পুরনো রোগের বৃদ্ধিতে স্বাস্থ্যহানির সম্ভাবনা। ব্যবসায় শুভত্ব বজায় থাকবে। আর্থিক প্রগতিও হবে। ... বিশদ
রাজ্যের শাসক দল এবার অনেক পরিকল্পনা করে পঞ্চায়েত ভোটে এগচ্ছে। পঞ্চায়েতের ফল থেকেই নেতৃত্ব বুঝতে পারবে, লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির মোকাবিলায় তারা কতটা তৈরি। সেই জন্যই নির্বাচনের অনেক আগে থেকে বেশিরভাগ আসনে নির্বাচন করানোয় জোর দিয়েছে। তাতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতা আসনের সংখ্যা এক ধাক্কায় প্রায় ২৫ শতাংশ কমেছে। পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতি স্তরের ভোটে প্রার্থীর ব্যক্তিগত প্রভাব ও পরিচিতি অনেকটাই কাজ করে। অনেকে দলীয় প্রতীক ভুলে ‘কাছের মানুষ’কে ভোট দেন। ফলে গ্রাম পঞ্চায়েতে কোন দল কত আসন পেল, সেটা দিয়ে প্রকৃত জনমত যাচাই করা যায় না। জনসমর্থন মাপার আসল মাপকাঠি জেলা পরিষদের ফলাফল। এই স্তরে একেবারে প্রতীক চিহ্নের উপর ভিত্তি করে ভোট হয়। গ্রামসভার ছ’হাজারের কিছু বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ভোট হচ্ছে জেলা পরিষদের প্রায় একশো শতাংশ আসনে। তাতেই বোঝা যাবে, কোন দলের কী অবস্থা। জেলা পরিষদের ভোটে শাসক দল সরকারি পরিষেবার বেনিফিটটা পাবে। কারণ পঞ্চায়েত স্তরে প্রার্থী পছন্দ না হওয়ার খেসারতটা জেলা পরিষদে তাদের দিতে হবে না।
প্রার্থী বাছাইয়ের পদ্ধতির কারণে শাসক দলে বিক্ষুব্ধের সংখ্যাটা একটু বেশি। এতদিন ব্লক ও জেলা নেতৃত্বের পাঠানো তালিকা ধরে প্রার্থী ঠিক হতো। তাতে দাপুটেদের নাম থাকত বেশি। ফলে ট্যাঁ ফোঁ করার সাহস কেউ খুব একটা দেখাত না। কিন্তু এবার জেলায় জেলায় ঘুরে এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রার্থী ঠিক করা হয়েছে। তাতে বহু পঞ্চায়েত প্রধান, পঞ্চায়েত সমিতির ও জেলা পরিষদের কর্তাব্যক্তি বাদ পড়েছেন। আবার অনেক পুরনো কর্মী এবং স্বচ্ছ ইমেজের মানুষ প্রার্থী হয়েছেন।
তবে, যাঁরা তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন তাঁরা সকলেই যে ধোয়া তুলসীপাতা, এমনটা মোটেই নয়। তোলাবাজি ও দুর্নীতিতে অভিযুক্ত অনেকেই টিকিট পেয়েছেন। পাশাপাশি এটাও ঠিক, ছাঁকনিতে অনেক রাঘববোয়াল আটকে গিয়েছেন। মূলত তাঁরাই নেতৃত্বকে শিক্ষা দিতে নির্দল প্রার্থী হয়েছেন অথবা দাঁড় করিয়েছেন। শাসক দলের জন্য বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেসের চেয়েও অনেক জায়গায় বিপজ্জনক বিক্ষুব্ধ নির্দল প্রার্থীরা। কারণ পাঁচ বছর শাসক দলের জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাঁরাই পরিষেবা দিয়েছেন। সেই সুবাদে কিছু অনুগামী তৈরি হয়েছে। তার একটা অংশের ভোট নির্দলদের দিকে যাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সেকথা মাথায় রেখেই দলের বিক্ষুব্ধ নির্দল প্রার্থীদের জন্য কঠোর স্ট্যান্ড নিয়েছে শাসক দল।
