পুরনো রোগের বৃদ্ধিতে স্বাস্থ্যহানির সম্ভাবনা। ব্যবসায় শুভত্ব বজায় থাকবে। আর্থিক প্রগতিও হবে। ... বিশদ
ছুতোয় তিনি বিরোধী শিবিরে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক হানার চেষ্টা করে নিজের পায়ের তলার ঝুরো মাটিকে শক্তপোক্ত করতে চাইছেন।
ভালো কথা। প্রকৃত দুর্নীতির সবসময় তদন্ত হওয়া উচিত। দোষীদের শাস্তি পাওয়াও দরকার। দেশকে উন্নতির পথে নিয়ে যেতে গেলে এই দুর্নীতি অবিলম্বে বন্ধ করা দরকার। কিন্তু একই যাত্রায় পৃথক ফল দেখে মোদিজির সদিচ্ছা ঘিরে প্রশ্ন উঠেছে। আসলে মোদিজি তাঁর নিজের জমানায় ঘটে যাওয়া একের পর এক কেলেঙ্কারি নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। এমন ভাব করছেন, যেন কিছুই হয়নি! হ্যাঁ, মোদি জমানায় কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতায় এত বড় বড় ঘোটালা হয়েছে, যা এর আগে স্বাধীন ভারতে কোনওদিন হয়নি। কিন্তু সবটাই তিনি মানুষের কাছ থেকে আড়াল করতে চাইছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার সেইসব কেলেঙ্কারি বা ঘোটালা নিয়ে নিশ্চুপ তিনি। অথচ দেশের প্রধান হিসাবে তাঁরই তো তদন্তের নির্দেশ দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তিনি আত্মগরিমা প্রচারে এতই ব্যস্ত থাকেন যে, এগুলিকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনতে চান না। এসব কেলেঙ্কারির তদন্তে তাঁর অনীহার ব্যাপারটা অত্যন্ত স্পষ্ট। কেন তা আমরা জানি না। তবে কি কেঁচো খুড়তে গেলে কেউটে বেরিয়ে পড়তে পারে? তাই কি অতি সাবধানী মোদি?
এইসব ঘোটালাকে চাপা দিতে সরকার প্রথম থেকে যে পথটি বেছে নিয়েছে, সেটা হল তথ্যকে চাপা দেওয়া। সংসদে বহু প্রশ্নের জবাবে, আরটিআইয়ের বহু প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রের সরকার জানিয়েছে, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাদের কাছে কোনও তথ্য নেই। কেন নেই? কেন একটি সরকারের কাছে নির্দিষ্ট কোনও তথ্য থাকে না? তখনই অনুমান হয়, হয়তো প্রকৃত সত্যকে জানাতে ভয় পাচ্ছে সরকার। তথ্যকে যখন মানুষের কাছ থেকে আড়াল করা হয়, গণতন্ত্র তখন হয়ে ওঠে সোনার পাথরবাটি।
কংগ্রেস আমলের টুজি টেলিকম ঘোটালা ছিল পৌনে দু’লক্ষ কোটি টাকার কেলেঙ্কারি। কিন্তু মোদির আমলে নিঃশব্দে যত কেলেঙ্কারি হয়েছে, তা যোগ করলে সম্ভবত ট্রিলিয়নে হিসাব করতে হবে। মোদি জমানায় শুধু ব্যাঙ্ক জালিয়াতির পরিমাণই প্রায় সাড়ে ৫ লক্ষ কোটি টাকা। তার ফলে আমরা দেখলাম, শুধু চুরির জন্যই একটা দেশের ব্যাঙ্কিং সিস্টেম প্রায় ভেঙে পড়ল! অসহায় মোদি সরকার যেন শুধু বিভিন্ন ব্যাঙ্কের ভাঙাগড়ার রং মিলান্তি খেলছে। ওসব ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণের ধাপ্পাবাজি দিয়ে যে ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের পুনরুজ্জীবন সম্ভব নয়, সেটা প্রধানমন্ত্রী ভালোই বোঝেন। তবু ভঙ্গি দিয়ে চোখ ভোলানোর এই খেলা ২০২৪ সালের নির্বাচন পর্যন্ত চলবে। এছাড়া উপায় নেই তাঁর। বিভিন্ন রাজ্যে গেরুয়ার ফিকে হয়ে আসা, দেশের মধ্যেই বিজেপি বিরোধী হিন্দুত্বের উত্থান এবং বিভিন্ন রাজ্যের ভোটে একের পর এক পরাজয় দেখে তিনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, ‘এবার ভাসিয়ে দিতে হবে আমার এই তরী।’
