যাবে না। এর দায় কে নেবে? বঙ্গ বিজেপি না অমিত শাহের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক?
আগেই বলেছি, এই মুহূর্তে মণিপুরের যা পরিস্থিতি তাতে সেখানে বাংলার কয়েকশো গুণ আধাসেনা মোতায়েন জরুরি। কিন্তু কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের সেদিকে কোনও নজর আছে বলে মনেই হচ্ছে না। মণিপুরে ডাবল ইঞ্জিন সরকার, দুহাতে ঘি চপচপে লাড্ডু! কার ইন্ধন আর কার ব্যর্থতা, সেই কিস্সা তাই সেমসাইড গোলের ভয়ে গোপন কুঠিতে বন্দি। বজ্রআঁটুনির জোরে তার হদিশ পায় কার সাধ্য! সড়ক পথে রাহুল গান্ধীকে যেতে দেওয়া হয়নি, তিনি অগত্যা কপ্টারে গিয়েছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী? আমেরিকা, মিশর সর্বত্র গেলেন কিন্তু এখনও ইম্ফলে তাঁর পায়ের ধুলো পড়েনি। ওই রাজ্যটা বোধহয় ‘সবকা বিকাশের’ চৌহদ্দির বাইরে!
এমনিতে ভোট থাকলে, ক্ষমতা দখলের গন্ধ পেলে দেশের উত্তর-পূর্বে পালা করে যান প্রধানমন্ত্রী। তবে এ যাত্রায় এখনও সময় করে উঠতে পারেননি তিনি। এমনকী মোদিজির সাম্প্রতিকতম মার্কিন সফরের আগে তাঁর দলেরই ৩০ জন বিধায়ক সাউথ ব্লকে দেখা করতে দিনভর অপেক্ষা করেও সময় পাননি। শোনা যায়, সেদিন অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী আরও বেশ কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করেন। তার মধ্যে বিনোদন জগতেরও কয়েকজন ছিলেন। শুধু ব্রাত্য থেকে যান মণিপুরের ৩০ জন তাঁর দলেরই বিধায়ক। ডাবল ইঞ্জিন ভালো, কিন্তু তার সুবাদে যদি বাজারের আলু-পটোলের মতো নির্বাচিত বিধায়করাও কেন্দ্রের কাছে ‘টেকন ফর গ্র্যান্টেড’ হয়ে যান তাহলে যা হয়, মণিপুরের অবস্থাও আজ তাই। এমনিতেই কেন্দ্রের শাসকের উত্তরপূর্বে দৃষ্টি যায় অনেক দেরিতে। তাই প্রথমটায় কেন্দ্র তেমন গুরুত্বই দেয়নি। আর এখন যখন পরিস্থিতি হাতের বাইরে এবং শাসক মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংয়ের দিকেই সন্দেহের তির, তখন আর করার কিছু নেই দেখে ক্রমশ দায় ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা। কিন্তু চিৎ হয়ে শুয়ে থুতু আকাশের দিকে ছুড়লে তা নিজের গায়েই পড়ে যে! শুক্রবার সকাল থেকে নাটক করেও মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং শেষ পর্যন্ত ইস্তফা দেননি। উল্টে অনুগামীরা তাঁর ইস্তফাপত্র ছিঁড়ে ফেলে নতুন এক নাটকের সূচনা করেছেন। সম্ভবত এই নাটকের স্ক্রিপট অমিত শাহদের নির্দেশেই রচিত। নাটকের অন্তিম পরিণতি দেখার জন্য অপেক্ষা করতেই হবে।
মণিপুরে মেইতেই, নাগা আর কুকিদের এই রক্তক্ষয়ী লড়াই নতুন নয়। সেই বৈরিতার ইতিহাসও বহু পুরনো। কিন্তু সম্প্রতি যা ঘটছে তার দায় কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক বিজেপি এড়াতে পারেন না। অথচ আমেরিকা সফর শেষ করে দেশে ফিরেই ভোপালের মঞ্চ থেকে প্রধানমন্ত্রী তাঁর নাতিদীর্ঘ ভাষণে মণিপুরের উদ্বেগজনক পরিস্থিতি নিয়ে একটি শব্দও খরচ করলেন না। বদলে কী করলেন? তামাম বিরোধীদের দুর্নীতির ঝাঁপি খুলে বসলেন। কংগ্রেসের কিস্সা তো আছেই, সঙ্গে লালু যাদব ৭০ হাজার কোটি, মমতা ২৩ হাজার কোটি, সবমিলিয়ে বিরোধীরা ২০ লক্ষ কোটি টাকার দুর্নীতিতে জড়িত, এই হচ্ছে তাঁর মোদ্দা বক্তব্য। পাটনার মঞ্চে উপস্থিত সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও হুমকি দিলেন। বোঝা গেল, ১৫টি বিরোধী দল জোট গড়ার বৈঠক করতেই মোদিজির ঘুম উড়ে গিয়েছে। কারণ তিনি বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন