পারিবারিক ধর্মকর্ম পালনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ। সন্তানের কর্মসাফল্যে গর্ব। গবেষণায় অগ্রগতি। ... বিশদ
ছেলেটি মাঠে ব্যাটিং করছে। নাইন্টি নাইন নট আউট। পরের বলটি বিপজ্জনক এক স্পেল! সোজা তুলে দিল ছেলেটি। বল উঠছে আকাশে। ক্যাচ আউট নাকি? টেনশনে ঘন ঘন মাথা নেড়ে চোখ ঢাকছেন গ্যালারিতে বসা দলীয় কোচ, ম্যানেজমেন্টের লোকজন। ক্যামেরা গিয়ে থামছে গ্যালারির একটি মেয়ের মুখে। তার হাতে ধরা ক্যাডবেরির বেগুনি মোড়ক থেকে উঁকি দিচ্ছে আস্ত একখানা চকোলেট বার। সেই ক্যাডবেরিতে কামড় দিয়েই মাঠের স্ট্রেস ভুলতে চাইছে মেয়েটি। ব্যাটারের বলটিতে পাখির চোখ বিপক্ষের খেলোয়াড়ের। এই বুঝি ক্যাচ উঠল! সেঞ্চুরি হাতছাড়া হওয়ার শঙ্কায় মাঠসুদ্ধ সকলে স্তব্ধ, হতাশ। মেয়েটি শুধু ক্যাডবেরি হাতে চোখ বুজে কামনা করছে কোনও অঘটন না হয়। চাইছে ছেলেটির সেঞ্চুরি। অবশেষে বল ও ফিল্ডারের পা দুই-ই টপকে গেল বাউন্ডারি লাইন। পাশে বসা বন্ধুনিকে জড়িয়ে ধরেই মাঠে নেমে এল মেয়েটি। তারপর নিরাপত্তারক্ষীকে বোকা বানিয়ে তার লাঠি ও হাত এড়িয়ে পাখির মতো উড়তে উড়তে নাচতে নাচতে মেয়েটি ঢুকে পড়ছে মাঠে। সাদা পায়রা উড়ে যাচ্ছে ময়দানের সবুজ থেকে। হতবাক খেলোয়াড় ছেলেটি প্রেমিকার ছেলেমানুষিতে হেসে ফেলে মুখ আড়াল করছে। মেয়েটি ছুটে এসে চকোলেটের অবশিষ্টাংশ খাইয়ে দিল ব্যাটসম্যান প্রেমিককে। নেপথ্যে ভাসছে জিঙ্গল, ‘কেয়া সোয়াদ হ্যায় জিন্দেগি মে!’
কোকোর প্রেম
নয়ের দশকে এমনই এক মিঠে সমর্পণের বিজ্ঞাপনে সাড়া ফেলে দিয়েছিল এক মিল্ক চকোলেট সংস্থা। আটের দশক থেকেই প্যাকেটবন্দি বড় আকারের মিল্ক চকোলেট ছেয়ে যায় ভারতের বাজার অর্থনীতিতে। মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে, সহজলভ্য পণ্যের মধ্যে ঢুকে পড়ছে দেশি-বিদেশি নানা চকোলেটের ব্র্যান্ড। মিল্ক চকোলেট দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও নয়ের দশকের মাঝামাঝি জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করল ডার্ক চকোলেটের আবেদন। ফিল্মস্টার থেকে শুরু করে দেশের ফিটনেস ফ্রিক অ্যাথলিট সকলেই মজতে শুরু করেছেন তেতো স্বাদের কোকোয়। সেই শুরু। তারপর থেকে একনাগাড়ে এখনও ডার্ক চকোলেট মোহিত করে রেখেছে সেলিব্রিটি থেকে সাধারণ মানুষকে। দীপিকা পাড়ুকোন, মহেশ ভূপতি, দেবী শেঠি, শচিন তেন্ডুলকর, রণবীর সিং থেকে শুরু করে আমজনতা— তেতো স্বাদের এই কোকোর সামনে নতজানু হয়েছেন বারবার।
শরীরের কালো সেনা
চিকিৎসকরা দাবি করেন, মিল্ক চকোলেটের চেয়ে ডার্ক চকোলেটে লুকিয়ে আছে শরীরেরও নানা উপকার। তাই শুধু স্বাদকোরকই নয়, শরীরের যত্নেও কাজে আসে এই ডার্ক চকোলেট। নানা রোগভোগ থেকে শরীরকে বাঁচানোরও ক্ষমতা রাখে সে। সাম্প্রতিক গবেষণা জানাচ্ছে, ডায়াবেটিসের রোগীরা অনায়াসে খেতে পারেন ডার্ক চকোলেট। রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে এই চকোলেট খুব কাজে আসে। শুধু ডায়াবেটিস নয়, হার্ট, কোলেস্টেরল, ওবেসিটি নানা সমস্যাতেই ডার্ক চকোলেট কাজ করে ম্যাজিকের মতো। সেনাবাহিনীর মতো রুখে দেয় বিপদের হানা। তবে জানতে হবে পরিমাণ, খাওয়ার নিয়ম। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাঃ সৌম্যদেব সরকারের মতে, ‘ডার্ক চকোলেটের মধ্যে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। এছাড়া রয়েছে অ্যান্টিইনফ্লেমেটরি উপাদান। তাই নিয়ম মেনে অল্প অল্প করে ডার্ক চকোলেট শরীর ভালো থাকে। এছাড়াও খাঁটি ডার্ক চকোলেটে মেলে ৭০ শতাংশ কোকো। শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় যৌগ— পটাশিয়াম, জিঙ্ক, সেলেনাম, ফসফরাসও থাকে এতে। মেলে ফাইবার। তাই এই ধরনের চকোলেট পরিমাণ মতো খেলে শরীরের উপকার হয়। তবে কতটা খাবেন, তার স্বচ্ছ ধারণা থাকা চাই।’
