পারিবারিক ধর্মকর্ম পালনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ। সন্তানের কর্মসাফল্যে গর্ব। গবেষণায় অগ্রগতি। ... বিশদ
উত্তরাখণ্ড দেবভূমি। ভারতবর্ষ ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শনার্থীরা আসেন এই দেবভূমিতে চারধাম যাত্রার জন্য। চারধামের সঙ্গে অথবা শুধু কেদারনাথ ও বদ্রীনারায়ণ দর্শনের সঙ্গে কার্তিকস্বামী মন্দিরও দেখে নেওয়া যায়। অনেক দিন ধরেই সেই ইচ্ছে ছিল মনে। ছিলাম শুধু সুযোগের অপেক্ষায়। বন্ধুরা যাওয়ার কথা বলতেই তাই একবারে রাজি হয়ে গেলাম। উত্তরাখণ্ডের রুদ্রপ্রয়াগ জেলায় অবস্থিত ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম কনকচৌরি। সেখান থেকেই শুরু হয় কার্তিকস্বামী মন্দিরের যাত্রাপথ।
কনকচৌরি দু’ভাবে যাওয়া যায়। কেদারনাথ ধাম যাওয়ার পথে হরিদ্বার থেকে দেবপ্রয়াগ হয়ে রুদ্রপ্রয়াগ ১৬০ কিমি ও সেখান থেকে কনকচৌরি আরও ৪০ কিমি পথ। দ্বিতীয় পথটি বদ্রী থেকে কর্ণপ্রয়াগ হয়ে পোখরি ও সেখান থেকে কনকচৌরি। আমাদের যাত্রা দ্বিতীয় পথ ধরেই। কর্ণপ্রয়াগ পৌছতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল, পোখরি যাওয়ার রাস্তার সৌন্দর্য অসাধারণ। দু’পাশে ঘন জঙ্গল, তারই মধ্যে দিয়ে একেঁবেঁকে গিয়েছে রাস্তা। মাঝেমাঝেই বাঁক ঘুরেছে পথ। যতগুলো বাঁক ততই বিচিত্র পথের শোভা। শুনেছিলাম এই অঞ্চলে চিতাবাঘের আনাগোনা আছে, তাই রাত হতেই মনে হচ্ছিল যেন প্রতি বাঁকেই অপেক্ষা করছে কোনও আতঙ্ক। কনকচৌরি পৌঁছলাম রাত ৮টায়। পাহাড়ি গ্রাম শীতের দাপটও বেশি, তাই একবারে ডিনার পর্ব সেরে কটেজে ঢুকে পড়লাম। মূল রাস্তা থেকে কিছুটা সিঁড়ি ভাঙা পথে নীচে নামতেই দেখতে পেলাম সাজানো গোছানো ছোট ছোট কটেজ। পরদিন রাত থাকতেই হাঁটাপথে পৌঁছতে হবে কার্তিকস্বামী মন্দির। শিব ও পার্বতীর দ্বিতীয় পুত্র দেবসেনাপতি কার্তিকের দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় মন্দির আছে এবং পূজিত হন তিনি বিভিন্ন নামে। কোথাও মরুগান, কোথাও বাসম্মুখ, ষড়ানন, স্কন্দ প্রভৃতি নামে। তবে উত্তর ভারতে গাড়োয়াল হিমালয়ের চূড়ায় অবস্থিত এই মন্দিরই একমাত্র কার্তিকের মন্দির। পুরাণ মতে, এই মন্দিরেই প্রতি কার্তিক চতুর্থীতে মা পার্বতী আসেন পুত্রের সঙ্গে দেখা করতে। স্থানীয়রা মন্দিরে ভিড় জমায় পুণ্যরাত্রি উদ্যাপনের জন্য। সারারাত ধরে চলে প্রার্থনা ও ভজন। তাই পৌরাণিক এই মন্দিরটি দেখতে যাওয়ার উৎকণ্ঠায় রাতে ঘুম সেভাবে হল না, হল ক্ষণিক উৎকণ্ঠার বিশ্রাম মাত্র।
