পারিবারিক ধর্মকর্ম পালনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ। সন্তানের কর্মসাফল্যে গর্ব। গবেষণায় অগ্রগতি। ... বিশদ
দার্জিলিং জেলার শান্ত পাহাড়ি গ্রাম লামাহাটা। পাহাড়ি নির্জনতায় অবগাহনের জন্য অনবদ্য এই জায়গাটি। এমন নিঃসঙ্গ পরিবেশ নিজেকে ফিরে দেখার আদর্শ জায়গা।
এমনিতে পাহাড় বলতেই বাঙালির কাছে দার্জিলিং সিকিম গ্যাংটক অনেক বেশি জনপ্রিয়। একবার আমরা সেই চেনা পরিচিত পথ ছেড়ে লামাহাটা ঘুরে এলাম। দার্জিলিঙের ঘুম স্টেশন থেকে জোরবাংলায় নেমে গাড়ি ভাড়া করে লামাহাটা যাওয়া যায়। হলফ করে বলা যেতে পারে ভ্রমণপিপাসুদের মন ছুঁয়ে যাবে এই স্থান। পাইন বন ঘেরা ছোট জনপদে প্রকৃতি তার রূপ রস গন্ধ যেন উজাড় করে দিয়েছে।
কিছু বছর আগেও লামাহাটা নামটা খানিক অপরিচিত ছিল। ইকো ট্যুরিস্ট স্পট ঘোষিত হওয়ার পর তার পরিচিতি, জনপ্রিয়তা তরতরিয়ে বেড়েছে। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ৭৭ কিলোমিটার দূরে গাড়ি ভাড়া করেও পাইন গাছে ঘেরা লামাহাটা যাওয়া যায়। আমরা ওই পথেই গাড়ি ভাড়া করে লামাহাটার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলাম। চলতে চলতে হঠাৎ বৃষ্টি নামল। যতদূর চোখ যায় সবুজের আচ্ছাদন। প্রতিটি গাছের পাতা বৃষ্টির জলে স্নাত, শ্যামলিমায় উপচে পড়ছে যেন। পাইন বনের সারি অকৃপণ প্রকৃতির আশীর্বাদের মতো ছড়িয়ে আছে রাস্তার দু’পাশে। পথের ধারে দেখতে পেলাম গ্রামের মেয়েরা সব্জির পসরা সাজিয়ে বসে আছে। প্রকৃতির কোল থেকে নিয়ে আসা গাজর বিট বিনস মুলো বাঁধাকপি— সব টাটকা আর বিষহীন, রং না করা সব্জির পসরা দেখে মন ভরে গেল।
চলতে চলতেই পেশক চা বাগানে কিছুক্ষণ গাড়ি দাঁড় করানো হল চা খাওয়ার জন্য। দূরে পাহাড়ের শ্রেণি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পাহাড়ের ঢাল বরাবর এমন নয়নাভিরাম চা বাগান দেখে গাড়ি অজান্তেই থেমে গেল যেন। চোখজুড়ানো এই পরিবেশে বেশ কিছু ছবি ক্যামেরাবন্দি করতেই হয়। প্রকৃতির এমন মায়াবী রূপ দেখে মুগ্ধ হতেই হবে। সারাক্ষণ মেঘ আর কুয়াশার লুকোচুরি। দূর আকাশের সেই মেঘ হাতের মুঠোয় বুঝি ধরা দিল। আমাদের আলতো ছোঁয়ায় হিমের পরশ দিয়েই আবার হারিয়ে যাচ্ছে পরক্ষণে। প্রকৃতির এই অপার্থিব দৃশ্য উপভোগ করতে করতে সময়ের হিসাব ছিল না। যতদূর চোখ যায় সবুজে সবুজ। এখান থেকে যেতে মন সরে না।
লামাহাটা মূলত বৌদ্ধ অধ্যুষিত জায়গা। তাই বেশ কিছু বৌদ্ধ নিদর্শন রয়েছে আশপাশে। পথে যেতে যেতেই শোনা যাবে তিস্তার উচ্ছল বয়ে যাওয়ার সুরধ্বনি। দেখা যাবে কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ আর সিকিমের পর্বতমালা। মেঘমুক্ত আকাশ থাকলে এখানকার সোনালি কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ বিস্ময়ে বিমুগ্ধ করে করে দেবে।
লামাহাটার কাছেই আমাদর হোমস্টে বুকিং ছিল আগে থেকে। সেখানে এক রাত কাটিয়ে পরের দিনের গন্তব্য লামাহাটার অপূর্ব সুন্দর ইকো পার্ক। দূরত্ব কম তাই অল্প সময়ের মধ্যে পৌঁছে গেলাম সেই পার্কে। ১০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে ভেতরে গেলাম। প্রথম দর্শনেই মন ভরে গেল। সাজানো গোছানো বিচিত্র সব ফুলের সমারোহ। নানা আলোয় আলোকিত ফুল দেখতে দেখতে আরও গভীরে প্রবেশ করলাম। যতই ভেতরে ঢুকছি ধুপি পাইন বনের বিশালতা আর নির্জনতায় গা ছমছম করতে লাগল। প্রায় আকাশে মাথা ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে সারিবদ্ধ পাইন ধুপি গাছ। আলো অন্ধকারের সরু রাস্তা দিয়ে এগতে থাকলাম। কিছুক্ষণ আগেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। টুপ টুপ করে গাছের পাতার জল আমাদের সিক্ত করে দিচ্ছিল। পার্কের মধ্যে দেখা গেল মনস্কামনা পূরণের আশায় টাঙানো বিশেষভাবে তৈরি পাঁচ রঙের পতাকাগুলো ঝালরের মতো হাওয়ায় দুলছে। জিজ্ঞাসা করে জানলাম লাল রং হল অগ্নি, নীল হল আকাশ, সাদা হল হাওয়া, সবুজ হল জল আর হলুদ রং হল মাটির প্রতীক।
পার্কের চতুর্দিকে সবুজের সমারোহ। আঁকাবাঁকা চড়াই উতরাই পথ চলতে চলতে হঠাৎ আমাদের সঙ্গীসাথীরা দেখি চোখে পড়ছে না! বুঝলাম, কোনও পথের বাঁকে ঢাকা পড়েছে ওরা। অনবরত মেঘ-বৃষ্টির খেলা চলছে চারপাশে। এটাই নাকি লামাহাটার বিশেষত্ব। ততক্ষণে পার্কের শোভনসু্ন্দর ওয়াচটাওয়ারে উঠে প্রকৃতির ঘ্রাণ নিলাম কিছুক্ষণ। টাওয়ার থেকে নেমে এগিয়ে চললাম লামাহাটার বিশেষ আকর্ষণ পাইন ঘেরা লেক দর্শনে। টুপ টুপ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে উপরের দিকে উঠতে লাগলাম। ভেজা মাটি, সোঁদা গন্ধ, নানা পাহাড়ি পাখির কলতান, ঝিঝির ডাক সব কিছুকে সঙ্গে নিয়ে পৌঁছে গেলাম লেকে। স্নিগ্ধ মায়াময় পরিবেশ। শান্ত জলে তখন বৃষ্টির টাপুর টুপুর বেড়েছে। সব মিলেমিশে একাকার। সেখানেই আবার দেখা হল সকলের সঙ্গে। তবে আর বেশিক্ষণ থাকা গেল না।
ভালোমতো বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। আমরা সবাই হোমস্টে-র উদ্দেশ্যে নামতে শুরু করলাম। ফিরে এলাম অফুরন্ত ভালোলাগা নিয়ে। নির্জনতার এমন সুন্দর রূপ কোনওদিন ভোলার নয়।
যাতায়াত: হাওড়া, কলকাতা, শিয়ালদহ থেকে নিউ জলপাইগুড়িগামী যে কোনও ট্রেন, তারপর সেখান থেকে ভাড়া করা গাড়ি। থাকার ব্যবস্থা: হোম স্টে, গেস্ট হাউস, কিছু লজ ও রিসর্ট।