পারিবারিক ধর্মকর্ম পালনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ। সন্তানের কর্মসাফল্যে গর্ব। গবেষণায় অগ্রগতি। ... বিশদ
রেকর্ডের গান ধরলে গান নিয়ে পঞ্চাশটা বছর পেরিয়ে এলেন। কিন্তু বাস্তবে গানজীবনের বয়স তো আরও বেশি?
হ্যাঁ, আমি খুব ছোটবেলা থেকে সঙ্গীতচর্চার পরিমণ্ডলে বড় হয়েছি। বাবা হরিহর শুক্লা ছিলেন হিন্দুস্তানি ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের মহীরূহ। আমরা ভাইবোনরা ছোট থেকে বাবার কাছে গান শিখেছি। তবে সকলের মধ্যে আমি ছিলাম বেশি গানপাগল। আমার যেন সবকিছুতেই গান তাড়া করত। সারাদিন গুনগুন করে গান গাইতাম। এখনও তা-ই। সেই হিসেবে ধরলে আমার গানজীবন গোটা জীবনটাই।
যে রেকর্ড ধরে আপনার গানের পঞ্চাশ বছর ধরা হচ্ছে, সেই গানের কথা মনে পড়ে?
ও মা! মনে পড়বে না? প্রথম রেকর্ড যে! যদিও তার আগে আমি একটা ছড়ার গান রেকর্ড করেছি। তবে এই গানটিই আমাকে প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। গানটা ছিল, ‘এ তো কান্না নয় আমার’। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় শৈলেন মজুমদারের সুরে। ওটা ছিল পুজোর গান। সাল বোধহয় ১৯৭১-’৭২ হবে। এর পরেই আমি ছবিতে গান গাওয়ার সুযোগ পাই। সেই হিসেবে ধরলেও কিন্তু ৫০ পেরিয়ে গিয়েছে গানজীবন। ৫১-৫২ চলছে।
বাবার কাছে হাতেখড়ি হল, তারপর?
তারপর নানা গুরুর কাছেই গিয়েছি। গান রেকর্ড করতে করতেও নানাজনের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। শেখার তো শেষ নেই! পরে আমি চিন্ময় লাহিড়ীর কাছে গান শিখেছি, আলি আকবর খাঁ সাহেবের কাছে, পণ্ডিত রবিশঙ্করের কাছেও শেখার ভাগ্য হয়েছে আমার। তবে আগাগোড়া বাবার তত্ত্বাবধানে ছিলাম। গান রেকর্ড করতে গিয়েও নানাবিধ বিষয় শিখেছি। এখানে মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র সকলের কাছে থেকেই কিছু না কিছু শিখেছি। কিন্তু মান্নাদার মতো ট্রেনার আমি দেখিনি! কী অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল লোকটার! রেকর্ডিংয়ে ভুল করলে সাধারণত অন্য সুরকার বা মিউজিক ডিরেক্টর হয়তো বলতেন ‘হচ্ছে না, আবার গাও’, কিন্তু মান্নাদা বুঝিয়ে দিতেন কেন হচ্ছে না, কীভাবে গাইলে হবে। হেমন্তদাও আমাকে সন্তানের মতো দেখতেন।
পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও উস্তাদ আকবর আলি খাঁ, দু’জনের সঙ্গেই কাজ করেছেন। শিখেছেনও। সেই অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
পণ্ডিত রবিশঙ্করকে আমি খুব ভয় পেতাম। ওঁর সুরে গান করার সুযোগ আসে ১৯৮৬-’৮৭ সালে। জানো, রবিশঙ্করের সুরের গান কিন্তু খুব কঠিন গাওয়া! কিন্তু উনি গাওয়ার আগে খুব উৎসাহ দিতেন। আমার খুব সৌভাগ্য, সঙ্গীতচর্চার পথে আমি ওঁকে অনেক কাছ থেকে পেয়েছি। যখনই গাইতাম ওঁর সুরে, উনি বলতেন এই জায়গাটা এমন করে করো, ওই জায়গাটা এভাবে বলো, এই কৌশলগুলো গানটাকে সহজ করে দিত।
আর উস্তাদ আলি আকবর খাঁ সাহেবের সঙ্গে স্মৃতি?
