পারিবারিক ধর্মকর্ম পালনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ। সন্তানের কর্মসাফল্যে গর্ব। গবেষণায় অগ্রগতি। ... বিশদ
ন্সডাউন যাওয়ার পরিকল্পনায় প্রথমেই মনে হল, আরে এখানে আবার যাওয়ার কী আছে? এ তো খাস কলকাতাতেই! আমার উত্তর কলকাতার নিবাস থেকে স্রেফ ঘণ্টাখানেকের পথ। কলকাতাবাসী হিসেবে এই নামের সঙ্গে যথেষ্ট পরিচিতও। অথচ এই নামেই যে উত্তরাখণ্ডে আস্ত একটা পাহাড়ি ক্যান্টনমেন্ট শহর রয়েছে সে কথা তখনও জানতামই না! অবাক হলাম বইকি।
সে এক নিরিবিলি শান্ত ছোট্ট পাহাড়ি শহর। স্নিগ্ধতার পরশ মেখে পাহাড়গুলো যেন ক্লাসরুমের সুবোধ বালকের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। লর্ড ল্যান্সডাউন যখন ভারতের ভাইসরয় ছিলেন, তখন এই জনপদটি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর নামেই এই শহরের নাম হয় ল্যান্সডাউন। সেনাবাহিনীর গাড়ওয়াল রাইফেলসের রেজিমেন্টের শিক্ষণকেন্দ্র তৈরি হয় এখানে। স্বাধীনতার পর গাড়ওয়াল রেজিমেন্টের কেন্দ্র হয় এই শহর। গোটা শহর জুড়েই ছড়িয়ে আছে ব্রিটিশ স্থাপত্যের নানা নিদর্শন। ঘন পাইন, ওক আর দেবদারুর মাঝে রয়েছে পুরনো ব্রিটিশ স্থাপত্যের বাংলো।
প্রথম দর্শনে প্রেমে পড়ার মতোই রূপ এই পাহাড়ি অঞ্চলের। পথঘাট পরিষ্কার পরিছন্ন। মসৃণ রাস্তায় যাত্রাপথের সৌন্দর্যও অতুলনীয়। পাহাড়ি পথে ট্রেকিং, বার্ড ওয়াচিং, ভুল্লা তালে বোটিং— সব মিলিয়ে ভ্রমণের মজা দ্বিগুণ হবে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
চেনা অচেনা পাহাড়ি পথে হাঁটতে গিয়ে প্রকৃতির অসামান্য রূপের পাশাপাশি আপনার কানে আসবে জানা অথবা নাম না জানা বিচিত্র পাখির ডাক। পাখি বিশারদদের পক্ষে উপযুক্ত জায়গা এটি। ঘন সবুজের গালিচা পাতা পাহাড় আর যখন তখন বৃষ্টি। বৃষ্টিস্নাত ল্যান্সডাউনের অন্য এক রূপ। মেঘেদের দলবেঁধে পাহাড়ের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা সারাদিনই আপনার চোখে পড়বে। আর হুটহাট বৃষ্টি যেন সেই খেলার মাঝে রসভঙ্গের মতো ঝরে পড়বে আপনার উপর। বৃষ্টির পর পাহাড়ি সবুজ আরও ঘন হবে। আকাশ হবে আরও নীল। সেই নীল আর সবুজের মিলমিশে চোখ জুড়িয়ে যাবে। পাহাড়ি পথের বৃষ্টি আপনার জীবনের স্মরণীয় অভিজ্ঞতা হতে পারে। যাঁরা প্রকৃতিকে ভালোবাসেন, প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে আর প্রকৃতির লুকনো ঐশ্বর্যকে খুঁজে দেখতে আগ্রহী, তাঁরা আসতেই পারেন দূষণহীন কোলাহলমুক্ত পরিচ্ছন্ন এই নির্জন শহরে।
তবে আশ্চর্যের বিষয় এটাই যে এত সৌন্দর্য ও স্বাধীনতার ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও এই শহরে পর্যটকের সংখ্যা কিছুটা কম। শান্ত নিরিবিলি অনাঘ্রাত এক পাহাড়ি শহর ল্যান্সডাউন। কেউ কেউ বলেন যে মিলিটারি শহর তাই যেখানে সেখানে হোটেল গড়ে উঠতে পারেনি, সেটাই হয়তো কম সংখ্যক পর্যটকের আনাগোনার কারণ। তবে এখানে গাড়ওয়াল মণ্ডল বিকাশের পর্যটন নিবাস রয়েছে। রয়েছে সুন্দর কিছু হোটেলও। অবশ্যই সংখ্যায় কম। কোনওটার সামনে বারান্দায় দাঁড়ালে আপনার চোখ পড়বে নাম না জানা পাহাড়ি নদী বয়ে চলেছে আপন খেয়ালে, কোনওটায় আবার চোখের সামনে কেবল সবুজ পাহাড় আর জঙ্গল।
