পুরনো রোগের বৃদ্ধিতে স্বাস্থ্যহানির সম্ভাবনা। ব্যবসায় শুভত্ব বজায় থাকবে। আর্থিক প্রগতিও হবে। ... বিশদ
১৯৬৯-এ দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকারে মুখ্যমন্ত্রী হন বাংলা কংগ্রেসের নেতা অজয় মুখোপাধ্যায় এবং উপ মুখ্যমন্ত্রী হন সিপিএম নেতা জ্যোতি বসু। পুলিসসহ স্বরাষ্ট্র দপ্তর ছিল জ্যোতিবাবুর হাতে। সবাই ভেবেছিল, এবার বুঝি বাংলা শান্ত হবে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছিল উল্টোটাই। সরকারের শরিক দলগুলির মধ্যেই রেষারেষি চরমে ওঠে। এলাকা দখলের লড়াই এমন জায়গায় পৌঁছয় যে রাজ্যের এক-একটি পাড়া এক-একটি দলের নামে চিহ্নিত হয়ে যায়—কংগ্রেসি পাড়া, সিপিএম পাড়া, ফরওয়ার্ড ব্লক বা আরএসপি কিংবা নকশাল পাড়া ইত্যাদি। পাড়ার দাদাদের ঠেলায় সাধারণ মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। না-জেনে কিংবা অনিবার্য কারণে ‘ভুল’ পাড়ায় ঢুকলেই প্রাণ নিয়ে ফেরা দুষ্কর ব্যাপার। সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফেরা নিশ্চিত করতে চাইতেন সকলেই। মুখ্যমন্ত্রী সব দলকে সংযত হওয়ার আবেদন জানান। কিন্তু তাতে কোনও লাভ হয়নি। বাধ্য হয়ে নিজের সরকারকেই ‘অসভ্য, বর্বর’ দেগে দিয়ে হিংসাবন্ধের দাবিতে কার্জন পার্কে অনশনে বসেন অজয় মুখোপাধ্যায়। এই অবাক করা ঘটনা স্বভাবতই সারা দেশকে চমকে দিয়েছিল।
১৯৭০-এ বর্ধমান শহরের বুকে ঘটেছিল হাড় হিম করা ‘সাঁইবাড়ি হত্যাকাণ্ড’! বাংলায় অরাজকতার ঐতিহ্যে অবশ্য সেখানেই ইতি পড়েনি—হত্যাপুরী হয়ে উঠেছিল বারাসত, দমদম, বরানগরসহ শহরতলির বিস্তীর্ণ এলাকা। ১৯৭১-এ উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর এলাকায় দিনের আলোয় হত্যা করা হয় ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা হেমন্ত বসুকে। অভিযুক্ত ছিল বামপন্থীরাই। হেমন্তবাবুর শেষ আকুতি ছিল, ‘তোমরা আমাকে মারছ কেন, আমি তোমাদের কী ক্ষতি করেছি?’ হেমন্তবাবু সেবার ভোটের প্রার্থীও ছিলেন। আরও দুই প্রার্থীকে (দেবদত্ত মণ্ডল ও পীযূষচন্দ্র ঘোষ) খুন করা হয় সেবার। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে ভোটে সেনা নামাতে হয়।
অরাজকতার নিকৃষ্টতম জমানা টেনে এনেছিলেন কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। বেনজির কারচুপির নির্বাচনের মধ্য দিয়েই তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন। এজন্য ১৯৭২ সালে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বিধানসভা বয়কট করে সিপিএম। সিদ্ধার্থবাবু এমনই স্বৈরাচারী ছিলেন যে, ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা শাহির ‘জরুরি অবস্থা’র আইনি খসড়াটি তিনিই তৈরি করেন।
