পুরনো রোগের বৃদ্ধিতে স্বাস্থ্যহানির সম্ভাবনা। ব্যবসায় শুভত্ব বজায় থাকবে। আর্থিক প্রগতিও হবে। ... বিশদ
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর উর্জিত প্যাটেল সকলের দিকে তাকালেন। আলোচনা শুরু হল। প্রায় এক ঘণ্টা সকলে মতামত দিলেন। কিন্তু কী সেই প্রস্তাব? কীই বা সিদ্ধান্ত হল সাম্প্রতিককালের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সেই বৈঠকে? প্রস্তাবটি হল—ভারত সরকার চাইছে ১,০০০ এবং ৫০০ টাকার নোট সম্পূর্ণ বাতিল করে দেওয়া হোক। আর সিদ্ধান্ত... সেটা সকলেরই জানা!
মিটিং শেষে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সেন্ট্রাল বোর্ড তাদের মিনিটস বুকে লিপিবদ্ধ করল সেই সিদ্ধান্ত, পরামর্শ এবং মতামত। কী ছিল সেখানে? বলা হয়েছিল, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সেন্ট্রাল বোর্ড দীর্ঘ আলোচনার পর মনে করছে, যে উদ্দেশ্যে এই নোটবাতিল করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত সরকার নিতে চাইছে, তা সফল হবে না। কালো টাকা আর সন্ত্রাসবাদ বিরোধী অভিযানে প্রভাব পড়বে সামান্যই। কেন? রিপোর্টে লেখা হল, এর কারণ সিংহভাগ কালো টাকা এখন ক্যাশে রাখাই হয় না। সোনা এবং রিয়াল এস্টেটেই রয়েছে সবথেকে বেশি ব্ল্যাক মানি। তাই নোট বাতিল করে লাভ নেই তেমন। শুধু তা-ই নয়, সেই রিপোর্টে সরকাকে সতর্কও করা হল—একবার এই দুই প্রধান নোট বাতিল করে দিলে, জিডিপির উপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। অর্থাৎ অর্থনীতি ধাক্কা খাবে। কারণ, পর্যটন, মেডিক্যাল, রিয়াল এস্টেট, পরিষেবা এবং কনস্ট্রাকশন এসব সেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ এই সেক্টরগুলি মূলত চালিত হয় নগদে।
পৌনে সাতটা। মিটিং শেষ। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সেই মনোভাব এবং মতামত তৎক্ষণাৎ অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিকে জানিয়ে দিলেন ইকনমিক অ্যাফেয়ার্স সেক্রেটারি শক্তিকান্ত দাস।
প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন। ৭ নম্বর লোককল্যাণ মার্গ। নয়াদিল্লি। রাত ৮টা।
প্রধানমন্ত্রী প্রি-রেকর্ডেড ভাষণে দেশবাসীকে জানিয়ে দিলেন, আজ রাত থেকেই এক হাজার এবং ৫০০ টাকার নোট বাতিল হয়ে যাচ্ছে। গোটা দেশ চমকে গেল। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল কোটি কোটি ভারতবাসীর। কিন্তু সেটার থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ হল, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সেন্ট্রাল বোর্ড সদস্যরা বুঝলেন তাঁদের ওই সব মিটিং, মতামত, রিপোর্টের কোনও মূল্য নেই। সরকার এই সিদ্ধান্ত একতরফাভাবে আগেই নিয়েছে। সুতরাং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মতামত চাওয়া নিছক এক প্রতীকী ভদ্রতা ছিল। গভর্নর উর্জিত প্যাটেল অবশ্য আন্দাজ করতে পেরেছিলেন যে, এরকম কিছু ঘটতে চলেছে। কারণ, বিগত কিছু মাস ধরে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশিকায় দেশের কয়েকটি মিন্ট অর্থাৎ টাঁকশালে ২,০০০ টাকার নতুন নোট ছাপা হচ্ছে। তাঁকে বলা হল, ওই টাকা আরও বেশি করে রিলিজ করো। যাতে এই নোট বাতিলের হাহাকার বেশি ছড়াতে না পারে। পরদিন উর্জিত প্যাটেল ঘোষণা করলেন, ১০ নভেম্বর থেকে ব্যাঙ্কে পাওয়া যাবে ২,০০০ টাকার নোট।
