পুরনো রোগের বৃদ্ধিতে স্বাস্থ্যহানির সম্ভাবনা। ব্যবসায় শুভত্ব বজায় থাকবে। আর্থিক প্রগতিও হবে। ... বিশদ
১৯৭৯ সালে জর্জিয়ায় জন্ম খানগোশভিলি ছিলেন জাতিতে চেচেন। ১৯৯৯–২০০০ সালের দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধের সময় রাশিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী ‘ইচকেরিয়া চেচেন প্রজাতন্ত্র’র পক্ষে রুশদের বিরুদ্ধে লড়াইও করেন। সেই যুদ্ধে চেচেন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পরাজয়ের পর খানগোশভিলি জর্জিয়ায় গা ঢাকা দেন। একসময় জর্জীয় সেনাবাহিনীর অফিসারও হন। জর্জীয় গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তাঁকে চেচেন বিচ্ছিন্নতাবাদী, জর্জীয় সেনাকর্তা, জর্জীয় গুপ্তচর— যে যাই বলুক, রাশিয়ার চোখে খানগোশভিলির পরিচয় একটাই: টেররিস্ট।
চেচেন বিচ্ছিন্নতাবাদ গতি হারিয়ে ফেলেছে এক দশক আগেই। কিন্তু মস্কো খানগোশভিলি বা তাঁর সহযোদ্ধাদের ক্ষমা করেনি। খানগোশভিলি রাশিয়ার দৃষ্টিতে ‘রাষ্ট্রীয় শত্রু’। তাই ২০১৬ সালেই জর্জিয়ায় তাঁকে খুন করার চেষ্টা করা হয়। প্রাণের ভয়ে খানগোশভিলি সপরিবারে জার্মানিতে পালিয়ে যান। কিন্তু মৃত্যু তার পিছু ছাড়েনি। ২০১৯ সালের ২৩ আগস্ট খানগোশভিলিকে গুলি করে খুন করা হয়। জার্মান প্রশাসন এই খুনের জন্য সরাসরি রুশ সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘জিইউ’কে দায়ী করে। জিইউ–এর যে ইউনিটটি এই খুনের সঙ্গে জড়িত, তার নাম ‘ইউনিট ২৯১৫৫’। মস্কোর পূর্বাঞ্চলে ইজমাইলোভো জেলায় অবস্থিত ১৬১ তম স্পেশাল পার্পাস স্পেশালিস্ট ট্রেনিং সেন্টারে এই ইউনিটটির সদর দপ্তর। পশ্চিম দুনিয়ার বিশ্লেষকদের মতে, ইউনিট ২৯১৫৫–এর প্রধান দায়িত্ব রাশিয়ার বাইরে ‘বিশ্বাসঘাতক’দের খুন করা এবং বিভিন্ন অন্তর্ঘাতমূলক কাজকর্ম চালিয়ে পশ্চিমের বিশ্বকে দুর্বল করে ফেলা!
মস্কোর কর্তারা জানেন, পশ্চিম বিশ্বের সঙ্গে বড় ধরনের ‘অস্ত্র প্রতিযোগিতা’য় জড়িয়ে পড়া রাশিয়ার জন্য ক্ষতিকর। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের অন্যতম একটি কারণ ছিল মাত্রাতিরিক্ত সামরিক ব্যয়ের ফলে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক সঙ্কট। মস্কো এই ভুলের পুনরাবৃত্তি চায় না। তাই পশ্চিমের বিশ্বকে মোকাবিলা করতে মস্কো একটি নতুন রণকৌশল বেছে নিয়েছে। ‘হাইব্রিড যুদ্ধ’। এই রণকৌশলের লক্ষ্য প্রোপাগান্ডা, সাইবার যুদ্ধের মাধ্যমে পশ্চিমের রাষ্ট্রগুলির অভ্যন্তরীণ বিরোধকে প্রকট করে তোলা। যাতে পশ্চিমের বিশ্ব নিজস্ব সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত থাকে এবং রাশিয়া ‘শ্বাস নেওয়ার অবকাশ’ পায়। অবশ্য এই কৌশল অভিনব কিছু নয়। কারণ পশ্চিমের বিশ্বও রাশিয়া বা অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলির বিরুদ্ধে একই কৌশল ব্যবহার করে থাকে। ‘ইউনিট ২৯১৫৫’ হচ্ছে পশ্চিমের বিশ্বের বিরুদ্ধে রুশ ‘হাইব্রিড যুদ্ধে’রই একটি হাতিয়ার।
এখনও পর্যন্ত যা জানা গিয়েছে, ইউনিট ২৯১৫৫–এর কমান্ডার মেজর জেনারেল আন্দ্রেই আভেরিয়ানভ। সোভিয়েত উজবেকিস্তানের তাসখন্দ সামরিক অ্যাকাডেমি থেকে উত্তীর্ণ আভেরিয়ানভ ১৯৯০–এর দশকে প্রথম চেচেন যুদ্ধ এবং ২০০০–এর দশকে দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২০০৮ সালের দিকে ‘ইউনিট ২৯১৫৫’ গঠনের পর তাঁকেই এই বাহিনীর কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। ইউনিট ২৯১৫৫–এর কমান্ডার হিসেবে আভেরিয়ানভ কোন ধরনের কাজে জড়িত, তা এখনও জানা যায়নি। ২০১৫ সালে রুশ সরকার তাঁকে দিয়েছে রাশিয়ার সর্বোচ্চ সামরিক পদক ‘হিরো অব দ্য রাশান ফেডারেশন’। গোয়েন্দা বিশ্লেষকদের মতে, ইউনিট ২৯১৫৫–এর সদস্যরা গুপ্তহত্যা, অন্তর্ঘাত ও অন্যান্য বিশৃঙ্খলামূলক কাজকর্ম চালানোর ক্ষেত্রে পারদর্শী। এই ইউনিটের প্রতিটি সদস্যই একাধিক ছদ্মনাম ব্যবহার করে। এদের গোপনীয়তার মাত্রা এত বেশি যে, জিইউ–এর অন্যান্য ইউনিটের সদস্যরাও এদের সম্পর্কে বেশি কিছু জানে না।