তবে, তৃণমূল নেতৃত্ব নির্দলদের বহিষ্কারের হুঁশিয়ারি দিতেই ছবিটা বদলাতে শুরু করেছে। অনেকেই বলছেন, ‘রাগের বশে এলাকার লোকজনের কথায় প্রার্থী হয়েছিলাম। কাজটা ঠিক হয়নি। তাই নির্বাচন থেকে সরে এসেছি। দলীয় প্রার্থীর হয়ে প্রচারও শুরু করে দিয়েছি।’
কেন নির্দল প্রার্থীরা একথা বলছেন? সপ্তাহ খানেক আগেও যাঁরা ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’ বলে মনোনয়ন দাখিল করেছিলেন, তাঁরা কেন দলীয় অনুশাসন মেনে নিচ্ছেন? কারণ নেতৃত্ব জানিয়ে দিয়েছে, শুধু নির্দল প্রার্থীদেরই নয়, তাঁদের মদতদাতাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তারজন্য শীর্ষ নেতৃত্ব নাকি পুলিসের কাছ থেকে খোঁজখবরও নিচ্ছে। আর তাতেই বিক্ষোভের আঁচে হাওয়া দেওয়ার জন্য হাতপাখা নিয়ে ঘোরা নেতারা এখন নিজেদের ঘাম শুকাতেই ব্যস্ত।
এই অবস্থায় দেরি করলে গাছ থেকে নামার জন্য ঝাঁপ দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। তাতে আবার হাত-পা ভাঙার ভয় প্রবল। একথা মাথায় রেখেই লিফলেট ছাপিয়ে ‘আমি তোমাদেরই লোক’ প্রমাণের চেষ্টা শুরু হয়েছে। হুগলির পুরশুড়ায় একদিনে ৬৭ জন লিফলেট ছাপিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। শুধু পুরশুড়া বা আরামবাগে নয়, প্রতিটি জেলায় চলছে লিফলেট বিলি। নির্বাচন এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে সেই সংখ্যাটা।
নির্দল প্রার্থী দাঁড় করানোয় শীর্ষে রয়েছে মুর্শিদাবাদ জেলা। গ্রাম পঞ্চায়েতের ৫৫৯৩টি আসনের জন্য ২৩৩২জন, পঞ্চায়েত সমিতিতে ৭৪৮টি আসনের জন্য ৪৭৯ এবং জেলা পরিষদের ৭৮টি আসনের জন্য ৬৭জন নির্দল প্রার্থী লড়াই করছেন। এঁদের বেশিরভাগই শাসক দলের। যে চারজন বিধায়ক সরাসরি নির্দলদের পক্ষ নিয়েছিলেন, তারমধ্যে তিনজনই রণে ভঙ্গ দিয়েছেন। কিন্তু হুমায়ুন কবীর এখনও ‘বিদ্রোহী’। তিনি নির্দলদের জেতাতে মরিয়া।
হুমায়ুন কবীর অবশ্য নিজেকে ‘বিদ্রোহী’ বলতে নারাজ। তাঁর দাবি, প্রার্থী নির্বাচনে ১০ মাসের ব্লক সভাপতি যে গুরুত্ব পেয়েছেন, তিনি ২৫ মাসের বিধায়ক হয়েও তা পাননি। জেলা নেতৃত্বকে শিক্ষা দিতেই নাকি দলের যোগ্যদের নির্দল হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। তাতে লাভ হবে তৃণমূলেরই। কারণ বিক্ষুব্ধদের ভোট জোটপ্রার্থীর দিকে যাবে না। তাঁর হিসেবে মুর্শিদাবাদ জেলায় তৃণমূলের ভোট ৭০ শতাংশ। এই ভোট তৃণমূলের দুই প্রার্থীর মধ্যে ভাগ হলেও একজন অবশ্যই জোট প্রার্থীর চেয়ে বেশি পাবেন। ফলে জিতবে সেই তৃণমূলই ।