কিন্তু কত টাকা পাওয়া যাবে সেদিন ওই বড় নোটে? মাত্র ৯৪ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা। আর কত মূল্যের নোট বাতিল হয়ে গেল? প্রায় ১৭ লক্ষ কোটি টাকা! এই বিরাট শূন্যতা পূর্ণ করা যাবে কীভাবে? যাবে না! যায়ওনি। তাই গোটা ভারত লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ল। হাহাকার করল। হাজার হাজার কারখানা বন্ধ হয়ে গেল। শতাধিক মানুষের মৃত্যু হল। প্রান্তে প্রান্তে আত্মহত্যার ঘটনা হল। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পক্ষ থেকে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় প্রতিটি টাঁকশালে নির্দেশ দেওয়া হল তাড়াতাড়ি আরও বেশি বেশি করে ২,০০০ টাকার নোট ছাপাও। সঙ্গে নতুন ৫০০ টাকা। কিন্তু তা কীভাবে বিলি হবে? কেন এটিএম থেকে! কোটি কোটি মানুষ লাইন দিয়েছে তার সামনে। টাকা ছাপা হচ্ছে। কিন্তু লাইন কমছে না। কেন?
কারণ, ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন ব্যাঙ্কের ২ লক্ষ ২০ হাজার এটিএম মেশিনের মধ্যে চারটি কাস্কেট ছিল। দুটো ৫০০ টাকার, একটি ১,০০০ ও একটি ১০০ টাকার নোটের। এর মধ্যে ৫০০ ও ১,০০০ টাকার নোট বাতিল। ২,০০০-এর নোট ছাপা তো হচ্ছে, কিন্তু এটিএমে থাকবে কোথায়? ওই আকারের কাস্কেটই তো নেই এটিএমে! অতএব মানুষ লাইন দিয়ে যখন এটিএমের সামনে পৌঁছচ্ছে, তখন প্রথম তারা পাচ্ছে শুধুই ১০০ টাকার নোট। অল্পসময়ের মধ্যে যা শেষ হয়ে যাচ্ছে। ফলে হাহাকার কমল না।
তাহলে কী করতে হবে? এই ২ লক্ষাধিক এটিএম রিক্যালিব্রেট করতে হবে। অর্থাৎ নতুন একটি কাস্কেট তৈরি করে বসাতে হবে, যেখানে ২,০০০ টাকার নোট রাখা যায়। সেই প্রক্রিয়া দীর্ঘ! কেন? কারণ, ব্যাঙ্ক, এটিএম নির্মাণকারী সংস্থা, ন্যাশনাল পেমেন্ট কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া এবং সুইচ অপারেটরদের সমন্বয়ে কাজটি সম্পন্ন করতে হয়, যা দীর্ঘ ও জটিল এক পদ্ধতি। প্রত্যেকটি এটিএম মেশিনকে পরিদর্শন করতে হয় ইঞ্জিনিয়ারদের। একে বাইরে লম্বা লাইন আর যখন তখন এটিএম মেশিন বন্ধ করে এসব কাজ করা সম্ভব নাকি? মাঝরাতে কতটাই বা করা সম্ভব? অতএব এই নতুন নোটের জন্ম দিয়ে সঙ্কট আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
অবশেষে যখন ২,০০০ টাকার নোট বেশি বেশি করে বাজারে এল তখন কী কী হল? ১) খারাপ প্রিন্টিং। মহাত্মা গান্ধীর মুখের উপর তাঁরই সেই ছবির ছায়া ছাপা হয়েছে। ২) বর্ডারলাইন ঠিক ছিল না ৩) রং এবং শেডস বিভিন্ন নোটে পৃথক। এসবের সাইড এফেক্ট? গ্রামাঞ্চলে সর্বাগ্রে সাধারণ মানুষ প্রতারিত হল হাজার হাজার হাই রেজোলিউশন ফোটোকপি করা নোট পেয়ে। অপরাধীরা তা চালিয়ে দিয়েছে। এবং সর্বোপরি, ক্রমে দেখা গেল শহর অথবা গ্রাম, সিংহভাগ মানুষই নিতে চায় না এই বড় নোট। ২০১৮ সালে বাজারে মোট চালু নোটের ৩৭ শতাংশ ছিল ২,০০০ টাকা। সেই সংখ্যা কমতে কমতে ২০২৩ সালের মার্চ মাসে হয়েছে ৯ শতাংশ।
