পারিবারিক ধর্মকর্ম পালনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ। সন্তানের কর্মসাফল্যে গর্ব। গবেষণায় অগ্রগতি। ... বিশদ
গানের খোঁজে
চলার পথে গান কুড়ানোর নেশা তাঁকে পেল কীভাবে? আলোচনার শুরুতেই প্রশ্ন করেছিলাম চন্দ্রা মুখোপাধ্যায়কে। তার আগে জেনেছি, এপার ওপার— দুই বাংলার প্রান্তিক মেয়েদের রোজকার জীবনযাপন, কাজকর্ম, উৎসব, শোকদুঃখ সবকিছুর সঙ্গে লেপ্টে থাকা হাজারো গান খুঁজে পরম যত্নে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি তিনি করে চলেছেন অক্লান্তভাবে। প্রায় হারিয়ে যেতে বসা সে ঐতিহ্য হাতড়ে দেখার জন্য কখনও ছুটে গিয়েছেন বর্ধমান তো কখনও জলপাইগুড়ি। কথায় কথায় গান খুঁজে বের করার গোড়ার পথটা ফিরে দেখলেন ইংরেজির প্রবীণ শিক্ষিকা। চন্দ্রা বলে চলেন, ‘গান ভালোবাসতাম ছোট থেকেই। কিন্তু প্রথাগতভাবে শেখার সুযোগ হয়নি। স্কুলের পড়া শেষ হওয়ার পরে কলেজে ঢুকে মন দিলাম গানে। নীহাররঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে ক্লাসিকাল শিখতে শিখতে রবিতীর্থে রবীন্দ্রসঙ্গীতের চর্চাও চলছিল। তখন সত্তরের দশক। উত্তাল সময়। আমি যা শিখছিলাম, তাতে একটা ‘উচ্চবর্গীয় ছাপ’ ছিল। সেখানে সাধারণ মানুষের সাধারণ কথা খুব বেশি উঠে আসত না। অথচ মানুষের জীবনের গান কোথায় পাব— প্রশ্নটা জাগছিল নানাবিধ পড়াশোনার সূত্রে। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘লোকায়ত দর্শন’ একদিন হাতে এল। সেখানে জানলাম, উপনিষদেরও আগের যুগে মানুষ অন্ন বা ভাতের জন্য গান গাইত। উপনিষদে যে কারণে অন্ন নিয়ে বহু স্তোত্র দেখি আমরা। বিষয়টা আমাকে নাড়া দিয়েছিল। মনে হল, এর কোনও পরম্পরা কি খুঁজে পাওয়া সম্ভব? সেইসময় বহু গুণী মানুষ বেঁচে। যেমন বিজন ভট্টাচার্য। তাঁর নাটকে এমন জীবন থেকে উঠে আসা গান কিছু কিছু আমরা শুনেছি। ওঁর সঙ্গে কথা বললাম। মাটির মানুষের গান কেমন, জানতে চেয়েছিলাম ওঁর কাছে। উনি পাঠালেন খালেদ চৌধুরীর কাছে। মঞ্চ এবং প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে খালেদবাবুর নাম। পাশাপাশি একটা ইনস্টিটিউট ছিল— খালেদ চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস এবং নীহার বড়ুয়া মিলে লোকসংস্কৃতি নিয়ে কাজ করার জন্য করেছিলেন এটি। জীবনে যত শিল্পের দাপট বাড়বে, লোকসংস্কৃতি কোণঠাসা হবে— এই বোধ থেকে লোকসংস্কৃতিকে মূল্য দিতে ওঁরা কাজ করছিলেন। একদিন খালেদদার কাছে গিয়ে বললাম, দেশের গান শিখতে চাই। তিনি তখন বললেন, ‘লোকসঙ্গীতেও এখন ভেজাল ঢুকে গিয়েছে। তুমি ঠিকঠাক শিখতে চাইলে যাও মৃণাল বড়ুয়ার কাছে।’ মৃণাল ছিলেন মনোচিকিৎসক, সারা সপ্তাহ ডাক্তারি করে রবিবার গান শেখাতেন। তার জন্য পয়সাকড়ি নিতেন না। অসমের গোয়ালপাড়ায় প্রমথেশ বড়ুয়াদের পরিবারের মানুষ মৃণালদা। ওঁর কাছে ভাওয়াইয়া, চটকা, পয়ার ইত্যাদি শিখতে শুরু করি। সেইসময় উনি মুসলমান মেয়েদের বিয়ে সংক্রান্ত একটা গান শেখালেন। সেই প্রথম জানলাম মেয়েদেরও আলাদা করে গান হয়। কিন্তু শুনেছি ইসলামে গানকে ততটা ভালো চোখে দেখা হতো না, মেয়েরা পর্দানশিন, তাঁরা কীভাবে গান গাইবে? প্রশ্ন মনে জাগছিল। উত্তর খুঁজতে গেলাম মৃণালবাবুর মায়ের কাছে, অর্থাৎ নীহার বড়ুয়া (যিনি ওই ইনস্টিটিউটের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন)। নীহারদি ছিলেন অদ্ভুত মানুষ। যখন ওঁর কাছে প্রথম গেলাম, ওর ৭৫ বছর বয়স। শুভ্র কেশ। জানলাম, উনি বাঘ শিকারে যেতেন, সাপ পুষতেন! যাবতীয় দেশজ জিনিস সংগ্রহ করার আগ্রহ ছিল তাঁর। যেমন পাখির পালক, ডিম থেকে শুরু করে লতাপাতা। তার সঙ্গে ছিল দেশের গানও। প্রমথেশের সঙ্গে নীহারদির তিন বছরের তফাত বয়সের। তাঁরা যে বয়সে খেলে বেড়াতেন, সেসময় তাঁদের বাড়িতে নানারকম মানুষ আসতেন। মেয়েরা নেচেগেয়ে শোনাত। সেসব গানই নীহারদি ভালোলাগা থেকে শিখতে শুরু করেন। কিন্তু জমিদারবাড়ির মেয়ে এসব গান গাইছে, এটা ভালো চোখে দেখা হতো না। প্রভাতচন্দ্র বড়ুয়া, তাঁদের বাবা তখন জমিদার। নীহারদি বাবাকে ডেকে গান শুনিয়ে বুঝিয়েছিলেন, সেসবের মধ্যে কত মণিমুক্তো লুকানো আছে। বাবা আপত্তি করেননি। আজও যেসব গান চর্চায় রয়েছে, তাতে নীহারদির বড় ভূমিকা ছিল। গানের বিরাট সংগ্রহ ছিল তাঁর কাছে। তার মধ্যে মেয়েদের গানও প্রচুর ছিল। নীহারদির কাছেই জেনেছিলাম শুধু মুসলমান মেয়ে নয়, রাজবংশী মেয়ে, মেছুয়া মেয়ে প্রত্যেকের আলাদা অনুষ্ঠান, আলাদা গান। তখন টেপ রেকর্ডারের সুবিধা ছিল না। ওঁর স্মৃতিতে যা ছিল, তা থেকেই শিখতাম। দুপুরে ওঁর কাছে, বিকেলে মৃণালদার কাছে। গানগুলো মূলধারার গান তো নয়। লোকসংস্কৃতি নির্ভর। আমরা আমাদের ইতিহাস দিয়ে ওটা হঠাৎ বুঝতে পারব না।’
মুক্তি গানেই
বাংলার উচ্চবর্গীয় নারীসমাজের যে নির্মাণ আমরা এতদিন দেখে এসেছি বা জেনে এসেছি, সেখানে উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে মুক্তির কথা ক্রমে প্রবল হয়েছে, জানালেন চন্দ্রা। তার আগে নারী মানেই বঞ্চিত, নিপীড়িত, অবলা, পরনির্ভর— এমন একটা প্রতিফলন ছিল মূল ধারার সমাজে। অথচ চন্দ্রা মাটির কাছাকাছি থাকা যে মেয়েদের গান শুনলেন, সে গান কিন্তু অন্য কথা বলছিল। ‘সেখানে মেয়েরা নেচেগেয়ে জীবনকে উদ্যাপন করছে। লজ্জায় নুয়ে পড়ছে না। নিজেদের কথা নিজেরা বলতে পারছে। গানের মধ্যে দিয়ে সব চাহিদার কথা বলছে নির্দ্বিধায়..,’ না থেমে বলতে থাকেন চন্দ্রা, ‘সেসব গান শুনে চমৎকৃত হতে হয়। আমি শিখতাম যখন, প্রায় মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়। নীহারদিকে দু’-তিন বছর পেয়েছিলাম। তারপর উনি অসম চলে যান। আমার মনে হল, আর বুঝি এই গান শেখার সুযোগ হবে না।’ তারপরেও চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। নানাভাবে দেশের গান টুকটাক করে সংগ্রহ চলছিল। তখনও অবশ্য চন্দ্রা ভাবেননি একদিন সর্বশক্তি দিয়ে বেঁচে থাকার গান সংগ্রহ করার কাজেই নিয়োজিত করবেন নিজেকে। শিক্ষকতা করতেন, কলকাতা বিমানবন্দরের কাছে খলিসাপোতা আদর্শ বিদ্যালয়ে— খুব দরিদ্র মেয়েদের স্কুল, কিন্তু বড় মায়ায় বাঁধা। চন্দ্রার কথায়, ‘আমার প্রাণের স্কুল। নানাভাবে গড়ে তুলেছি ছাত্রীদের। স্কুলে একদিন ক্লাস নিতে নিতেই শুনলাম ভেসে আসছে গানের সুর, ঢাকের শব্দ। ছাত্রীদের কাছে জানলাম, ওটা বিয়ের গান। শুনেই মন উচাটন। ছাত্রীদের বললাম, বিয়ে মিটে গেলে একদিন নিয়ে যাবি, গান শুনব।’ উদ্বাস্তু পল্লি এলাকায় ছিল চন্দ্রার স্কুলটি। এরপর মাঝে মাঝেই যেতেন তিনি। ঢাকার এক মৃৎশিল্পী পরিবারের বাস ছিল ওখানে। চন্দ্রা চলে গিয়েছেন ওঁদের গান শুনতে। ওঁরা অবাক, এমন তো কেউ করে না! স্কুলছুটির পর প্রতি শনিবার গানের খোঁজে ছুট দিতেন দিদিমণি। ছাত্রীদের কাছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিতেন কার কোথায় দেশ, দিদিমা ঠাকুরমা আছেন কিনা...। তাঁদের কাছে যাওয়া, যদি দুটো-একটা গান পাওয়া যায়। সেটা নয়ের দশকের শেষের দিক। তারপর থেকে ২৫-৩০ বছর। থামেনি গান খোঁজা।
যাত্রা অব্যাহত
স্কুলছাত্রীদের ধরে বা তাদের আত্মীয়দের থেকে নানাভাবে গান জোগাড় হলেও খুব বেশি সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছিল না। মূলত যোগাযোগের অভাবে। তবু হাল ছাড়েননি চন্দ্রা। ওপার বাংলা-এপার বাংলা দু’জায়গাতেই খোঁজ চাই। কোনও বই বা প্রকাশকের সূত্র ধরে যোগাযোগ করারও চেষ্টা করেছেন। এরপরে রেকর্ডার, মোবাইল এসেছে। কাজটা সহজ হয়েছে। কোনও হস্তশিল্প মেলায় গিয়ে চন্দ্রা সোজা চলে যেতেন শিল্পীদের কাছাকাছি। জানতে চাইতেন তাঁর গ্রামের কথা, গানের কথা। ক্রমে ক্রমে একটা নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে। চন্দ্রার এই বিপুল সংগ্রহের খুব ছোট একটা অংশ নিয়ে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে গত বছর— ‘নারীর গান, শ্রমের গান’। সাংসারিক জীবনযাত্রার প্রতিটি ধাপের জন্য হাজার হাজার গান রয়েছে মেয়েদের। তা সে ঘরদোর ঝাঁট দেওয়া হোক বা গর্ভধারণ। কখনও হয়তো সেটা দু’লাইনের গান। এধরনের অন্তত ছ’হাজার গান সংগ্রহের পর চন্দ্রার উপলব্ধি, ‘কতটুকুই বা করতে পেরেছি!’ গানের সমুদ্র থেকে বেছে চারশো শ্রম সংক্রান্ত গান নিয়ে বই হয়েছে। এখন ইউটিউব চ্যানেলও করেছেন, গীদালি নামে। সেখানে শুনতে পাবেন চন্দ্রার গলায় চরকার গান, কাঁথার গান, ঝাড়ু দেওয়ার গান। শাড়ি পরা নিয়েও মেয়েদের কত গান! কারণ তাও যে মেয়েদের ভালোলাগা। বিয়ে নিয়ে আনন্দের সঙ্গে বিষাদের গানও রয়েছে। যে গানে মেয়েরা প্রশ্ন তোলে, কেন আমাকেই চলে যেতে হবে বাপের ঘর ছেড়ে? সম্প্রদায়ভেদে গানের ভাষা সুর আলাদা। ইউটিউবে পরিচিতির পর অনেকেই এই গানে আরও উৎসাহ দেখিয়েছেন। চন্দ্রা নিজে পত্রপত্রিকাতেও লিখেছেন। পরে হাত দিয়েছেন বইতে। আরও বই করার ইচ্ছে রয়েছে তাঁর।