২০১৫ সালে এমিলিয়ান গেব্রেভ নামে একজন বুলগেরীয় অস্ত্র ব্যবসায়ীকে বিষপ্রয়োগের মাধ্যমে খুনের চেষ্টা করা হয়। এরজন্য ইউনিট ২৯১৫৫ সদস্যদের দায়ী করা হয়। ২০১৬ সালে মন্টিনিগ্রোর বিরোধী দলকে একটি অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা চালানোর দায়ে অভিযুক্ত করা হয় এবং এই প্রচেষ্টায় জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে ইউনিট ২৯১৫৫–র বিরুদ্ধে। ২০১৭ সালে স্পেনের একটি আদালত কাতালোনিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে সাহায্য করার জন্য ইউনিট ২৯১৫৫ সদস্যদের দায়ী করে। ২০১৮ সালে ব্রিটেনে প্রাক্তন রুশ গোয়েন্দা কর্তা ও বিশ্বাসঘাতক সের্গেই স্ক্রিপালকে খুন করার প্রচেষ্টা চালানো হয়। এর পিছনেও ইউনিট ২৯১৫৫–র হাত রয়েছে বলে অভিযোগ। বস্তুত স্ক্রিপালের খুনের প্রচেষ্টার সময়ই পশ্চিমের সংবাদমাধ্যমে প্রথম ইউনিট ২৯১৫৫ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ২০২০ সালে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলি দাবি করে, আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের খুন করার জন্য ইউনিট ২৯১৫৫-এর সদস্যরা তালিবানকে বিপুল অর্থ দিয়েছে। রাশিয়া অবশ্য যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করেছে। মুখে বললেও অভিযোগের কোনও প্রমাণও দিতে পারেনি পশ্চিম দুনিয়ার গোয়েন্দারাও।
সম্প্রতি ব্রিটেনের প্রতিরক্ষা বিষয়ক থিঙ্কট্যাঙ্ক রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট দাবি করেছে, ইউক্রেনে যুদ্ধে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর চেয়ে গোয়েন্দারাই বেশি সফল। ‘প্রিলিমিনারি লেসনস ফ্রম রাশিয়াস আনকনভেনশনাল অপারেশনস ডিউরিং দ্য রুশো–ইউক্রেনিয়ান ওয়্যার: ফেব্রুয়ারি ২০২২–ফেব্রুয়ারি ২০২৩’ শীর্ষক এই প্রতিবেদন ৩৯ পৃষ্ঠার। ‘টার্গেট’ দেশকে ধ্বংসের জন্য রাশিয়ার গোপন অভিযান সম্পর্কে পশ্চিমের দেশগুলিকে সতর্ক করাই এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য। সংস্থাটি সেই প্রতিবেদনে বলেছে, ২০২১ সালের জুন থেকে ইউক্রেন আগ্রাসনের জন্য প্রস্তুতি শুরু করে রাশিয়ার গুপ্তচর সংস্থা ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস (এফএসবি)। আগ্রাসন চালানোর আগেই রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থাগুলি ইউক্রেনে বিরাট সংখ্যক এজেন্ট নিয়োগ করে বড় একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করে ফেলে। রুশ বাহিনী যখনই ইউক্রেনের কোনও এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, সঙ্গে সঙ্গে এফএসবির কর্তারা সেসব এলাকায় থাকা স্থানীয় সরকারি দপ্তরগুলি থেকে সরকারি নথি বাজেয়াপ্ত করে ও কম্পিউটারের হার্ডড্রাইভের তথ্য নিজেদের কাছে নিয়ে নেন। এর মাধ্যমে সরকারের পক্ষে–বিপক্ষে কারা কাজ করছেন এবং তাঁরা কোথায় আছেন, তার একটি তালিকা তৈরি করা হয়। এরপর ঘরে ঘরে গিয়ে তল্লাশি চালিয়ে রুশবিরোধীদের গ্রেপ্তার ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