কালো ভালো
কালো, তেতো স্বাদের এই কোকোকে দৈনন্দিন জীবনে খাবার পাতে রাখলে উপকার মিলবে অনেকখানি। যেমন:
• ডার্ক চকোলেটের মধ্যে পাবেন প্রচুর ফ্ল্যাভনয়েড। এটি শরীরের আবরণী কলার একটি স্তর এন্ডোথিলিয়ামের উপর ভালো কাজ করে। ডার্ক চকোলেট খেলে রক্তনালী নাইট্রিক অক্সাইড তৈরি করতে সক্ষম হয়। যার ফলে মস্তিষ্ক ধমনীকে কিছুটা বিশ্রাম নেওয়ার বার্তা পাঠায়। তাই রক্ত চলাচল সহজ হয় এবং রক্তচাপ কমে।
• কোলেস্টেরল মাত্রই তা ক্ষতিকর নয়। আমাদের শরীরে খারাপ (এলডিএল) ও ভালো (এইচডিএল) দুই ধরনের কোলেস্টেরল থাকে। খারাপ কোলেস্টেরল কমিয়ে ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়াতে পারলে আখেরে লাভ হয় শরীরের। ডার্ক চকোলেট ঠিক এই কাজটাই করে। ডার্ক চকোলেটে থাকা কোকো রক্তে ভাল কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
• ডার্ক চকোলেটের মধ্যে থাকা কোকো মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে। এই কোকোর মধ্যে থাকে প্রচুর ফ্ল্যাভনয়েড। এটি মস্তিষ্কে রক্তের সঞ্চালনা বাড়িয়ে দেয়। তাই ডার্ক চকোলেট এনার্জি ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিতে ভীষণ কার্যকর।
• গুড হরমোন এন্ডোরফিনের ক্ষরণ বাড়িয়ে তোলে ডার্ক চকোলেট। নিজেকে চাপমুক্ত রাখতে বহু খেলোয়াড় ও সার্জেন সঙ্গে ডার্ক চকোলেট রাখেন। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের ডায়েটে ডার্ক চকোলেট থাকলে তাঁরা মানসিকভাবে অনেক তরতাজা থাকেন।
• ডার্ক চকোলেটে থাকে সামান্য পরিমাণে ক্যাফিন ও থিওব্রোমিন। এই দুই উপাদান ব্রেনের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। এর ফ্ল্যাভনয়েড রক্তপ্রবাহ বাড়িয়ে তোলায় মস্তিষ্কের কগনিটিভ ফাংশন ভালো হয়।
• ডার্ক চকোলেট হৃদ্যন্ত্রকেও সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। রোজ দু’তিন টুকরো ডার্ক চকোলেট খেলে তা হৃদ্যন্ত্রের জন্য উপকারী।
• ডার্ক চকোলেটে থাকে নানা বায়োঅ্যাক্টিভ পদার্থ। এই যৌগগুলি সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে ত্বককে বাঁচায়। এছাড়া রক্তের প্রবাহ বাড়িয়ে ত্বককে উজ্জ্বল রাখে। ফ্ল্যাভনয়েডের গুণে ত্বকে রক্ত চলাচল বাড়িয়ে ত্বককে উজ্জ্বল দেখাতেও সাহায্য করে ডার্ক চকোলেট। এককথায় একে অ্যান্টি-এজিং এজেন্ট বলা চলে।
রোজ কতটা
উপকারের অন্ত নেই, তাবলে মুঠো মুঠো ডার্ক চকোলেট খেলে কিন্তু ক্ষতির পাল্লাই বেশি। জানালেন ডাঃ সৌম্যদেব সরকার। একজন সুস্থ পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি প্রতিদিন দুই থেকে তিন টুকরো ডার্ক চকোলেট খেতে পারেন। ডায়াবেটিস থাকলে এর পরিমাণ নামিয়ে আনতে হবে এক-দু’টুকরোয়।
ভয় কোথায়
যে কোনও ভালো জিনিসের বাড়াবাড়িতেই ভয় আছে। খেতে ভালো আর উপকারের পাল্লা ভারী বলে একদিনে অনেকটা ডার্ক চকোলেট খেয়ে নিলে হিতে বিপরীত হওয়ার শঙ্কা বেশি। ভারতীয় বাজারে মধ্যবিত্তের আয়ত্তে যেসব ডার্ক চকোলেট আসে, তাদের বেশিরভাগেই থাকে অল্প পরিমাণ চিনি। ট্রান্স ফ্যাট না থাকলেও টোটাল ফ্যাটের পরিমাণ তাতে খুব কম থাকে না। তাছাড়া এই খাবার উচ্চ ক্যালোরিসম্পন্ন। তাই একবারে অনেকটা চকোলেট খেলে ফ্যাট ও চিনি শরীরে বেশি প্রবেশ করবে। উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত খাবার হওয়ায় মাত্রা বুঝে না খেলে ওবেসিটির হানা ঠেকানো যায় না। তাই সুস্থ থাকতে ও ডার্ক চকোলেটের সবটুকু উপকার পেতে দিনে দু’-এক টুকরোতেই বেঁধে রাখুন নিজেকে। তিক্ত স্বাদের এই মোহময় খাবারে সারুন সুস্থতার সহজপাঠ।