পারিবারিক ধর্মকর্ম পালনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ। সন্তানের কর্মসাফল্যে গর্ব। গবেষণায় অগ্রগতি। ... বিশদ
সাধারণত কেদারনাথ মন্দির খোলে অক্ষয় তৃতীয়ার পুণ্য সকালে। তবে সবকিছু নির্ভর করে উখিমঠের প্রধান পুরোহিত এবং অন্য পণ্ডিতদের উপর। বিভিন্ন তিথি নক্ষত্রের গণনা করে প্রতি বছর মহাশিবরাত্রির দিন সকালে মন্দির খোলার দিন ঘোষণা করা হয়। তাই শিব চতুর্দশীর সকাল থেকেই অধীর আগ্রহে বসে আছি টিভির সামনে। দিন ঘোষণা হওয়া মাত্র হরিদ্বার যাওয়ার ট্রেনের টিকিট কেটে ফেলি। তারপর শুরু হয় আমাদের কেদার যাত্রা।
উখিমঠ থেকে ডোলিযাত্রা শুরু হবে ভোর হতে না হতেই। শুরু থেকেই থাকার ইচ্ছে। যাত্রার পরিকল্পনাও সেইভাবে সাজানো হয়েছে। খুব সকালে বন্ধু সতীশের গাড়িতে হরিদ্বার থেকে যাত্রা শুরু হল। হৃষীকেশ, দেবপ্রয়াগ, রুদ্রপ্রয়াগ, অগস্ত্যমুনি কুণ্ড পেরিয়ে উখিমঠ পৌঁছতে প্রায় বিকেল হয়ে গেল। ঘরও পেয়ে গেলাম মন্দিরের সামনে। বিকেল থেকেই মন্দিরে ভক্তদের আনাগোনা শুরু হয়ে গিয়েছে। আশপাশের গ্রাম তো বটেই বাইরে থেকেও প্রচুর ভক্ত এসে পৌঁছেছে উখিমঠে। সাজানো হয়েছে মন্দির প্রাঙ্গণ। উখিমঠের এই মন্দিরই কেদারনাথ ও মদমহেশ্বরের শীতকালীন গদিস্থল। এছাড়াও পঞ্চকেদারের (কেদারনাথ, মদমহেশ্বর, তুঙ্গনাথ, রুদ্রনাথ, কল্পেশ্বর) অন্যান্যদের প্রতিমূর্তিও মন্দিরে রাখা আছে। তাই যাঁরা পঞ্চকেদারের কষ্টসাধ্য পথ অতিক্রম করে সব কেদারখণ্ডে যেতে পারেন না, তাঁরা এই মন্দিরেই পঞ্চকেদার দর্শনের পুণ্যলাভ করেন বলে বিশ্বাস। সন্ধে থেকেই উৎসবের আমেজে ভরপুর গোটা মন্দির। সন্ধ্যারতির পর স্থানীয়রা নিজস্ব ঘরানার নাচগানের মধ্যে দিয়ে সকলের মনোরঞ্জন করছে। অভূতপূর্ব এক অনুষ্ঠানের সাক্ষী হলাম সেই রাত্রে।
পরের দিন সকাল থেকেই উখিমঠের মন্দিরে মন্ত্রপাঠ শুরু হয়েছে। সুমিষ্ট মন্ত্রোচ্চারণের আওয়াজ পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে হিমালয়ের কোণে। মন্দিরের কোথাও তিলধারণের জায়গা নাই। সামরিক বাহিনীর বাদ্যকাররা ডোলিকে ঘিরে সুশৃঙ্খলভাবে বাজনা বাজাচ্ছে। বাইরে স্থানীয় মানুষরা তাঁদের নিজস্ব বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে উৎসবে মাতোয়ারা। ইতিমধ্যে পঞ্চমুখী শিব সহ ডোলি বাইরে আনা হয়েছে। চতুর্দিক থেকে ডোলির উপর পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে। মন্দিরের মধ্যে তখন চলছে ভৈরব পুজো। ভৈরবের অনুমতি নিয়ে তবেই শুরু হবে ডোলিযাত্রা। পুজার্চনা শেষ করে ডোলিকে রাজকীয় সাজে সজ্জিত করে তুমুল জয়ধ্বনির মধ্যে ঠিক সকাল সাড়ে নটায় শুরু হল যাত্রা। আজ ডোলি যাবে ১৫ কিমি দূরে গুপ্তকাশী পর্যন্ত। সামনে পিছনে অগণিত ভক্ত পরিবৃত হয়ে সরু আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ ধরে ডোলিযাত্রা এগিয়ে চলল গুপ্তকাশীর দিকে।
কখনও পাকা সড়ক কখনও বা ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে মানুষের সারি। পথের মাঝে গ্রামবাসীদের অনুরোধে মাঝে মাঝে ডোলি নামাতে হচ্ছে। গ্রহণ করতে হচ্ছে সরল গ্রামবাসীদের ভালোবাসার উপহার। গুপ্তকাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরে আজ ডোলির রাত্রিবাস। গুপ্তকাশী উত্তরাখণ্ডের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান। পুরাণে আছে মহাদেব পাণ্ডবদের এড়াতে এখানেই এক গুহায় মহিষরূপে আত্মগোপন করেছিলেন। সেইথেকে নাম গুপ্তকাশী। দুপুর পেরিয়ে বিকেলের মধ্যেই ডোলির গুপ্তকাশী প্রবেশ। বিশ্বনাথ মন্দিরে তখন জাঁকজমক অনুষ্ঠানের আবহাওয়া। প্রায় সারারাত ধরে অনুষ্ঠান শেষে পরদিন সকালে আবার যাত্রা শুরু ফাটার উদ্দেশে। ডোলি আজ ফাটাতেই থাকবে। যাত্রার সঙ্গ ছেড়ে আমরা এগিয়ে গেলাম গৌরীকুণ্ডের দিকে।
বিকেলে ডোলি পৌঁছল গৌরীকুণ্ডে। রাখা হল গৌরীমাতার মন্দিরের ভিতর। গৌরীকুণ্ড এমনিতেই খুব ছোট জায়গা। পাহাড়ের গায়ে একফালি সরু জায়গার মধ্যেই মন্দির, হোটেল, বাজার সবকিছু। ২০১৩ সালের বন্যায় প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া গৌরীকুণ্ড আবার নতুন করে বাঁচার চেষ্টা করছে। গোটা গৌরীকুণ্ড অসংখ্য মানুষের ভিড়ে থিকথিক করছে। সবার গন্তব্য মন্দাকিনীর ধারে গৌরীমাতার মন্দির। সেখানে ততক্ষণে উৎসবের আমেজ। ঢোল, ডমরু, বড় বড় খঞ্জনি, মিলিটারি ব্যান্ডের আওয়াজে গোটা গৌরীকুণ্ড মাতোয়ারা। সাধু-সন্ন্যাসীরা উন্মত্তের মতো নৃত্য করছে। একদিকে সকলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে লঙ্গর। লাইনে দাঁড়ালেই মিলছে পুরি, সব্জি, খিচুড়ি, লাড্ডু। খবর নিয়ে জানলাম আগামী কাল সকাল ৮-৮.৩০টায় ডোলি কেদারনাথের উদ্দেশে রওনা দেবে।
পাহাড়ি পথে পাহাড়ের লোকেদের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। তাই খুব ভোরে প্রায় সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে গৌরীকুণ্ড থেকে হাঁটা শুরু করেছি। মনে ইচ্ছে যদি আগে বেস ক্যাম্প পৌঁছতে পারি তাহলে ডোলির সঙ্গেই যাব মন্দির পর্যন্ত। গৌরীকুণ্ড থেকে কেদারনাথ হাঁটাপথে ১৬ কিমি। সামনেই পুলিস চৌকি। প্রথম দিন বলে কাগজপত্র দেখানোর বালাই নেই। ৪ কিমির মাথায় জঙ্গলচটিতে সাময়িক বিরতি। পথের প্রচণ্ড চড়াই এখনও শুরু হয়নি। সামনে ভীমবলী। সেখানে চা খেতে খেতে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার পথচলা শুরু হয়। হিমালয়ের পথে চলার অভ্যেস না থাকলে দেহের এবং শ্বাসের কষ্ট হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু পথের শোভা সব ক্লান্তি শুষে নেয়। এতক্ষণ পর্যন্ত মন্দাকিনীকে পথের ডান পাশে রেখে হাঁটছিলাম। রামওয়ারা পৌঁছে মন্দাকিনীর উপর ঝুলন্ত সেতু পেরিয়ে নদীর অপর পাড়ে যেতে হল। মন্দাকিনী এখন পথের বাঁ পাশে। ২০১৩ সালের বিধ্বংসী বন্যার আগে রামওয়ারা ছিল এ পথের সবথেকে বড় চটী। অনেক পুণ্যার্থী এখানে রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে কেদারনাথ পৌঁছতেন। এখন রামওয়ারা পর্বতের ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছুই নয়। বিষণ্ণ হৃদয়ে সেই অভিশপ্ত পথরেখার দিকে তাকিয়ে নতুন পথে চলা শুরু করি আবার। রামওয়ারার পর চড়াই বেশ বেড়েছে। লোয়ার লিঞ্চোলির পর রাস্তায় এখানে-সেখানে বরফের দেখা মিলছে। চারদিকের পাহাড়গুলো সব বরফ ঢাকা। আপার লিঞ্চোলির পর শুরু হল পুরোপুরি বরফের উপর দিয়ে হাঁটা। মাঝেমাঝে হিমবাহ কেটে রাস্তা বানানো হয়েছে। সেনাবাহিনীর জওয়ানরা তীর্থযাত্রীদের সাবধানে সেই রাস্তা পার হতে সাহায্য করছে। রুদ্রপয়েন্ট পেরিয়ে বেস ক্যাম্পের কাছাকাছি যখন, তখন দূরে যেন বাজনার আওয়াজ শুনলাম। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে বেস ক্যাম্পে পৌঁছতে না পৌঁছতে তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে বরফ ঢাকা সাদা পাহাড়ি রাস্তায় ভীষণ রংচঙে ডোলির মিছিলটা আমাদের চোখের সামনে চলে এল। সর্বপ্রথমে মিলিটারি ব্যান্ড, তারপর স্থানীয় বাজনার দল। মধ্যখানে ডোলিবাহকদের কাঁধে সুসজ্জিত পঞ্চমুখী ডোলি। এই দুর্গম ৫০-৬০ কিমি রাস্তা ডোলিবাহকরা সম্পূর্ণ খালি পায়ে চলছেন। ক্লান্তি বা যন্ত্রণার লেশমাত্র নেই, মুখে শুধু হর হর মহাদেব ধ্বনি। আর মাত্র ১ কিমি রাস্তা। ডোলির পিছু পিছু মন্দিরের দিকে এগলাম। অবশেষে মন্দিরের দরজা। কাঁধ থেকে পঞ্চমুখী মহাদেব নেমে দাঁড়ালেন বন্ধ দরজার সামনে।
পরের দিন সুমিষ্ট বেদমন্ত্রের আওয়াজে ঘুম ভাঙল। তখনও ভোরের আলো ফোটেনি। এর মধ্যেই মন্দিরের সামনে দীর্ঘ লাইন। বন্ধ কপাটের সামনে প্রধান পুরোহিত রাওয়ালজি, শঙ্করাচার্য, মাথায় সুশোভিত পুণ্যকলস নিয়ে উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামী সমেত বেশ কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি। ধীর লয়ে বাজনা বাজছে। ইতিমধ্যে পুরোহিতগণ দ্বারপুজো, গণেশ বন্দনা শুরু করেছেন। কনকনে ঠান্ডায় পায়ের নীচে বরফের উপর দাঁড়িয়ে অপেক্ষমান ভক্তের দল। অবশেষে তুমুল হর্ষোল্লাসের মধ্যে ঠিক ৬.২০ মিনিটে খুলে গেল ভারতের অন্যতম আকর্ষণীয় তীর্থস্থান কেদারনাথের দরজা। এক লহমায় ভক্তের স্রোতে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলেন ‘ভক্ত’ আর ‘ভগবান’।
কীভাবে যাবেন: হরিদ্বার থেকে বাসে বা ছোট গাড়িতে সোনপ্রয়াগ। সেখান থেকে গৌরীকুণ্ড ৪ কিমি পথ। গৌরীকুণ্ড থেকে হাঁটাপথে কেদারনাথ ১৬ কিমি। এছাড়াও ঘোড়া বা ডোলিতেও যাওয়া যায়। হেলিকপ্টারে যেতে হলে ফাটা, গুপ্তকাশী এবং সারসি থেকে যেতে হবে।