পুরনো রোগের বৃদ্ধিতে স্বাস্থ্যহানির সম্ভাবনা। ব্যবসায় শুভত্ব বজায় থাকবে। আর্থিক প্রগতিও হবে। ... বিশদ
তিনের দশকের প্রথম দিকে নজরুলের ভালোবাসার বৃত্তে ঢুকে পড়ে রামপ্রসাদের শ্যামাসঙ্গীত। আপন খেয়ালে তিনি কণ্ঠে তুলে নেন ‘অপার সংসার, নাহি পারাবার’ এবং ‘মন রে, কৃষিকাজ জানো না’। বরদাচরণই কবিকে এই সময় রামপ্রসাদের একটি বই উপহার দেন। তা পড়ে কালী সাধনার প্রতি তাঁর আকর্ষণ আরও বাড়ে। লিখতে শুরু করেন শ্যামাসঙ্গীত।
শোনা যায়, ভোররাতের স্বপ্নে মা কালীকে কন্যারূপে দেখেন নজরুল। তারপরই ভেঙে যায় ঘুম। ধড়পড় করে উঠে বসেন কবি। কিছুক্ষণ ভাবনাচিন্তার পর মিলেমিশে একাকার কালি, কলম, মন। গানটি কী জানেন? ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন’। খুব ভালো করে গানটি পড়লে বা শুনলে বুঝবেন, আবেগের সঙ্গে কবির ভক্তির ভারসাম্য প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একইরকম। এই গানেই তিনি লিখেছেন, ‘পাগলী মেয়ে এলোকেশী নিশীথিনীর দুলিয়ে কেশ, নেচে বেড়ায় দিনের চিতায় লীলার রে তার নাইকো শেষ/সিন্ধুতে মা’র বিন্দুখানিক ঠিকরে পড়ে রূপের মানিক, বিশ্বে মায়ের রূপ ধরে না, মা আমার তাই দিগ্-বসন’। অর্থাৎ, মায়ের কন্যা এবং মাতৃরূপকে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন অনবদ্য শব্দবন্ধে। দর্শন এবং তত্ত্বের বেড়া ভেঙে মা কালী প্রতিভাত হয়েছেন শুধুমাত্র তাঁর চেতনায়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত প্রধানত তিন ধরনের। প্রথম পর্বে কন্যা এবং মাতৃরূপে মা কালীকে তিনি শব্দ ও সুরের সংমিশ্রণে পুজো করেছেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কবির মনে হয়েছে, মা অশুভনাশিনীও বটে। হালিশহরের সাধক কবি রামপ্রসাদ সেনের পর নজরুলই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি ২৪৭টি শ্যামাসঙ্গীত লিখেছিলেন। আর তাঁর গানের ইউএসপি? ভাব ও ভাষায় সহজ থাকা। তাই তো তাঁর কলম দিয়েই বেরিয়েছে, ‘মোর লেখাপড়া হ’ল না মা, আমি ‘ম’ দেখিতেই দেখি শ্যামা, আমি ‘ক’ দেখতেই কালী ব’লে নাচি দিয়ে করতালি।’
নজরুল ইসলামের জীবনের দরজায় বারবার কড়া নেড়েছে দুঃখ-যন্ত্রণা। তবে ভেঙে পড়েও উঠে দাঁড়িয়েছেন কবি। বিভিন্ন সমালোচনা গায়ে না মেখে স্বতন্ত্র পথে এগনোই ছিল তাঁর দর্শন। খ্যাতির দৌড়ে নিজেকে রাখতে চাননি কখনও। সাধের বাংলাদেশের বেতারেও একসময় তাঁর শ্যামাসঙ্গীত নিষিদ্ধ হয়েছিল। একবুক অভিমান নিয়ে ঘনিষ্ঠদের বলতেন, ‘জানি, আমার শ্যামাসঙ্গীত নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলে। কিন্তু নিজেকে বদলাতে পারি না। পয়সাওয়ালাদের তাঁবেদারি করা স্বভাবে নেই। রিকশাওয়ালাদের সঙ্গে নিয়েই জীবন আমার। অসাধারণ হওয়ার জন্য সাধারণকে ভোলা অসম্ভব।’
জীবনের মাঝপথে প্রায়শই ভক্তিভাবে টলমল করতেন কবি। পদস্খলনের আশঙ্কা ভুলিয়ে তাঁকে সহযোগিতার দু’হাত বাড়িয়ে দেয় কালী সাধনা। এমনই এক সন্ধ্যায় ‘মা, মা’ বলতে বলতে অক্লেশে লিখে ফেলেন, ‘ভক্তি, আমার ধূমের মত, ঊর্ধ্বে ওঠে অবিরত/শিব-লোকের দেব-দেউলে মা’র শ্রীচরণ পরশিতে।’
পরাধীন ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য নজরুল কলম ধরেছিলেন। এই পর্বেও মা কালী তাঁর সৃষ্টিতে বারবার এসেছেন। মহাশক্তির কাছে কবি ‘দীনতা ভীরুতা লাজ গ্লানি’ ঘোচানোর মন্ত্র চেয়েছেন। এই সময় তাঁর একাধিক শ্যামাসঙ্গীতে সমকালীন নিপীড়িত ভারতের ছবিও ফুটে উঠেছে। অসুর বিনাশিনী দিগবসনা মা কালীর কাছে শক্তি ভিক্ষা করে তিনি দেশবাসীকে দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হতে বলেছেন। এক সাক্ষাৎকারে নজরুলের মন্তব্য, ‘এক মায়ের কাছে আরেক মায়ের স্বাধীনতা ভিক্ষার মধ্যে বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই। এটা তো জীবনের তাগিদ। দেশ স্বাধীন হলে আমাদের চেতনাও মুক্ত হবে। কতদিন আর কারাগারের শিকলে মাকে বন্দিদশায় দেখব?’
জীবনের গোধূলি পর্যন্ত আদরের বুলবুলকে ভুলতে পারেননি কবি। কখনও মনে হয়েছে, মা কালীই হয়তো ছেলের সঙ্গে তাঁর দেখা করিয়ে দেবেন। এরকম ভাবনা থেকেই তিনি একদিন লিখে ফেললেন, ‘এই শ্মশানে ঘুমিয়ে আছে/ যে ছিল মোর বুকের কাছে,/ সে হয়ত আবার উঠবে জেগে মা ভবানীর নাম-গানে।’