হুমায়ুন সাহেবের যাবতীয় ক্ষোভ জেলা নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। কিন্তু তা প্রকাশের ধরনে ক্ষুব্ধ শীর্ষ নেতৃত্ব। এখনই কোনও পদক্ষেপ করেনি মানে এই নয়, ভবিষ্যতেও করবে না। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় মঙ্গলবার ফের জানিয়ে দিয়েছেন, ‘পঞ্চায়েত ভোটের পর নির্দল ও বিক্ষুব্ধদের ব্যাপারে আরও কঠোর হবে দল।’ হুমায়ুন করীব পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ। কোন দলে গেলে আর কোথায় থাকলে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে, সেটা তিনি ভালোই বোঝোন। তাই ইসলামপুরের বিধায়ক আব্দুল করিমের স্টাইলে বিদ্রোহ করেও শেষ পর্যন্ত ব্রেক কষেছেন। বহরমপুরে বিক্ষোভ সভা ডেকেও তা শুধু বাতিল করেননি, ডোমকলে ছুটেছিলেন অভিষেকের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু সাক্ষাৎ হয়নি। তার কারণ রোডশোয়ের ‘ভিড়’ নাকি ‘উপেক্ষা’? প্রশ্নটা আপাতত তোলা থাকল।
অভিযোগ উঠেছে, মুর্শিদাবাদ জেলায় বহু টিকিট নাকি মোটা টাকার বিনিময়ে বিক্রি হয়েছে। তাতে অনেক যোগ্য প্রার্থী বঞ্চিত হয়েছেন। তবে, দল যাঁকে টিকিট দিয়েছে তাঁকে প্রার্থী হিসেবে মেনে নেওয়াটাই দলীয় শৃঙ্খলা। কিন্তু দলীয় সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করলে শক্ত হয় বিরোধীদের হাত। তাই বিক্ষুব্ধদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তৃণমূল নেতৃত্ব।
পঞ্চায়েত ভোটে টিকিট বিলির ক্ষেত্রে গুরুত্ব পেয়েছেন তৃণমূলের জেলা ও ব্লক সভাপতিরা। অনেকে বলছেন, জনপ্রতিনিধিদের চেয়েও পার্টির সংগঠনকে বেশি গুরুত্ব দিতে চাইছে নেতৃত্ব। পঞ্চায়েতের জনপ্রতিনিধিদের উপর পার্টির নিয়ন্ত্রণ থাকলে দুর্নীতিতে লাগাম টানা সহজ হবে। জনপ্রতিনিধি দল বদলালেও সেই এলাকা দ্রুত মেরামত করা যাবে। সেই কারণে দু’চারজন বিধায়কের ক্ষোভকে রাজ্য নেতৃত্ব আমল দিতে চাইছে না।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, নির্বাচনের পর নির্দলদের দলে না ফেরালে লাভ হবে তৃণমূলেরই। বিরোধীদের মদতে নির্দলদের কেউ কেউ জিততেই পারেন। কিন্তু তাঁদের ফেরানো উচিত হবে না। তাতে কিছু পঞ্চায়েত হাতছাড়া হলেও সুদৃঢ় হবে দলীয় অনুশাসন। এর আগেও পুরভোটে নির্দলদের নেওয়া হবে না বলে ঘোষণা করেছিল নেতৃত্ব। কিন্তু সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেনি। নির্দল কাউন্সিলারকে নিয়ে ঝালদায় বোর্ড গঠন করেও তা ধরে রাখতে পারেনি। ফের সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে নেতৃত্বের হুঁশিয়ারিকে সবাই ফাঁকা আওয়াজ বলে মনে করবে। কিন্তু সিদ্ধান্তে অটল থাকলে? লাগাম পড়বে বহুচর্চিত তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে।