পুরনো রোগের বৃদ্ধিতে স্বাস্থ্যহানির সম্ভাবনা। ব্যবসায় শুভত্ব বজায় থাকবে। আর্থিক প্রগতিও হবে। ... বিশদ
বেশ কিছু বছর আগে পর্যন্ত আঁতকে উঠতাম আমরা এটা শুনে যে, গ্রেটার নয়ডার কোনও জনপদে একটি বাড়ির ফ্রিজে গোমাংস পাওয়া গিয়েছে এই অপরাধে ওই বাড়ির এক সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। অথবা ম্যাটাডোরে করে গোরু পাচার করার অভিযোগে গাছে বেঁধে পেটাতে পেটাতে মেরে ফেলা হয়েছে কাউকে। হিন্দু মুসলিম যাকে তাকে যখন তখন কান ধরে ওঠবোস করিয়ে বলতে বলা হয়— জয় শ্রীরাম! বাংলার বাইরে একটু নিম্নবর্গ ও গরিব গরিব দেখতে হলেই হিন্দু হোক আর মুসলিম, সকল বাংলাভাষীকে তকমা দেওয়া হয় বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী! দিল্লি, মুম্বই, বেঙ্গালুরু, জয়পুর সর্বত্র বাংলা থেকে যাওয়া এই নিম্নবিত্ত যে মানুষজন গিয়ে গৃহপরিচারিকা, সিকিউরিটি গার্ড কিংবা রিকশচালকের কাজ করে চলেছে, তাদের সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতে হয় কখন বলা হবে সে বাংলাদেশি। অসমে বহু প্রকৃত ভারতবাসী হিন্দু ও মুসলিম মানুষকে ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ইতিহাস পাল্টে দেওয়া হচ্ছে। মিথ্যা ইতিহাস সিলেবাসে প্রবেশ করছে। আজকাল লক্ষ্য করা যায় যে, এসব ঘটনা শুনলে আগের মতো তীব্র অভিঘাত হয় না। কেন? কারণ গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। আজকাল তো এরকমই হচ্ছে চারদিকে! এরকম উদাসীন বাক্য ভেবে নিয়ে আমরা অন্য কাজে মনোনিবেশ করি।
অভিন্ন দেওয়ানি বিধি হলে কী হবে? কারা কারা বিপদে পড়বে? কাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে? কাদের খুব উপকার হবে? এসব আলোচনা আগামী কয়েকমাসের মধ্যেই ভারতবর্ষের অন্যতম একটি বিতর্ক এবং আলাপচারিতার অঙ্গ হয়ে উঠবে। জানুয়ারি মাসের মকর সংক্রান্তির পর অযোধ্যায় রামমন্দির হবে। যার পুরোদস্তুর কৃতিত্ব হিসেবে প্রচার করা হবে প্রধানমন্ত্রী ও নবরূপের এই ভারত রাষ্ট্রের শাসকদের জয়গান। কেমন হবে সেই মন্দির? এসব নিয়ে আমাদের অন্তহীন তর্ক চলে। আমরা তর্ক করতে ভালোবাসি। কথা বলতে ভালোবাসি। কেউ প্রশ্ন না করলেও যে কোনও বিষয়ে মতামত দিতে ভালোবাসি। রাষ্ট্র ও কর্পোরেট আমাদের সুযোগ করে দেয় কথা বলার। রাষ্ট্র দেয় প্রতিদিন নতুন নতুন ইস্যুর জোগান। কর্পোরেট দেয় সোশ্যাল মিডিয়ার প্ল্যাটফর্ম।
আর এসব থেকে অনেক দূরে বিহারের সমস্তিপুরে কী হয়? দীপক নামে এক ১৪ বছরের কিশোর ৫ জুলাই ২০২৩ সালে লবণ এবং ডাল আনতে গিয়ে মুদিখানার কর্মীর অলক্ষ্যে একটি লজেন্স নিয়েছিল। যাকে সাদা চোখে অবশ্যই চুরি বলে। আর সেই অপরাধে সকাল ৯ টা থেকে সেই কিশোরকে দড়ি দিয়ে বেঁধে মাটিতে ফেলে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত লাগাতার মারা হয়েছে লাঠি দিয়ে। কোনও রাজনীতিক অথবা নেতা আশপাশে ছিলেন না। যদিও মুদিখানার কর্মীর কথায় ওই কিশোর মিথ্যা বলেছে। কারণ, আসলে তার অপরাধ নাকি অনেক বেশি। লজেন্স নয়। সে এক টাকার কয়েন চুরি করেছে!
