বর্ষাকালে মশাবাহিত, জলবাহিত ও বায়ুবাহিত অসুখ বেড়ে যায়। পরিবেশের ঘন ঘন বদলের কারণে শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের কারণে যেসব অসুখ হয়— যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা, অ্যাডিনো ইত্যাদি বাড়তে থাকে। মশার কারণে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়াও হয়। তাই এই অসুখগুলোর চিকিৎসা সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকলে অসুখের সঙ্গে লড়াইয়ে কিন্তু পেরে ওঠা যাবে না। তাই এই অসুখগুলি হলে প্রাথমিক করণীয় কী ও চিকিৎসা কোন পথে এগনো উচিত তা জেনে রাখা বাঞ্ছনীয়।
ডেঙ্গু হলে করণীয় কী: ডেঙ্গু মূলত আরএনএ ভাইরাসঘটিত রোগ। এই অসুখে গা-হাতে ব্যথা, চোখের তলায়, গাঁটে ও মাথায় ব্যথা হয়। হালকা থেকে ভারী জ্বর থাকতে পারে। তবে এগুলো আর পাঁচটা ভাইরাসঘটিত অসুখেও থাকে। পর্যাপ্ত বিশ্রাম, জলজাতীয় জিনিস (ফ্লুয়িড) বেশি করে খাওয়া ও প্যারাসিট্যামল— প্রাথমিক অবস্থায়  এই তিন অস্ত্রেই এই রোগকে বাগে আনা যায়। ডেঙ্গু মানেই হাসপাতালে নিতে হবে এমন নয়। বয়স ও ওজন অনুযায়ী প্যারাসিট্যামলের ডোজ নির্ধারিত করবেন চিকিৎসক।
কখন হাসপাতালে: ডেঙ্গু হলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উপর সরাসরি আঘাত আসে। ফলে রক্তনালীর সরু অংশ বা ক্যাপিলারিতে এই প্রভাব পড়ে। ফলে সেইসব বিশেষ অংশে রক্তজালিকার মধ্যে লিকেজ বা ছিদ্র দেখা দেয়। ফলে রক্তরসের মাধ্যমে জল ও প্রোটিন সবই বাইরে বেরিয়ে যেতে থাকে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে লোহিত কণিকাও বেরিয়ে যায়। ফলে হেমারেজ দেখা দেয়। তখন একে ডেঙ্গু হেমারেজিক ফিভার বলে। তখন লক্ষ রাখতে হবে রোগীর পা ফুলছে কি না, পেটে ব্যথা করছে কি না, বমি হচ্ছে কি না, প্রেশার কমে যাচ্ছে কি না। এসব উপসর্গ দেখা দিলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। তবে যদি প্রথম থেকেই প্যারাসিট্যামল দেওয়া শুরু হয় ও প্রয়োজনীয় নিয়ম মানা হয়, তাহলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লোহিতকণিকা বেরিয়ে যাওয়ার মতো বাড়াবাড়ি পর্যায়ে এই অসুখ গড়ায় না। তেমন হলে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। 
ম্যালেরিয়ার প্রকোপ: একসময় কুইনাইন দিয়ে এই রোগের চিকিৎসা করা হতো। তবে ইদানীং কুইনাইন খুব একটা ব্যবহার করা হয় না, বরং দুনিয়াজুড়ে ম্যালেরিয়ার তাণ্ডব কমিয়েছে একটি চীনা ওষুধ আর্টিমিসিন। এসিটি বা আর্টিমিসিন কম্বাইন্ড থেরাপি বা আর্টিসুনেট কম্বাইন্ড থেরাপি দিয়েই আজকাল ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা হয়। এই রোগেও প্রাথমিক অবস্থায় বিশ্রাম, তরল খাবার বেশি করে খাওয়া ও প্যারাসিট্যামলের উপর ভরসা করে রোগী। তবে তা রক্তপরীক্ষার রিপোর্ট আসা অবধি। ম্যালেরিয়া ধরা পড়লে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে, রোগীর শরীরের অবস্থা বুঝে চিকিৎসা শুরু হবে। দেরি করলে এই রোগ প্রাণ ছিনিয়ে নিতে পারে। 