ঘড়িতে ৩.৪৫, টর্চ হাতে শুরু হল বহু প্রত্যাশিত কার্তিকস্বামী মন্দিরের উদ্দেশে যাত্রা। ৩৫০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই মন্দির পৌঁছতে সময় লেগেছিল প্রায় আড়াই ঘণ্টা মতো। ৩.৫ কিমি রোমাঞ্চে ভরা এই ট্রেকিং পথের শুরুটা খুব একটা চড়াই পথ না হলেও উঁচু নিচু পাথুরে পথের মাঝে মাঝেই গাছের শিখর উঠে রয়েছে। অন্ধকারে টর্চের আলো অস্পষ্ট তাই চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল এইসব ছোটখাট জিনিস। তাছাড়া রাতে বৃষ্টি হওয়ায় পথও পিছল। ক্রমে উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে হাঁপ ধরতে লাগল। কিন্তু ইচ্ছে যে অদম্য। পথের মাঝে কিছু বিশ্রামের জায়গা রয়েছে সেখানে ক্ষণিক বিশ্রাম নিয়ে আবার এগিয়ে চললাম। এইভাবে ৩ কিমি পথ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম মন্দিরের পুরোহিত মশাইয়ের আশ্রমের কাছে। এবার শুরু সিঁড়ি ভাঙার পালা। প্রথমে পেরতে হল ৪০০ সিঁড়ি ও শেষ ধাপে জয় করলাম ৯২টি। পৌঁছে গেলাম কার্তিকস্বামী মন্দির। মন্দিরটি যেন সবার চাইতে আলাদা। পর্যটকদের ক্লেদ এখনও স্পর্শ করেনি, তাই শান্ত, কোলাহলমুক্ত নিস্তব্ধতা যেন আজও এখানকার নিবিড় সঙ্গী।
ভোর তখনও হয়নি, পুব আকাশে চলছে আলো আঁধারের খেলা। পাহাড়ের শেষ মাথায় মন্দির তখনও অন্ধকারে আচ্ছন্ন। মেঘ ও কুয়াশার দল তখনও পথ আগলে সূর্যোদয়ের, অবশেষে আড়াল হল মেঘেরা। ফুটে উঠল ভোরের আলো। সাক্ষী হলাম এক অসাধারণ সূর্যোদয়ের। সোনালি রোদের আলোয় আশপাশে অন্ধকারে ডুবে থাকা সমুন্নত পাহাড়গুলো সব যেন হঠাৎই জেগে উঠল। দেখলাম দাঁড়িয়ে আছি উঁচু পাহাড়ের উপর সুন্দর সমতল একটি জায়গায়, যার চারদিকে স্নিগ্ধ সবুজ বাতাবরণ। পাহাড়ে ঘেরা এই মনমোহিত, মায়াবী সৌন্দর্যে আমি তখন বিমোহিত। মনে হল বুঝি দাঁড়িয়ে আছি স্বর্গে। আকাশ কিছুটা মেঘলা থাকা সত্ত্বেও দেখতে পেলাম মন্দিরের ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে শুভ্র হিমালয় তার অপার্থিব সম্ভার নিয়ে। বন্দরপুঞ্ছ, চৌখাম্বা, নন্দাদেবী, নন্দাঘুণ্টি, কেদারনাথ, কেদারডোম, ত্রিশূল ও বহু আকাঙ্ক্ষিত দ্রোণাগিরি শিখরমালাকে এত কাছে থেকে বোধহয় স্বর্গ ছাড়া আর দেখা সম্ভব নয়। হঠাৎই যেন মেঘেদের সরিয়ে দিয়ে সূর্যদেব রাঙিয়ে দিলেন কেদারনাথ পর্বতশৃঙ্গ। সোনালি রোদের আলোয় তখন জ্বলজ্বল করছে কেদারনাথ শৃঙ্গ। তাকিয়ে আছি আমরা সবাই তারই দিকে ভাষাহীন নিষ্পলক চোখে।
কীভাবে যাবেন: হাওড়া থেকে দুন, উপাসনা বা কুম্ভ এক্সপ্রেসে হরিদ্বার ও সেখান থেকে প্রাইভেট কার বা বাসে রুদ্রপ্রয়াগ। তবে রুদ্রপ্রয়াগ থেকে কনকচৌরি শেয়ার গাড়িও পাবেন।