নিস্তার পেতে রাজ্যবাসী রাইটার্সের চাবি ১৯৭৭ সালের ২১ জুন জ্যোতি বসুর হাতে তুলে দিয়েছিল। ২০০০ সালের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত তিনিই ছিলেন বাংলার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তাঁর উত্তরসূরি হয়ে আসেন সিপিএমেরই ‘সংবেদনশীল নেতা’ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। রাইটার্স তাঁর দখলে ছিল ২০১১-র ১৩ মে পর্যন্ত। বামফ্রন্টের বকলমে বাংলায় সিপিএম শাহি দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল প্রায় ৩৪ বছর। ‘জনগণের সরকার’ নামাবলি গায়ে লালপার্টি আলটিমেটলি যে শাসন উপহার দিয়েছিল তার পাশে হিটলার, নিদেন পক্ষে নরেন্দ্র মোদিই মানানসই।
বাম জমানার অরাজকতার স্মৃতি তো টাটকা। এই জগদ্দলের অবসান ঘটাতে যে ধারার গণ আন্দোলন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গড়ে তোলেন তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আজ যে সচিত্র পরিচয়পত্র (এপিক) হাতে নিয়ে মানুষ ভোট দিচ্ছেন, তার পিছনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান অনস্বীকার্য। জ্যোতি বসুর জমানায় হার্মাদ বাহিনী এবং অংশত পার্টি ক্যাডারে রূপান্তরিত পুলিসের সৌজন্যে একের পর এক নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হয়। এই অনাচারের অবসানের দাবিতে ‘অগ্নিকন্যা’র আন্দোলন এক ইতিহাস হয়ে রয়েছে। বাম জমানার অবসান নামক এক প্রায়-অসম্ভবকে সম্ভব করেন মমতাই।
মানুষ ২০ মে, ২০১১ তারিখে তৃণমূল সুপ্রিমোর হাতে রাজ্যভার অর্পণ করে। মমতা এত বড় ‘বদল’ এনেও ‘বদলা’র রাজনীতি পরিহার করেছিলেন পূর্ব ঘোষণা মতোই। একইসঙ্গে রাজ্যবাসীকে ভালো রাখতে নিয়েছেন একের পর এক জনমুখী কর্মসূচি। তাঁর শাসনের মূল অভিমুখ হয়ে উঠেছে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে গরিব মানুষ এবং অবশ্যই মহিলা। শাসনব্যবস্থাকে রাইটার্স বা নবান্ন থেকে মুক্তি দিয়ে নিয়ে গিয়েছেন জেলায় জেলায়। শুধু অফিসাররা যান না, তিনি নিজেই অগণিত বার ছুটে চলেছেন পাহাড় থেকে সাগর, জঙ্গলমহল প্রভৃতি সর্বত্র। দিদিকে বলো, পাড়ায় সমাধান, দুয়ারে সরকার এই জমানার এক অভিনব প্রশাসনিক সংস্কার। সব মিলিয়ে গরিব, কৃষক, মহিলা প্রভৃতির আয় বেড়েছে। দূর হয়েছে খাদ্যের অভাব। স্কুলে স্কুলে বেড়েছে গরিব বাড়ির ছেলেমেয়েদের সংখ্যা। সরকারি বৃত্তি, এমনকী স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড মারফত উচ্চ শিক্ষাতেও দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে তারা। প্রশিক্ষণ এবং চাকরি মেলা মারফত চাকরি পাচ্ছেন অনেকে। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন এসেছে, কোনও সন্দেহ নেই, সেটি যুগান্তকারী।
তবু আলোর নীচে একটি অন্ধকার কিন্তু রয়েই গিয়েছে—ভোট মানেই অশান্তি। পঞ্চায়েত/ পুরসভা, বিধানসভা, লোকসভা প্রভৃতি প্রতিটি নির্বাচনের প্রেক্ষিত আলাদা হলেও গণ্ডগোল পাকে কিন্তু মোটামুটি একইরকম। ‘বাহুবলীদের রাজ্য’ হিসেবে একদা ‘কুখ্যাত’ বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ প্রভৃতির রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আমূল বদল এলেও বাংলা পড়ে রয়েছে তিমিরেই। অন্য রাজ্যে গিয়ে, এনিয়ে বাংলার মানুষকে এখন উঠতে বসতে খোঁটা হজম করতে হয়।