২০২০ সাল থেকে এই নোট ছাপাই বন্ধ করে দিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। কেন! কারণ, অভ্যন্তরীণ সমীক্ষায় তারা জানতে পেরেছিল, এই টাকাকে মানুষ বিশ্বাস করছে না। আর সিংহভাগ মানুষ ব্যবহারও করে না। নেয়ও না। দেয়ও না। তাই সম্প্রতি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অবশেষে ঘোষণা করল, ২০০০ টাকার নোট ব্যাঙ্কে জমা দিতে কিংবা বদলে নিতে পারবে দেশবাসী। কিন্তু নোট বাতিল হচ্ছে না। নোট বৈধ। তাহলে ফেরৎ নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে কেন? উত্তর নেই। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এই টাকা জমা নেওয়া বা বদল চলবে। তারপর? এই নোট অবৈধ হয়ে যাবে? উত্তর নেই। তাই বৈধ হওয়া সত্ত্বেও এই নোট আর কেউ এখন লেনদেন করছে না।
মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারায় মানুষ। পাহাড়ি আবহাওয়ার প্রতি বিশ্বাস নাও থাকতে পারে। রাজনীতিকে বিশ্বাস না করাও স্বাভাবিক। নিজের ভাগ্যে বিশ্বাস হারানোর কথা শোনা যায়। কিন্তু ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর এবং তৎপরর্তী ঘটনাপরম্পরায় স্বাধীনতার পর এক আশ্চর্য মনোভাবের জন্ম দিয়েছে ভারতবাসীর মনে। এই প্রথম সাধারণ মানুষ বৈধ টাকার নোটকেই আর বিশ্বাস করছে না!
ভারতের সিংহভাগ কালো টাকা ছড়িয়ে আছে সোনায়, বেনামি সম্পদে, বিদেশি মুদ্রা এবং জমি-বাড়ির লগ্নিতে। ঠাকুমার পুরনো কাঠের সিন্দুকে নগদ টাকা কোনও ব্যবসায়ী রেখে দেয় না! কে বলেছেন একথা? ২০১২ সালে ভারত সরকারের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ডাইরেক্ট ট্যাক্সেস দপ্তরের এক রিপোর্টে একথা লিখেছিলেন স্বয়ং চেয়ারম্যান। তাতে আরও লেখা হয়েছিল, কালো টাকার বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে ১৯৪৬ সালে এবং ১৯৭৮ সালে দু’বার নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেই দু’টি সিদ্ধান্তই চরম ব্যর্থ। পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়েছে যে, নোট বাতিল করে জনসাধারণের সঙ্কটই শুধু বেড়ে যায়। কালো টাকার কিছুই যায় আসে না।
২০১৪ সালের ৭ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারকে তৎকালীন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বোর্ড পরামর্শ তথা প্রস্তাব দিয়েছিল, নতুন ৫,০০০ এবং ১০,০০০ টাকার নোট ছাপার সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক। মূল্যবৃদ্ধি এবং কারেন্সি ম্যানেজমেন্ট এই দুই ক্ষেত্রেই বড় অঙ্কের নোট কার্যকর হয়। মোদি সরকার সেই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে বলে, যত ছোট নোট থাকবে, ততই কমবে কালো টাকা। অথচ ২০১৬ সালের ১৮ মে হঠাৎই ভারত সরকার রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে জানায়, ২,০০০ টাকার নোট চালু করার কথা ভাবা যেতে পারে। এখন থেকে প্রস্তুতি নেওয়া হোক। কেন? কারণ, তখন থেকেই সরকার স্থির করেছিল নোট বাতিল করা হবে!