ল্যান্সডাউনের সাইট সিইংয়ের মধ্যে ভুল্লা তাল অন্যতম। সপ্তাহান্ত কাটানোর জন্য বা পিকনিক স্পট হিসেবে উপভোগ্য। স্থানীয় লোকজনের ভিড় ভুল্লা তালে লেগেই থাকে। ভুল্লা তালে রয়েছে একটি মনোরম লেক। মিলবে বোটিংয়ের সুযোগ। রয়েছে সুন্দর সাজানো বাগান। সেখানে বসার সুব্যবস্থাও রয়েছে। আর সঙ্গে বাচ্চারা থাকলে তারাও খুব উপভোগ করবে। নানা ধরনের রাইড আছে। বড়দের আনন্দেরও খামতি নেই। দূরবর্তী পাহাড় শ্রেণি একাই একশো। সেদিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই কখন যে সূর্যদেব মধ্যগগন থেকে অস্তাচলে পাড়ি জমান তা বোঝা দায়। সময়ের খেয়ালই থাকে না এখানে এলে। পাহাড়ের আড়ালে সূর্য ডোবার পালা দেখা এবং একইসঙ্গে বরফচূড়ায় রং বদল দেখা নেহাতই ভাগ্যের কথা।
স্বাধীনতার ইতিহাস বুকে নিয়ে রয়েছে ওয়ার মেমোরিয়াল। সেখানে ঐতিহাসিক অমূল্য সব ছবি, অস্ত্র, পোশাক স্মৃতি হয়ে রয়েছে। মন ছুঁয়ে গিয়েছে ব্রিটিশ আমলের তৈরি সুন্দর গির্জা। পরিবেশ এত নির্মল, এত পবিত্র যে ভেতরে ঢুকলেই মন প্রশান্তিতে ভরে যায়। দেখার মধ্যে আরও আছে, সন্তোষী মায়ের মন্দির। পাহাড়ের একেবারে উপরে এই মন্দির। পাহাড়ের একদম উপর থেকে দূরের প্রকৃতির স্নিগ্ধতা দূষণহীন বাতাস, সবটাই খুব উপভোগ্য। ল্যান্সডাউন থেকে ৩৮ কিলোমিটার দূরে রয়েছে দেবদারু গাছে ঘেরা তারকেশ্বর মহাদেব মন্দির। পাহাড়ের বাঁক পেরিয়ে যখন গাড়ি চলছে সবুজে সবুজ চারধার। গাড়ি থেকে নেমে বেশ খানিকটা হাঁটা। কথিত আছে, রাক্ষস তারকাসুর শিবের বর লাভ করার জন্য এইখানে তপস্যায় বসেছিলেন। ভক্তদের উপচে পড়া ভিড় নেই, নেই উন্মত্ত জনতার কোলাহল অথচ অদ্ভুত নির্মল এক পরিবেশ, যা মনকে দু’দণ্ড শান্তি দেবে। মন্দিরের বাইরে একটি কুণ্ড আছে, তীর্থযাত্রীরা স্নান করে মন্দিরে পুজো দিয়ে থাকেন। অগুনতি ঘণ্টা চোখে পড়ল। মনস্কামনা জানিয়ে এই মন্দিরের ঘণ্টা বাজিয়ে থাকেন ভক্তরা। মন্দির খোলা থাকে সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত।
যে জায়গাটার কথা না বললে ল্যান্সডাউনের সৌন্দর্য দেখা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে তা হল টিপটপ অথবা টিফিন টপ ভিউ পয়েন্ট। মূল শহর থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে। সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখার জন্য এই জায়গাটি বিখ্যাত। এখানেও গাড়ওয়াল পর্যটন বিকাশ নিগমের থাকার জায়গা রয়েছে। এই স্থান থেকে দেখা সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত, দুই-ই আপনার মনে চিরস্থায়ী রয়ে যাবে এ কথা হলফ করে বলতে পারি।
আকাশ জুড়ে বর্ণময় রঙের খেলায় আপনি মোহিত হবেনই। একসঙ্গে অদ্ভুত লাল হলুদ কমলার মোহময় জাদুকরি খেলা যে কী মনোমুগ্ধকর যারা দেখেছে , তারাই একমাত্র অনুভব করতে পারবে। আবার হঠাৎ করেই আপনার চোখের সামনে টকটকে কমলা বলের টুক করে পাহাড়ের গায়ে হারিয়ে যাওয়া... চোখে লেগে থাকা ঘোর কাটতে সময় লাগে। তাই বলছি যারা নির্জনতা পছন্দ করেন, বা একান্তে মধুচন্দ্রিমা কাটাতে চান, বা শহুরে রোজনামচার কোলাহলে ব্যতিব্যস্ত তারা একটি রাত টিফিন টপে অবশ্যই থাকবেন। অভিজ্ঞতার ঝুলি পূর্ণ হবে অনিবর্চনীয় আনন্দে।
কীভাবে যাবেন : দিল্লি থেকে রাতের ট্রেনে কোটদ্বার যেতে হবে। সেখান থেকে গাড়িতে ৪১ কিলোমিটার পথ পেরোলেই ল্যান্সডাউন। নয়তো দিল্লি থেকে সোজা গাড়িতেও আসা যায়। রাস্তা খুবই ভালো।
কোথায় থাকবেন : গাড়োয়াল পর্যটন বিকাশ নিগমের থাকার জায়গা তো রয়েইছে। এছাড়াও হিল টপ ফরেস্ট প্যালেস, ব্লু পাইন রিসোর্ট সহ নানা নামের ও দামের হোটেল রয়েছে। নিজের পকেটের সামর্থ্য বুঝে ব্যবস্থা নিলেই চলবে।