এই প্রাত্যহিক নানাবিধ জীবনযাপন থেকে অন্য একটি জগতে চলে যাওয়া ৫ লক্ষ ৩১ হাজার ৯১০ জন (আজকের তারিখ পর্যন্ত) মৃত হতভাগ্যকে আমরা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছি। কারা তারা? ২০২০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ভারতে করোনা সংক্রমণে মৃত্যু হয়েছে এই ৫ লক্ষ ৩১ হাজার ৯১০ জন দেশবাসীর। পরিজনের চোখের সামনে বাবা, মা, সন্তান, বোন, ভাই, প্রতিবেশী, বন্ধুরা কখনও অক্সিজেনের অভাবে, কখনও অ্যাম্বুলেন্সের অপ্রাপ্তিতে, কখনও ওষুধ না পেয়ে এবং হাসপাতালে স্থান না হওয়ায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে অসময়ে। রাষ্ট্রের আহ্বানে তারা ভোট দিয়েছিল। ট্যাক্স দিয়েছিল। থালা বাজিয়েছিল। কিন্তু বিনিময়ে রাষ্ট্রের কাছে উপেক্ষা পেয়েছিল সবথেকে প্রয়োজনের মুহূর্তে।
রাষ্ট্র কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল? ২০২০ সালের ২৪ মার্চ প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, মহাভারতে ১৮ দিনে যুদ্ধজয় হয়েছিল। আমরা ২১ দিনে করোনাকে হারিয়ে দেব। ২১ দিন নয়, ১৫ মাস পরও ২০২১ সালের জুন মাসে মহামারী হিসেবে করোনা নিজের মৃত্যু উৎসব জারি রেখে এগিয়ে চলেছিল। সাড়ে তিন লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়ে গিয়েছিল ততদিনে। প্রতিদিন মৃত্যু হয়েই চলেছিল। বাড়িতে, রাস্তায়, হাসপাতালে।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শ্রীরামচন্দ্র মিশনের এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, প্রতিটি জীবন আমাদের কাছে মূল্যবান। মানবিকভাবে এই সঙ্কটকে আমরা মোকাবিলা করব। বাস্তবে কী হয়েছিল? ওই প্রতিশ্রুতির ঠিক তিন মাসের মধ্যে ১০ থেকে ১৫ মে, এই পাঁচদিন ধরে বিহার ও উত্তরপ্রদেশের একের পর এক গঙ্গাতীর থেকে দেখা গিয়েছিল শয়ে শয়ে অজ্ঞাতপরিচয় মৃতদেহ ভেসে যাচ্ছে। করোনায় যাদের মৃত্যু হয়েছে এবং দাহকার্য করা সম্ভব হয়নি।
গ্রামগঞ্জ নয়, খোদ দিল্লি ও অমৃতসরের দুই হাই প্রোফাইল হাসপাতালে ভর্তি করোনা রোগীদের আত্মীয়কে একদিন সকালে বলে দেওয়া হয়েছিল, অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। যে কোনও সময় বন্ধ হয়ে যাবে। অক্সিজেনের টিউব ও মাস্ক লাগিয়ে ধীরে ধীরে রোগীরা বুঝতে পেরেছে কখন কমে যাচ্ছে অক্সিজেন। তারপর তাদের মৃত্যু হয়েছে। কখন? যখন ঘোষণা করা হচ্ছে স্বাধীনতার ৭৫ বছরের অমৃত মহোৎসব পালিত হবে এই বছর থেকে! ২০২১ সালের ১৮ এপ্রিল দিল্লিতে পীতমপুরা থেকে ফর্টিস হাসপাতাল পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার দূরত্বের জন্য প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্সের চার্জ নেওয়া হয়েছিল ১০ হাজার টাকা! জীবনদায়ী ওষুধ র্যামডিসিভির কত টাকায় কিনতে হয়েছে? ৭০ হাজার থেকে ১ লক্ষ ১০ হাজার টাকায়!
২০২৩ সালে এসে আমরা কী দেখছি আমাদের আশপাশে? প্রচুর হাসপাতাল তৈরি করেছে রাষ্ট্র? অসংখ্য অক্সিজেন প্ল্যান্ট চোখের সামনে গড়ে উঠেছে? ঝাঁকে ঝাঁকে এইমস হয়েছে রাজ্যে রাজ্যে? হয়নি। প্রতিশ্রুতি ছিল, প্রত্যেক রাজ্যে একটি করে কেন্দ্রীয় হাসপাতাল হবে, যেখানে সংক্রমণের চিকিৎসা হবে। সেটা কি আদৌ হল? হল না। তাহলে কী হয়েছে? হেলথ ইনসিওরেন্সের প্রিমিয়াম ২৫ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। ওষুধের দাম বছরে দুবার করে বাড়ানো চলছে। হাসপাতালের বেড চার্জ এবং সার্ভিস চার্জ আকাশছোঁয়া হয়ে চলেছে। অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি, সিটি স্ক্যান, যে কোনও ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা অথবা ৮০০টি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত হয়েছে।
২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে গোটা দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো বদলে ফেলাই একমাত্র লক্ষ্য হওয়ার কথা ছিল না? কী পার্থক্য হয়েছে ২০২০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত চিকিৎসা পরিষেবার? কেন হয়নি? আমরা কি ভোটযন্ত্রের সামনে গিয়ে এসব ভাবি? একেবারেই ভাবি না। কেন ভারতে রান্নার গ্যাসের দাম বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক? আমরা ভাবি? একেবারেই না। কারণ রাষ্ট্র জানে সাধারণ মানুষের সবথেকে প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্য হল, ভুলে যাওয়া। আমরা ৫ লক্ষ ৩১ হাজার ৯১০ জনকে ভুলে গিয়েছি। প্রতিটি নারকীয় মুহূর্ত ভুলে গিয়েছি। মূল্যবৃদ্ধি ভুলে যাই। চাকরি না হওয়া ভুলে যাই। ফলে সুবিধা হয়েছে রাষ্ট্রের। তারাও নানারকম কথার খেলায় আমাদের ভুলিয়ে রাখছে। একটি চিরন্তন ভাগ্যচক্রের জন্ম হয়েছে। আমরা ভুলে যাই রাষ্ট্রের ব্যর্থতা! তাই রাষ্ট্রও ভুলে যায় আমাদের! তাহলে রাষ্ট্র কী চায় আমাদের কাছে? নিঃশর্ত ট্যাক্স এবং প্রশ্নহীন ভোট!