প্রান্তিক স্বর
যে কথাটা খানিক আগে ছুঁয়ে গেল আলোচনায়, ফিরে এলাম সেখানে। চন্দ্রা বলেছিলেন, প্রান্তিক নারীর গানের ভাষা থেকে কখনওই মনে হয় না নারী অবলা বা তাঁর কোনও স্বর নেই। কিন্তু সেটা সমাজের মূল স্রোতকে কতটা ছুঁতে পারছে? চন্দ্রা বললেন, ‘ইতিহাস ভূগোল সমাজতত্ত্বের পড়াশোনার পরে বুঝেছি, অভিজাত শ্রেণি বা যেখানে ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রভাব প্রবল, সেখানে মেয়েদের জীবনযাপনটাই এমনভাবে গড়ে তোলা হয়েছিল যে নারীস্বর প্রায় শুনতে পাওয়া যেত না। এটা হয়তো সমাজের খুব ছোট একটা অংশ। কিন্তু বাকি সমাজটা কী বলছে? কৃষির সঙ্গে জড়িত যে গ্রামসমাজ, যে খেটে খাওয়া মানুষ সেখানে রয়েছে, সেখানে কী নারী কী পুরুষ— তাঁদের তো ঘরে বসে থাকলে চলে না। রাষ্ট্রসংঘের রিপোর্ট বলে এখনও কৃষিকাজে ৭০-৮০ শতাংশ কাজ মেয়েদের করতে হয়। আমাদের দেশেও। লাঙল আসার পরেও বহু কাজ মেয়েদের করতে হয়। ধান রোয়ার কাজ যেমন ধরেই নেওয়া হয় মেয়েদের কাজ। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া মেদিনীপুরের কিছু অঞ্চল এবং উত্তরবঙ্গের বেশ কিছু অঞ্চল ঘোরার সুবাদে জানি যে এটা ওঁদের বিশ্বাস, ‘চুক দিয়া ধান রুইয়ে ধান বকবকাই যাবে...।’ চুক দিয়া মানে, গানটা গেয়েই ধানটা রুইতে হবে, তা না হলে ধান হবে না। রোয়ার কাজটা করতে করতেই ধান রোয়া গীত বা অপাগারা গীত (উত্তরবঙ্গে বলে) মেয়েরা করবেন। মেয়েরা উর্বরতার প্রতীক। তাদের গানের সুর যেন জন্মদাত্রীর সুর হয়ে ধানচারাকে বাঁচিয়ে রাখবে, আশ্রয় দেবে। গানের সুর যেমন মানবশিশুকে যত্ন করে, তেমনই ধানচারাকেও আরাম দেবে। এখানে মেয়েদের আর্থিক ভূমিকাও খুব স্পষ্ট।’
এই সূত্রে আর্থিক ভূমিকার কথাটাও বিশদ ব্যাখ্যা করলেন চন্দ্রা, ‘যে সমাজে মেয়েদের আর্থিক ভূমিকা সক্রিয়, সে সমাজে মেয়েদের অবস্থান আলাদা। তাদের পৃথক বক্তব্য আছে, তাদের জীবনযাপনের পদ্ধতিটা আলাদা, তারা জীবনকে দেখে অন্যভাবে।’ তবু প্রান্তিক নারীর এই স্বর বা এক্ষেত্রে বলা ভালো, এই সুর মূলধারায় সেভাবে মেশেনি। তাই আমাদেরও জানা হয়নি নারীর স্পষ্ট অবস্থান আগেও ছিল। সুরে সুরে জানান দিত তারা। দেখার এই ধরনকেই কাঠগড়ায় তুলে চন্দ্রা বলে যান, ‘আমরা চিপকো আন্দোলনের (বৃক্ষরক্ষার জন্য গাছকে জড়িয়ে উত্তরাখণ্ডে ১৯৭৩ থেকে শুরু হয় যে আন্দোলন) কথা জানি। অথচ আমরা জানি না, কত যুগ আগে থেকে আমাদের মা-দিদিমাদের পরিচিত কোনও জেলায় মেয়েরা গাছকে জড়িয়ে ধরে সই পাতাত। সইওয়ালার গান আছে। গান গেয়ে গাছের সঙ্গে কোলাকুলি। বৃষ্টি নিয়ে গান আছে। শুধু মানুষের জন্য নয়, সাধের পোষ্যটির জন্যও মেয়েরা গান গেয়ে জল চাইছে প্রকৃতির কাছে। বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় রাখার কী অসাধারণ প্রয়াস! ওরা জানে গাছ বাঁচলে তবে আমি বাঁচব। সবাইকে নিয়ে এই জীবনযাপন ওরা সেলিব্রেট করত, প্রকৃতির কাছে নত হয়ে। জলকে আত্মীয় জ্ঞান করে ওরা। বাড়িতে বিয়ে হলে জলকে যেমন নিমন্ত্রণ করা হয়। জল জঙ্গল মাটির সঙ্গে ওরা একাত্ম। শহুরে সংস্কৃতির নজরে এটা বোঝা মুশকিল।’