শুধু ইউক্রেন নয়, ইউরোপের আলপাইন অঞ্চলের দেশগুলিকে গুপ্তচরবৃত্তির হটস্পট করে তুলেছে রাশিয়া। দিন কয়েক আগেই অভিযোগ তুলেছে সুইজারল্যান্ডের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা এনডিবি। আলপাইন অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলি হল অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, লিশটেনস্টাইন, মোনাকো, স্লোভেনিয়া এবং সুইজারল্যান্ড। এনডিবি গোয়েন্দা সংস্থার বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেনেভা ও বার্নে কূটনৈতিক এবং কনস্যুলার মিশনে কূটনৈতিক বা প্রযুক্তিগত-প্রশাসনিক কর্মী হিসেবে স্বীকৃত প্রায় ২২০ জন রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অন্তত এক তৃতীয়াংশ এখনও রাশিয়ান গোয়েন্দা পরিষেবার হয়ে কাজ করছেন। উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল অস্ট্রেলিয়াও। ফলে গোটা দুনিয়ায় রুশ গোয়েন্দারা যে নজরদারি চালাচ্ছে তা স্পষ্ট। ওয়াগনার প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোজিনের ভয়টাও সেখানেই। নিশ্চিত তাঁকেও ফলো করা শুরু করেছে ইউনিট ২৯১৫৫ কিংবা এফএসবি-র গোয়েন্দারা।
ইউক্রেনের কাছ থেকে ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নিয়েছিল রাশিয়া। এর ঠিক আগে ২০১৩ সালে গোপন একটি দায়িত্ব পালন করেছিলেন আলেকসান্দ্রা গারমাঝাপোভা। পেশায় তিনি সাংবাদিক। তাঁর গোপন কাজ ছিল ক্রেমলিনের পক্ষে মতামত লেখা। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জন্মস্থান সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরের একটি অফিসে বসে শত শত এমন মতামত লিখেছিলেন গারমাঝাপোভা। অভিযোগ, ওই অফিস ছিল ভাড়াটে সেনা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ওয়াগনারের প্রধান প্রিগোজিনের। আলেকসান্দ্রা গারমাঝাপোভা এখন রাশিয়ায় থাকেন না। রাশিয়ার সেনাবাহিনী নিয়ে ‘ভুয়ো খবর’ প্রচারের অভিযোগ ওঠার পর গত বছর বার্লিনে পালিয়ে যান তিনি। ওয়াগনারের বিদ্রোহের ঘটনার পর মুখ খুলেছেন সেই গারমাঝাপোভা। বলেছেন, ‘বিদ্রোহী প্রিগোজিন আর বেশি দিন বাঁচার সুযোগ পাবেন না। পুতিন অত্যন্ত প্রতিশোধপরায়ণ মানুষ। তাঁকে গোটা দুনিয়ার সামনে অপমানিত হতে হয়েছে, এটা পুতিন কখনওই ভুলে যাবেন না।’ ইতিমধ্যে সেন্ট পিটার্সবার্গে ওয়াগনার মার্সেনারি গ্রুপের বিশাল ভবন সিল করে দেওয়া হয়েছে। প্রিগোজিনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল এমন অনেক সংবাদমাধ্যমের অফিসে তালা ঝুলছে। আর প্রিগোজিন নিজে এখন বেলারুশের ডেরায় লুকিয়ে। কেউ জানে না ঠিক কোথায়। অভ্যুত্থানের পথ ছেড়ে দিলেও প্রিগোজিনের বিরুদ্ধে এখনই রাশ আলগা করতে চায় না ক্রেমলিন। ‘বিশ্বাসঘাতক’ প্রিগোজিনকে একেবারে ঢাল-তরোয়ালহীন নিধিরাম সর্দারে পরিণত করার পরিকল্পনা নিয়েছেন পুতিন।
গোটা দুনিয়া না জানুক, পুতিন নিশ্চিত জানেন প্রিগোজিন কোথায়, কী করছেন। ভুলে যাবেন না, পুতিনের বিশ্বস্ত মিত্রের নাম বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো। পুতিন জানেন, ১৮১২ সালে নেপোলিয়ন প্রায় ছয় লক্ষ সেনা নিয়ে যে পথে মস্কো অভিযান করেছিলেন, সে পথ চেনা প্রিগোজিনেরও। রাশিয়া কিংবা বেলারুশ কেউই চাইবে না সেই পথ রক্তাক্ত হোক। তার আগেই চিরকালের মতো ‘বিষদাঁত’ উপড়ে ফেলতে চান রুশ প্রেসিডেন্ট। এই ভয়ঙ্কর কাজের দায়িত্ব কার? ইউনিট ২৯১৫৫ নাকি এফএসবি গোয়েন্দাদের।
রাশিয়ার চোখে ইয়েভজেনি প্রিগোজিনের এখন পরিচয় একটাই: বিশ্বাসঘাতক!