ঠিক তিন মাস আগে অর্থাৎ ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তৎকালীন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর রঘুরাম রাজনের কাছে অর্থমন্ত্রক জানতে চেয়েছিল, ‘নোট বাতিল করা হলে, সেই সিদ্ধান্তটি কেমন হবে বলে আপনি মনে করেন? রঘুরাম রাজন বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয় দীর্ঘকালীন মেয়াদে কোনও লাভ হলেও হতে পারে। কিন্তু উপযুক্ত প্রস্তুতি ছাড়া এরকম সিদ্ধান্ত নিলে সাধারণ মানুষ এবং অর্থনীতির উপর যে প্রচণ্ড ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে সেটা সামাল দেওয়া দুঃসাধ্য! অনেক বেশি মূল্য চোকাতে হবে! তাই নোটবাতিল না করে অন্য কোনও বিকল্প নিয়ে ভাবা উচিত!’ ঠিক ছ’মাস পর ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর পদ থেকে ইস্তফা দেন রঘুরাম। আর ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে একই পথে হাঁটেন পরবর্তী গভর্নর উর্জিত প্যাটেলও। একের পর এক রিপোর্ট, একের পর এক গভর্নরের মতান্তরকে পাত্তা দেওয়া হয়নি। কিন্তু কেন?
২০১৩ সালের জুন মাসে পুনের ‘অর্থক্রান্তি’ নামক একটি সংস্থার প্রধান অনিল উকিল জানতে পারলেন, বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে নাম ঘোষণা হয়েছে নরেন্দ্র মোদির। মহারাষ্ট্রের লাতুরের এই মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার তখন অন্য কাজ ছেড়ে ভারতের অর্থনীতির সংস্কার নিয়ে গবেষণায় ব্যস্ত ছিলেন। তিনি কয়েকজন সহকর্মী নিয়ে আমেদাবাদ গেলেন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে। যদি একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া যায়। ১০ মিনিট চেয়েছিলেন। সোর্স মারফৎ। কিন্তু তিনি ভবিষ্যৎ ভারতের অর্থনীতি নিয়ে যে প্রেজেন্টেশন দিলেন সেটা মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেড় ঘন্টা ধরে দেখলেন। কিন্তু কোনও মন্তব্য করেননি। পরের বছর যখন সত্যিই প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেলেন মোদি, অনিল উকিলের ডাক পড়ল বেশ কয়েকবার। নানাবিধ বিষয়ে তাঁকে কথা বলতে বলা হয়েছিল অর্থমন্ত্রকের সঙ্গে। ২০১৩ সালে অনিল উকিল ৯০ মিনিট ধরে যে প্রেজেন্টেশন দিয়েছিলেন মোদির সামনে, সেটির মূল প্রতিপাদ্য ছিল, ভারতে চালু থাকা নোট বাতিল করে দিতে হবে! আবার নতুন করে নোট চালু করতে হবে। এটাই হবে অর্থসংস্কারের প্রথম পদক্ষেপ! ২০১৪ সালে তাঁকে ডেকে পাঠানোর পর সেই একই প্রস্তাব ও প্রেজেন্টেশন কয়েক বছর ধরে তিনি দিয়েছিলেন মোদি সরকারকে। কার সঙ্গে তাঁকে কথা বলতে বলা হয়েছিল? হাসমুখ আদিহার সঙ্গে। ভারত সরকারের ফিনান্সিয়াল সার্ভিস সেক্রেটারি!
ঘটনাচক্রে ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর ঠিক সেই সিদ্ধান্তই নেওয়া হয়েছিল। অনিল উকিলের দ্বিতীয় প্রস্তাব কী ছিল? ভারতের ট্যাক্স প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ বদলে দিতে হবে। সেই প্রক্রিয়াও কি চালু হয়েছে? ইনকাম ট্যাক্স প্রথার বিপুল বদল কি তারই ইঙ্গিত নয়?