পঞ্চায়েত বস্তুত ‘গ্রাম স্বরাজ’-এর ভোট। বাংলার বেশিরভাগ মানুষ গ্রামে বাস করেন। তাই এই ভোট যোগ করে বাড়তি উন্মাদনা। রাজ্যে কোন দলের প্রভাব ও গ্রহণযোগ্যতা কতটা, গ্রামের ভোটই সেটা বেশ বুঝিয়ে দেয়। রাজ্যে ২০১৮ সালের ভোট পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে বিস্তর বিতর্ক ও সমালোচনা হয়। ব্যাপক সন্ত্রাস সৃষ্টি, ভোটে কারচুপি এবং হানাহানিতে মদতের অভিযোগে আজও বিদ্ধ হয়ে চলেছে শাসক দল। রাজনৈতিক মহলের একাংশের অনুমান, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের ফল আশানুরূপ না-হওয়ার পিছনে ছিল ২০১৮-র ভোটের প্রভাব।
তাই ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের মাত্র মাস কয়েক আগের এই পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে বিশেষ সতর্ক ছিলেন দলের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ভোটে হানাহানির অবসানের উপরেই জোর দিতে চেয়েছেন তিনি। অভিষেক কথা দিয়েছিলেন, ‘পঞ্চায়েত ভোট হবে স্বচ্ছতার সঙ্গে, নিরপেক্ষভাবে এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে। শাসক দলের বিরুদ্ধে কেউ কোনও অভিযোগ আনতে পারবেন না। অন্য দলের যে কেউ (দলহীন ব্যক্তিও) প্রার্থী হবেন।’ মনোনয়ন পেশ করতে সমস্যা হলে ‘সরাসরি আমাকে জানান, আমিই মনোনয়নপত্র জমার ব্যবস্থা করে দেব’ বলেও আশ্বাস দেন তিনি। বলেছিলেন, ‘প্রতিটি ভোটার তাঁর পছন্দমতোই ভোট দেবেন। আমি চাই, ভোটের বাক্সে মানুষের মতেরই প্রতিফলন।’ তাঁর ইঙ্গিত ছিল, এবারই প্রথম গ্রামবাংলা পেতে চলেছে এক ব্যতিক্রমী ‘গণতন্ত্রের উৎসব’।
এজন্য তিনি সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছিলেন নিজের দলের সেরা প্রার্থীদের মনোনয়নের উপরে। পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন, ‘তৃণমূলে তাঁরাই প্রার্থী হবেন শুধু, মানুষ যাঁদের চায়। কোনও নেতা বা দাদা ধরে ভোটে লড়ার টিকিট পাওয়া যাবে না।’ কয়েক মাস যাবৎ নানা জেলায় ঘুরে কিছু দলীয় পঞ্চায়েত কর্তার দুর্নীতি, কুকীর্তি ধরলেন, প্রকাশ্যে সাজাও দিলেন কয়েকজনকে। স্পষ্ট করলেন, ‘তৃণমূলকে কোনওভাবেই আর লুটেপুটে খাওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।’ ঘুঘুর বাসা ভাঙার উদ্যোগের আন্তরিকতা বোঝাতে জেলায় জেলায় দলের মধ্যে ভোটেরও ব্যবস্থা করেন তিনি।
এই উদ্যোগ পুরোপুরি সফল না-হলেও, তাঁর রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভিনবত্ব শুধু বাংলায় নয়, সারা দেশের রাজনীতিতেই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে রইল। আগামী দিনে অভিষেকের কিংবা তাঁরই কোনও উত্তরসূরির হাত ধরে উদ্যোগটি সফল হবে, এই প্রত্যাশা রাখা যেতেই পারে। পঞ্চায়েত ভোটের অনেক রেজাল্টও বেরিয়ে গিয়েছে। ফের প্রমাণিত হয়েছে গ্রামবাংলায় শাসক দলের একচ্ছত্র প্রভাব। একাধিক বিরোধী দলও জিতেছে বেশকিছু আসনে। জনপ্রতিনিধিদের দল বদলের নোংরামিতে এবার কি দাঁড়ি পড়বে? লাগাম পড়বে কি নির্বাচনোত্তর হিংসায়? এই দায়িত্ব শাসক এবং সবক’টি বিরোধী দলের। এটাই বাংলার ও ভারতের গণতন্ত্রের আশু চাহিদা।