আমরা দেখেছি, ব্যাঙ্কের টাকা লুট করে একের পর এক শিল্পপতি দেশ ছেড়ে পালানোর পরও স্বঘোষিত ‘চৌকিদার’ কিছুই করেননি। শুধু ‘ধরে আনব, বেঁধে আনব’ বলে দীর্ঘদিন ধরে টুকিটুকি খেলছেন। নীরব মোদি সহ বেশ কয়েকজন মোদি পদবিধারী এবং মেহুল চোকসি, বিজয় মালিয়ার মতো ব্যক্তিরা যখন সুলতান মামুদের মতো সব কিছু লুটপাট করে পালালেন, তখন মোদি সরকার কি অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের মতো চোখে কাপড় বেঁধে বসেছিল? ২০২১
সালে আরবিআই ব্যাঙ্ক জালিয়াতি নিয়ে যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, সেখানেই দেখা গিয়েছে, মোদি জমানায় ব্যাঙ্ক জালিয়াতি আগের সব রেকর্ড ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে।
এখানেই শেষ নয়, সরকারের মূর্খামিতে হদিশ নেই দেশের ৮৮ হাজার কোটি টাকারও। এই মূল্যের নতুন পাঁচশো টাকার নোট প্রকাশ্যে দিনের আলোয় হাপিশ হয়েছে। কেউ তার সন্ধান জানেন না। তার খোঁজও হয়নি। এটা আবার হয় নাকি? সব অপ্রিয় তথ্যকে চাপা দেওয়ার নামই কি তবে রামরাজত্ব? কেউ প্রশ্ন করতে পারবেন না? কেউ জানতে পারবেন না টাকাটা কার পকেটে গিয়ে ঢুকল?
সরকারি ছাপাখানায় নতুন পাঁচশো টাকার নোট ছাপা হল, কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হাতে সবটুকু গেল না। কোথায় গেল বাকি নোট? মনোরঞ্জন রায় নামে এক ব্যক্তি আরটিআই না করলে পুরো ব্যাপারটা হয়তো চাপাই পড়ে থাকত। অর্থাৎ টাঁকশাল যত নোট ছেপে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে পাঠিয়েছে বলে হিসাব দিয়েছে এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যে পরিমাণ নোট গ্রহণ করেছে বলে হিসাব দিয়েছে, তাতেই এই বিপুল পরিমাণ টাকার ঘাপলা দেখা গিয়েছে বলে অভিযোগ। যাঁদের পকেটে টাকা গিয়েছে, এখন দেশের স্বার্থে সেই ছুপা রুস্তমদের খুঁজে বের করা কেন্দ্রীয় সরকারেরই দায়িত্ব। মোদিজি তদন্তে যত ঢিলেমি করবেন, রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে ততই তিনি প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন। তাঁর সরকারকেই খুঁজে বের করতে হবে এই টাকা।
বাংলায় একটা কথা আছে, বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা। কয়েক বছর আগে নাকি সিবিআইয়ের হেফাজত থেকে গায়েব হয়ে যায় ১০৩ কেজি সোনা। ২০১২ সালে সিবিআই চেন্নাইয়ে এক অভিযান চালিয়ে প্রায় চারশো কেজি বেআইনি সোনা বাজেয়াপ্ত করেছিল। ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে অর্থাৎ দেশে কোভিডের ডামাডোলের সময় সকলের অজান্তে একশো কেজিরও বেশি সোনা গায়েব হয়ে যায়। পরে সিবিআই থেকে সাফাই দিয়ে বলা হয়েছিল, সোনার হিসেব করতেই ভুল করেছিলেন অফিসাররা। এও সম্ভব? হ্যাঁ, সবই সম্ভব। বিজেপিরই তো স্লোগান, মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়!