সত্যি যদি দেশজুড়ে এই মুহূর্তে প্রতিটি আসনে ‘একের বিরুদ্ধে এক’ লড়াই হয় তাহলে বিজেপি থুড়ি গুজরাত সন্তানের বিগত একদশকের রমরমা খতম হতে বাধ্য। কর্ণাটক, হিমাচলের সাম্প্রতিক ফলই তার প্রমাণ। ভোট কাটাকাটি বন্ধ হলেই গেরুয়া শিবিরের খেলা শেষ। শেষপর্যন্ত জোট ঠিক কী চেহারা নেবে, কতজন থাকবেন কতজন অন্য ডালে গিয়ে বসবেন, তা নিশ্চিতভাবে বলার সময় এখনও আসেনি। লোকসভা ভোটের এখনও আট-ন’মাস বাকি। এর মধ্যে গঙ্গা দিয়ে অনেক জোয়ার ভাটা, ঘোলা জল, পাঁক মাটি বয়ে যাবে। অনেক লোকদেখানো বন্ধুত্ব হবে, সময় ফুরোলে স্বার্থের টানে তা ভেঙেও যাবে। আর সেই জোট ভাঙার খেলাতেই এখন মরিয়া মোদি সরকার। তাই ‘দুর্নীতিপরায়ণদের জোট’ আখ্যা দিয়ে তিনি সবাইকে নৈতিকভাবে দুর্বল করতে সচেষ্ট। আর কোনও অগ্রাধিকারই এই মুহূর্তে তাঁর কাছে তুচ্ছ। এজন্যই রাত দু’টো পর্যন্ত নিজের বাসভবনে বৈঠক হয়েছে। মণিপুরকে শান্ত করার জন্যও নয়, বিকাশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যও নয়।
ইতিমধ্যেই শারদ পাওয়ারকে কোণঠাসা করার প্রক্রিয়া শুরুও হয়ে গিয়েছে। রাজস্থানে শচীন পাইলট ও অশোক গেহলটের মধ্যেকার বিরোধে ইন্ধন দেওয়ার খেলা চলছে। তেলেঙ্গানায় কেসিআরের দল ভাঙাচ্ছে কংগ্রেস, এমন একটা প্রচারও ডানা মেলছে। আর ইডি সিবিআইকে দিয়ে বাংলার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তামিলনাড়ুর এমকে স্ট্যালিনকে ফাঁদে ফেলার ষড়যন্ত্রেও ক্রমাগত হাওয়া দেওয়া চলছে। দু’রাজ্যেই রাজ্যপালরা বিরোধী নেতানেত্রীদের মতো সক্রিয়। তার মধ্যেই আবার দেখানো হচ্ছে, অভিন্ন দেওয়ানি বিধির জুজু। ইতিমধ্যেই ওই টোপ দিয়ে আপ ও উদ্ধবের শিবসেনাকে মহাজোট থেকে বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে গেরুয়া শিবির অনেকটা সফল। তবে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ভোটে যে কণামাত্র সুবিধা বিজেপি করতে পারছে না, তার রিপোর্ট ইতিমধ্যেই দিল্লির গেরুয়া নেতৃত্বের কানে পৌঁছে গিয়েছে। এত কিছুর পরও যে বাংলায় পিছু হটতে হচ্ছে, তার কারণ বিশ্লেষণ করতে হবে বিজেপি ও সিপিএম-কংগ্রেস জোটকে। দলবদলু দিয়ে যে অভীষ্ট লাভ সম্ভব নয়, তা বুঝতে হবে। সম্ভবত পঞ্চায়েত ভোটে ভরাডুবির পরই বঙ্গ বিজেপি নেতৃত্বে বড় রদবদল করতে বাধ্য হবেন অমিত শাহরা। কারণ এখন যা পরিস্থিতি তাতে এইরকম চললে গতবারের জেতা লোকসভা আসনের এক চতুর্থাংশ বের করে আনাও প্রায় অসম্ভব। বামপন্থীরা নতুন করে জেগে উঠে রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে উদগ্রীব। গত ১৫ বছর ধরে এরাজ্যে বামেদের ভোটব্যাঙ্কের এই ক্ষয় চলছেই। এখনও কি থেমেছে? স্বাধীনতার পর একুশের বিধানসভা ভোটেই প্রথমবার এরাজ্যে বাম ও কংগ্রেসকে শূন্যহাতে থামতে হয়েছে। তাই আসন্ন গ্রামবাংলার ভোটের ফল কতটা বিরোধীদের ঘুরে দাঁড়ানোর দিকনির্দেশ করবে, তা নিয়ে রয়েছে ঘোর সংশয়। কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে লোকসভা ও বিধানসভার ভোটও হয়েছে। কিন্তু কোনও লাভ কি হয়েছে? এবারও হবে না, এটা নিশ্চিত। ‘চোর ধরো’ স্লোগান অসহায়ভাবে মুখ থুবড়ে পড়তে চলেছে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার আর স্বাস্থ্যসাথী সহ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনমুখী একগুচ্ছ প্রকল্পের সামনে। মুর্শিদাবাদ, কোচবিহার আর আলিপুরদুয়ারের বাইরে আর কোথাও কোনও লড়াই নেই। আরও একবার বিরোধীরা বাস্তবের মাটিতে ভ্যানিশ।