ভরপুর গানজীবন তখন। আমি বাংলা গান গাইতে চেয়েছি বরাবর। খুব খুঁজতাম কার থেকে ভালো বাংলা গান পাব। তা আমি যখন উস্তাদজিকে গিয়ে বললাম যে আমি বাংলা গান গাইতে চাই, উনি আমাকে প্রথম যে গানটা শেখালেন তা ওঁরই তৈরি রাগ চন্দ্রনন্দনের উপর। গানটা ছিল ‘স্মৃতি শুধু থাকে, সেই তো মনে রাখে’। এরপর ওঁর পছন্দের আর একটি গান আমাকে দিয়েছিলেন। সেটা আবার ভৈরবী রাগের উপর কিন্তু ভৈরবীকে একটু অন্যভাবে প্রয়োগ করা হয়েছিল তাতে। ওরে বাবা, তার কী লয়! বাপ রে! যেমন একটা গান আমাকে দিয়েছিলেন, ‘মনে পড়ে তোমারে’, এই গানটা নিজে লিখেওছিলেন উস্তাদজি। এতে দুটো রে, দুটো ধা আছে। এসব অপূর্ব সব গান আমি তাঁদের সান্নিধ্যে এসে গাইতে পেরেছি এটা ভাবলেই আমার গায়ে কাঁটা দেয়।
হেমন্তবাবুর সঙ্গে প্রথম কাজের কথা মনে পড়ে?
হ্যাঁ, সেসব দিন তো সম্পদ! উনি আমাকে একটা গান দিয়েছিলেন ‘ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো না’। আমি তো ক্লাসিক্যালের মেয়ে, খুব কাজটাজ দিয়ে গাইছি। অমনি হেমন্তদা বকুনি দিলেন, বললেন, ‘ওরে তুই বৃষ্টিকে আরজি জানাচ্ছিস যে তুই কেঁদেছিস, সেই জল যেন সে না ছোঁয়, এত কাজ রাখবি কেন আরজিতে? আরও সহজ করে দে জায়গাটা।’ ব্যস গানটা এক টেকে ওকে হয়ে গেল। হেমন্তদার মতো এমন সহজ মানুষও খুব কম দেখেছি।
ক্লাসিক্যাল বলায় মনে পড়ল, সলিল চৌধুরীও নাকি আপনাকে ধ্রুপদী ঘরানার বাইরে ভাবতেই পারেননি?
আরে হ্যাঁ, যখন সলিলদার কাছে গিয়ে বললাম বাংলা গান করতে চাই, সটান বললেন, ‘তুই তো ক্ল্যাসিক্যাল!’ আমি বললাম না না, আমি বাংলা গানও গাইতে চাই। তখন আমাকে একেবারে ক্লাসিক্যাল বেসের ‘দে দে রে সখী চোখে নীলাঞ্জন’ গানটা দিলেন। আমি বললাম, দাদা এটা খুব ভালো গান। কিন্তু আমি আপনার স্টাইলের গান গাইতে চাই। তখন তিনি আমাকে নিজের স্টাইলের বেশ কিছু গান দিলেন। আমার ভাগ্য ভালো যে আমার গাওয়া সেই গানগুলো ওঁর খুব ভালো লেগেছিল।
অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় আপনাকে দিলেন ‘এখনও সারেঙ্গীটা বাজছে’। আর আপনি সেই গান অমর করে দিলেন। এই গান তৈরির গল্পটা যদি বলেন...।
সে এক গল্প বটে! অভিজিৎদার কাছে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন পুলকদা। অভিজিৎদা আমার বাবাকে চিনতেন। জানেন যে আমি গান শিখেছি ছোট থেকে। একেবারে প্রথমে আমাকে একটা ছোটদের গান দিলেন ‘শিবঠাকুরের গলায় ঝোলে’। তারপর ধীরে ধীরে ‘সারেঙ্গীটা বাজছে’ হল। এই গান গাওয়ার সময় আমি যতবার ‘গা রে মা গা’ জায়গাটা গাইছি, ততবার খুব ক্ল্যসিক্যাল ধাঁচের হয়ে যাচ্ছে। তখন আমাকে বকলেন। বললেন, ‘এই গানটা গাওয়ার সময় তুমি ভুলে যাও তুমি হরিহর শুক্লার মেয়ে।’ তারপর জায়গাটা সহজ করে গাইতেই যে কী খুশি হয়েছিলেন!
মান্না দের সঙ্গেও তো কাজ করছেন, নতুন কী শিখলেন তাঁর থেকে?