এরকম দুর্নীতির তালিকা করলে তা বিশাল হয়ে যাবে। ব্যাপম কেলেঙ্কারির কথা কি আমরা ভুলে গিয়েছি? ভুলিনি রাফাল যুদ্ধবিমান কেনার দুর্নীতির কথাও। দেশের মানুষ মনে রেখেছেন পেগাসাস দুর্নীতির কথাও। এছাড়াও তেলের মূল্যবৃদ্ধি, অমিত-পুত্র জয় শাহের অস্বাভাবিক সম্পত্তি বৃদ্ধি নিয়ে অভিযোগ, ইয়েদুরাপ্পা ও স্মৃতি ইরানির জমি কেলেঙ্কারি নিয়ে অভিযোগ কোথায় যে ধামাচাপা পড়ে রয়েছে কেউই জানেন না। আদানির ফুলে
ফেঁপে ওঠার পিছনে মোদিজির কোনও আশীর্বাদ আছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। শুধুই প্রশ্ন, কোনও উত্তর মেলে না।
যে শারদ পাওয়ারের দলের বিরুদ্ধে মোদিজি ৭০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ এনে হুঙ্কার ছাড়ছিলেন, রাত পোহাতেই সেই দল ভেঙে তাদের অন্যতম মাথাকে উপ মুখ্যমন্ত্রী করে মহারাষ্ট্রের কুর্সি বাঁচাল বিজেপি। কোন খেলা যে খেলবে কখন, ভাবছ বসে সেই কথাটাই! এটাই বারবার দেখা গিয়েছে। বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপি তার শক্তি বাড়ানোর জন্য বারবার কেলেঙ্কারির ঘটনায় অভিযুক্তদের হাত ধরে বড় হতে চেয়েছে। কখনও কলঙ্কিতদের সংগঠনের প্রধান করেছে, কখনও তাঁদের বিরোধী নেতা করেছে, আবার কখনও তাঁদের মুখ্যমন্ত্রীও করে দিয়েছে। আর উল্টোদিকে সভায় সভায় মোদিজি বুক বাজিয়ে বলেছেন, তিনিই নাকি দুর্নীতির বিরুদ্ধে একমাত্র গ্যারেন্টার। দুর্নীতির ঠাকুরদাদা বিজেপির নেতারা যখন এসব কথা বলেন, সত্যিই মানুষ হাসেন, তাঁদের করুণা করেন। কেননা কোনও নেতার যদি কথায় ও কাজে মিল না থাকে, তাহলে তাঁর দাম কমতে থাকে। গত সাড়ে নয় বছরে জনসমর্থনের বিচারে মোদিজির দামও অনেকটাই কমে গিয়েছে। সেটা দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, আরএসএস ভালোই বুঝতে পারছে। সেই সঙ্কট থেকেই সঙ্ঘের ভিতরে ঘনঘন বৈঠক চলছে। মোদির আলো ফিকে হয়ে আসায় আরও দমদার ব্যাটারি সম্পন্ন নেতার মুখ খুঁজছে তারা। দু’একজন যোগী আদিত্যনাথের নাম করেছিলেন। কিন্তু তাঁর উপরও দল ভরসা রাখতে পারছে না। কেননা যোগীজির ‘ঠোক দো’ মার্কা নীতি সারা দেশে চালু হলে সমূহ বিপদ। তাই অস্তমান মোদিজির দিকে তাকিয়ে আর একটা ম্যাজিক মুখের সন্ধানে সঙ্ঘ পরিবার। তাঁরাও বুঝেছেন, দুর্নীতির ধুয়ো তুলে আর সিবিআইয়ের ডান্ডাবাজি দিয়ে বেশিদিন মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। সিবিআই তদন্ত মানেই এখন অনেকাংশে ব্যক্তি-নিগ্রহ। তাই বিজেপির উজ্জ্বল প্রদীপের নীচে দিনে দিনে ঘন হয়ে জমছে অন্ধকার। এ এক এমন অন্ধকার, যার কথা ভাবলেই শেক্সপিয়রের ট্রাজেডির নায়কদের পরিণতির কথা মনে পড়ে।