চিকুনগুনিয়ার চিকিৎসা: আমরা বলি, চিকুনগুনিয়া হল ডেঙ্গুর ‘ভাই’! দু’টি অসুখই হয় এডিস ইজিপ্টাই মশার কামড়ে। একইরকম উপসর্গ থাকে। চিকিৎসার পদ্ধতিও অনেকটা এক। তবে চিকুনগুনিয়ায় ক্যাপিলারি লিকেজ কম হয়। কিন্তু শরীরে ব্যথাবেদনা ডেঙ্গুর চেয়ে অনেক বেশি থাকে। শরীরের হাড় ভেঙে গেলে যেমন যন্ত্রণা হয় এই অসুখে অস্থিসন্ধিগুলোতে তেমন ব্যথা হয়। রোগী ব্যথার জেরে বেঁকে অবধি যান! কোনও কোনও ক্ষেত্রে অসুখ সেরে যাওয়ার পরেও এক-দু’বছর গাঁটে গাঁটে ব্যথা থাকে। প্রাথমিক অবস্থায় এই রোগেও পর্যাপ্ত বিশ্রাম, জলজাতীয় জিনিস (ফ্লুয়িড) বেশি করে খাওয়ার পরামর্শ ও প্যারাসিট্যামল দেওয়া হয় রোগীকে। নজরদারিও চালাতে হয় ডেঙ্গুর মতোই। অত্যধিক জ্বর, পা ফোলা, পেটে ব্যথা, বমিভাব এসব তৈরি হচ্ছে কি না খেয়াল রাখতে হবে।  এসব উপসর্গ দেখা দিলে রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে। 
অ্যাডিনোকে কাবু করুন: শ্বাসযন্ত্রের উপরের দিকে (মূলত ন্যাসোফ্যারিঞ্জিয়াল অঞ্চলে) বাসা বাঁধে এই ভাইরাস। এই ভাইরাস আর পাঁচটা শ্বাসযন্ত্রে বাসা বাঁধা ভাইরাসের মতোই। এই অসুখ সারাতেও প্যারাসিট্যামল, বিশ্রাম, গার্গল, ভেপার নেওয়া ও ফ্লুয়িড খাওয়ার উপর প্রাথমিকভাবে ভরসা রাখতে হবে।  সাধারণত ৯৮-৯৯ শতাংশ অ্যাডিনো এতেই কমে। ইদানীং এইসব ভাইরাসে অনেকেই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে চান। কিন্তু ভাইরাসের আক্রমণে হওয়া রোগে অ্যান্টিবায়োটিকের তেমন কোনও ভূমিকা নেই। তবে এই সময় রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। তাই অনেক চিকিৎসক তাঁকে অন্য কোনও ব্যাকটিরিয়ার হানা থেকে দূরে রাখতে  অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে থাকেন। কথায় কথায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার এসব রোগে না করাই ভালো। এই রোগের ক্ষেত্রে প্যারাসিট্যামল খাওয়ার পরেও জ্বর দীর্ঘদিন থাকলে বা মাত্রা ছাড়ালে কিংবা শ্বাসকষ্ট শুরু হলে  এবং গা-হাতে-পায়ে ব্যথা খুব বাড়াবাড়ির পর্যায়ে গেলে, নিউমোনিয়া হয়ে গেলে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শিশুদের যেহেতু রক্তের ঘনত্ব কম হয়, তাই তাদের ক্ষেত্রে যে কোনও অসুখই খুব দ্রুত বাড়ে। তাই বাড়ির খুদে সদস্যের অ্যাডিনো হলে নজরদারি চালাতে হবে খুব বিচক্ষণতার সঙ্গে। এই রোগে উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসাই সেরা অস্ত্র।
ইনফ্লুয়েঞ্জার আধুনিক চিকিৎসা: অ্যাডিনোর মতোই এই ভাইরাস শ্বাসযন্ত্রের উপরের দিকে বাসা বাঁধে। এর উপসর্গ, প্রাথমিক চিকিৎসা সবই অ্যাডিনোর মতোই। এই অসুখ সারাতে বর্তমানে খুব শক্তিশালী ভ্যাকসিন আছে। বয়স্কদের বেলায় এই ভ্যাকসিন বছরে একবার নিতে পরামর্শ দিই আমরা। এতে ফ্লু জাতীয় রোগ অনেক নিয়ন্ত্রণে থাকে। 
লিখেছেন মনীষা মুখোপাধ্যায়