আরে মান্নাদাকে আমি আমার গুরু মনে করি। মান্নাদার নিজের ক্ল্যাসিক্যাল বেস এত ভালো ছিল, এত ভালো ছিল...! যখন গাইতেন শুনলে মনে হতো খুব সহজ গান বুঝি, কিন্তু গাইতে গেলে বোঝা যেত কী কঠিন গান! একটা গান ছিল ‘আমি সুখী হলে দুঃখই যদি পাও তুমি...’, এই ‘তুমি’ জায়গাটা আমার কিছুতেই হচ্ছিল না। মান্নাদা এই জায়গাটা আমাকে দিয়ে অনেকবার গাইয়েছিলেন। যতক্ষণ না নির্ভুল হচ্ছে, ছাড়েননি। মান্নাদা যখনই কোনও গান দিতেন, আমি আগে ওঁকেই গাইতে বলতাম। উনি কেমন গাইছেন শুনে শুনে গানটা তোলার চেষ্টা করতাম। একটু চালাকি করতাম আরকি (হাসি)। মান্নাদা কেমন করে গাইছেন এটা বুঝতে পারলেই গানটা তোলা হয়ে যেত। মান্নাদা এত ভালো শেখাতেন, খুব কঠিন জায়গা না হলে কেন হচ্ছে না এটা বারবার ধরিয়ে দিতেন, যাতে ভুলটা বুঝতে পারি।
আপনার খুব স্মৃতিশক্তি? লতা মঙ্গেশকরও নাকি গান ভুলে গেলে আপনাকে তলব করতেন?
হা হা হা। আমার আসলে গানের কথা সব মনে থাকে। লতাজির বেশিরভাগ গান আমার মুখস্থ। একবার কলকাতায় অনুষ্ঠান করতে এসেছেন লতাজি। অনুষ্ঠানের আগে গানের কিছু লাইন ওঁর মনে পড়ছে না। হোটেলে ডাক পড়ল আমার। আমি গিয়ে কিছু গান মুখে মুখে বললাম, উনি লিখে নিলেন। মনে পড়ে, ওঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা একটি অনুষ্ঠানে। একইসঙ্গে গান গাইব আমরা। গিয়ে দেখি, সেদিন নিজের গলা নিয়ে বেশ টেনশনে আছেন লতাজি। বেশ কয়েকটা ফ্লাস্ক চারপাশে। কোনওটায় চা, কোনওটায় গরম জল। একটু যেন নার্ভাস লাগছিল। কিন্তু যখন স্টেজে উঠলেন, উফ সে কী গান! প্রথম গানটা গেয়ে এসে আবার স্টেজ থেকে বেরিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন , ‘হ্যায়মন্তী, ঠিক লাগা?’ আমি কত ছোট ওঁর থেকে! এই বিনয়, এই শেখার ইচ্ছে, অতৃপ্তি কখনও ভুলব না।
পঞ্চাশ পেরিয়ে অতৃপ্তি কি আপনাকেও তাড়া করে?
অতৃপ্তই তো। খুব অতৃপ্ত। কিছুই যেন ভালো করে হল না। নিজের গানগুলো শুনলে ভাবি আরও কত ভালো হতে পারত, আরও কত ভালোভাবে গানটা করা যেত...।
পুরস্কার থেকে শুরু করে সমৃদ্ধি, গান আপনাকে সব দিয়েছে। গানকে কিছু দিতে ইচ্ছে করে না?
গান আমাকে সব দিয়েছে। আমারও গানকে ঘিরেই সবটুকু দিন কাটে। তবে গান শিখিয়ে ‘গুরু’ হয়ে উঠতে আমার ভালো লাগে না। আমি নিজেকে পারফর্মার হিসেবেই দেখতে চাই। ইদানীং যেসব গান তৈরি হচ্ছে, সেগুলো মনে রাখা যাচ্ছে না বেশিদিন! এটাই খুব চিন্তার। তবু নতুন প্রজন্ম ভালো কিছু করছে কি না দেখার জন্য মুখিয়ে থাকি। বিভিন্ন ভাষায় ছোটরা কী কাজ করছে, কী ভাবছে, তা জানতে আমার খুব ইচ্ছে করে। গানকে আমার দিয়ে যাওয়া বলতে এই অপেক্ষা আর রোজ গানকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকা।
আপনার গানজীবনের ৫০ বছর উপলক্ষ্যে আগামিকাল উত্তম মঞ্চে একটি অনুষ্ঠান রয়েছে। সারাজীবন দেশ-বিদেশের নানা মঞ্চে অনুষ্ঠান করেছেন, কোথাকার শ্রোতা সবচেয়ে পছন্দের?
বেঙ্গল ওয়েব সলিউশন এই অনুষ্ঠান পরিকল্পনা করেছে। শ্রীকান্ত আচার্য থাকবেন সঙ্গে। শ্রোতা সবসময় আমাদের কাছে ঈশ্বর। তাঁরা আছেন বলেই আমরা আছি। কলকাতার শ্রোতাও বেশ ভালো। তবে মন জিতে নিয়েছেন মফস্সলের ও বাংলাদেশের শ্রোতারা। তাঁদের মতো শিক্ষিত কান আমি কম দেখেছি।