মেয়েদের গান বিয়ের মতো প্রতিষ্ঠান নিয়েও নানা প্রশ্ন তোলে। চন্দ্রা জানান, বাঙালি সংস্কৃতিতে আছে, ছেলে বিয়ে করতে যাওয়ার আগে মাকে বলে যায়, মা তোমার জন্য দাসী আনতে যাচ্ছি। অথচ এমন একটি গানের কথা তিনি পেয়েছেন যাতে বলা হচ্ছে, ‘আমার মুখের দোসর নাই...।’ অর্থাৎ আমার কথা বলার বন্ধু নেই, তাই তাকে আনতে যাচ্ছি। এই আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি তো জীবন থেকেই উঠে আসে। চন্দ্রার কথায় অবাক হয়ে ভাবি আমাদের সমাজেই তবে পিতৃতন্ত্রের চাপ বেশি? সহমত হন অভিজ্ঞ দিদিমণি। বলেন, ‘একবার কাটোয়ায় বাড়ির ধান শুকানোর কাজ করেন, এমন এক দিদির কাছে গান শুনেছিলাম। তিনি গাইলেন কন্যাবিদায়ের গান, মেয়ে তার মাকে বলছে— ‘বাড়ির কাছে একটি আমগাছ/ বিস্তর বিস্তর আম ধরসে/একটি আম ছিঁড়সিলাম আমি/কতই মুখ করসো তুমি/আজি কেন কান্দস মা ধন/ সেই না আম গাছটি ধরে...।’ অর্থাৎ যে আমগাছের আম পেড়েছিলাম বলে তুমি একদিন বকেছিলে, আজ আমি সেটা ছেড়ে চলে যাচ্ছি, এখন তুমি কাঁদছ কেন? সঙ্গত প্রশ্ন। গানটি গাইতে গাইতে ওই দিদি হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেন, গাওয়া শেষ করতে পারেননি...। তাঁর নিজের কথা, মায়ের কথা, আমগাছের কথা, হারিয়ে যাওয়া গ্রামের কথা ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল । গোটা শৈশবটা যেন উথালপাথাল করে তাঁকে কাঁদিয়েছিল।’ এ যুগেও এমন সুর এখনও ছুঁয়ে যায় কোথাও কোথাও। মূল স্রোত কি মুখ ফিরিয়েই থাকবে সে সুর থেকে?
আশার কথা
চন্দ্রা বলেন, ছবিটা যতটা হতাশাব্যঞ্জক মনে হয়, আদতে তা নয়। সেটাই তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়। এই প্রজন্মের আগ্রহ তাঁকে নিশ্চিন্ত করে। তাঁর কথায়, ‘আমি যতটা কাজ করেছি, যতটা মুখে মুখে ছড়িয়েছে, তাতে এখন বিভিন্ন কলেজে বক্তব্য রাখার জন্য ডাক পাই। বোলপুর বা হেতমপুর কলেজ হোক বা কলকাতার কোনও কলেজ, পড়ুয়ারা শুনছে। আগ্রহ দেখাচ্ছে। আমার কাছে এটাই আশার কথা। অনেক পড়ুয়া আমায় বলে, তারা তাদের গ্রামেও শুনেছে এমন গান। তারা গভীরে বুঝতে চাইছে। এই চেতনা সর্বস্তরে পৌঁছলে মনে হয় সবটা হারিয়ে ফেলিনি। প্রযুক্তির উন্নতিও সহায় হয়েছে। আগ্রহী পড়ুয়ারা নিজের নিজের গ্রামে গিয়ে যদি তাদের নিজস্বতাটুকু তুলে আনতে পারে, সেটা হবে বড় পাওয়া। আমি সংগ্রহ শুরু করেছিলাম, যাত্রাপথে কত মানুষ হারিয়ে গিয়েছেন। এক এক জনের সঙ্গে যেন একটা শিকড় সরে যাওয়া..।’ ধারাবাহিকতার কান্ডারি হয়ে এগিয়ে চলেছেন চন্দ্রা। শহুরে কান যদি আর একটু মনোযোগী হয়!