পারিবারিক ধর্মকর্ম পালনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ। সন্তানের কর্মসাফল্যে গর্ব। গবেষণায় অগ্রগতি। ... বিশদ
আজ থেকে মাত্র দুই দশক আগেও যেসব পেশায় মেয়েদের অস্তিত্ব টের পাওয়া যেত না, এখন সেখানে মহিলারা দিব্যি ঢুকে পড়েছেন। তাই এযুগে আর পেশার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বিভেদ চলে না, বলছিলেন কলকাতায় কনট্র্যাক্টর ব্যবসায়ী সীমা দত্ত। তাঁর কথায়, ‘কাজের কোনও নারী পুরুষ ভাগ হয় না। যে যেমন কাজে পটু, যার যেদিকে আগ্রহ সে তেমন কাজ করবে এটাই দস্তুর।’ কিন্তু তেমনটা হয় কই? এখনও বিভিন্ন পেশা রয়েছে যেখানে মূলত পুরুষরাই কাজ করেন। ‘ওই যে মূলত শব্দটা বললেন, ওটাই আসল। তার মানেই পুরুষের আধিপত্য থাকলেও মহিলাদেরও বাদ দেওয়া যাচ্ছে না। আর হ্যাঁ, কনস্ট্রাকশনের ব্যবসা, ঠিকাদারি বা কনট্র্যাক্টর হিসেবে লেবার খাটানোর কাজ— এগুলো অনেকাংশেই পুরুষ অধ্যুষিত। কিন্তু প্রথা ভাঙতে আবার এযুগের মহিলাদের জুড়ি মেলা ভার। তাই সব পেশাতেই মোটামুটি নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে ফেলছেন মেয়েরা।’ প্রায় একনাগাড়ে কথাগুলো বললেন সীমা। কথা হচ্ছিল তাঁর ভিন্ন ধাঁচের পেশাটি নিয়েই। হঠাৎ কনট্র্যাক্টর হওয়ার ইচ্ছে হল কেন? সীমা জানালেন, ইচ্ছেটা ছোটবেলার। তখনও পেশা, ব্যবসা, রোজগার ইত্যাদি কিছুই বুঝতেন না। তখন থেকেই ইট, বালি, সিমেন্ট নিয়ে খেলা করতে ভালোবাসতেন। সেই নেশা থেকেই আর্কিটেকচার নিয়ে পড়াশোনা করেন। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে এসে দেখেন বাড়ির লে-আউট তৈরি করতে খুব একটা ভালো লাগছে না তাঁর। বরং বাড়ি সাজানোর দিকেই তাঁর মন। তখন থেকেই বাড়ির রং বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত সেই নিয়েই ব্যবসায় নামেন।
চলাফেরায় বদল চাই
সীমার বক্তব্য, ‘ইট বালি ভালোলাগা আর সেই নিয়ে হাতেকলমে কাজ করার মধ্যে অনেক পার্থক্য। এই বিষয়ে পড়াশোনার পর যখন এই বিষয়ে ব্যবসা করার কথা ভাবলাম, তখনই বুঝেছিলাম ফারাকটা। পুরুষ অধ্যুষিত এই কাজে মহিলাদের কদর অবশ্যই কম। লেবাররা সব সময় মহিলা কনট্র্যাক্টরদের কথা শুনতে বা মানতে চায় না। অনেক সময়ই ঠকানোর প্রবণতা দেখা দেয় তাদের মধ্যে। কাজ পাওয়াও যে খুব সহজ, তাও নয়। এইসব দেখেশুনে নিজস্ব ব্যবসার কথাই মনস্থ করলাম। তবে তার জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। আর তখনই বুঝেছিলাম এই ব্যবসায় টিকে থাকতে হলে চরিত্রগত কয়েকটা বদল আনতে হবে।’ কেমন সেই বদল? সীমা বলেন, লেবারদের নিয়ে কাজ, ফলে বদলটা চোখেমুখে ধরা পড়া দরকার। অর্থাৎ বডি ল্যাঙ্গুয়েজে কিছু বদল দরকার। প্রথমত, কর্তৃত্ব প্রমাণ করতে হবে সর্বক্ষণ। চলাফেরা থেকে কথাবার্তা সবেতেই একটা লিডার লিডার ভাব চাই। আমি এটা বলছি, অতএব তোমাদের মেনে চলতে হবে— এই ভাবটা না থাকলে লেবার খাটানো অসম্ভব। দ্বিতীয়ত, বদলটা সাজপোশাকের। সুললিত সাজ ছেড়ে একটু হ্যাট বুট কোটের সাজ দরকার। অর্থাৎ পশ্চিমী পোশাক এক্ষেত্রে উপযুক্ত। ট্রাউজার টপ, প্যান্ট স্যুট, স্ল্যাক্স জাতীয় পোশাক পরলে কাজ করতেও সুবিধে হয়। তৃতীয়ত, নিজের কাজে দক্ষ হওয়া ভীষণ জরুরি। মনে রাখতে হবে লোকে কাজের খুঁত খুঁজতে ব্যস্ত থাকবে। লেবাররা কথায় কথায় অসহযোগিতা করতে পারে। তার জন্য নিজেকে প্রস্তুত থাকতে হবে। কাজটা পুরোপুরি বুঝে তবেই এই কাজে নামা উচিত। এটা অবশ্য যে কোনও কাজের ক্ষেত্রেই জরুরি। কিন্তু কনট্র্যাক্টরির কাজে দক্ষতা একেবারে শতকরা ১০০ ভাগ থাকা চাই। এবং আপনি যে কাজ জানেন, লেবারদের চেয়ে বেশিই জানেন সেটা তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে। আর সেই বোঝানোর ক্ষেত্রেই বডি ল্যাঙ্গুয়েজের দৃঢ়তা কাজে লাগে, বললেন সীমা।
সৃজনশীল কাজে মন
সীমার চেয়ে আবার একেবারেই ভিন্ন মত প্রকাশ করেন কাকলি মিশ্র। একটি রং কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত তিনি। বাড়ি রং করানো, রান্নাঘর তৈরি, আসবাবের লে-আউট ইত্যাদি কনট্র্যাক্ট নিয়ে কাজ করেন কাকলি। হঠাৎ এই ধরনের কাজ করার কথা মনে হল কেন? কাকলি বললেন, ‘কাজটা যে খুব বেশিদিন করছি তা নয়। তবে সৃজনশীল কাজের প্রতি আমার আগ্রহ বরাবরের। কোনও ডিজাইন বা লে-আউট আঁকতে ভালো লাগে। তারপর লকডাউনে হাতে অনেকখানি ফাঁকা সময় পেয়ে নিজের এই আগ্রহ নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি। বাড়ির ইন্টিরিয়রে কেমন রং ভালো লাগবে, কোনও দেওয়ালে যদি একটু ভিন্ন সাজ করাতে হয় তাহলে কেমন সাজ উপযুক্ত — এইসব বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। অনলাইন নানা সাইট ও বই ঘেঁটে বিষয়টা অনেকটাই আয়ত্তে আনলাম। বাকিটা নিজের আগ্রহ ও ধারণাতেই পেরে গেলাম। প্রথম যখন একটি রঙের কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাড়ি রং করার কাজে হাত দিই তখন আমার এই বিষয়ে বেশ পাকাপোক্ত ধারণা তৈরি হয়ে গিয়েছে। ফলে লেবার খাটাতে কোনও সমস্যা হয়নি।’ কীভাবে প্রথম এই কনট্র্যাক্টরির কাজে যুক্ত হন? প্রশ্ন করলে কাকলি বলেন, তিনি বাড়ির অন্দরসজ্জার কাজ দিয়ে শুরু করেন। তখন লকডাউনে কাজের লোকের আকাল। এমন অবস্থায় একটি প্লাইউড সংস্থার তরফে বাড়ির কিচেন সাজানোর সুযোগ পান কাকলি। কিচেনের মাপ অনুযায়ী তিন রকম স্কেচ এঁকে ক্লায়েন্টকে দেখালেন। সঙ্গে সঙ্গে প্লাই কোম্পানিতেও কথা বললেন। ক্লায়েন্টের পছন্দ অনুযায়ী মালপত্র আনানো হল, তারপর লেবার নিয়ে কাজ শুরু করলেন। কাকলি বললেন, ‘আমার সৌভাগ্য যে লেবাররা অসম্ভব সহযোগিতা করেছিল। এক চান্সেই কাজটা উতরে গেল।’
বাড়ির রঙের কাজ নিয়েও একইরকম অভিজ্ঞতা, জানালেন কাকলি। তাঁর কথায়, ‘কনট্র্যাক্টরির কাজে আমার ভাগ্যও কাজ করে। যে কাজেই হাত লাগাই সেটাই দারুণ ভালোভাবে সম্পন্ন করতে পারি। আমি নিজে থেকে কাজ করি বটে, কিন্তু বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত থাকি। সেই মারফতই বিভিন্ন কনট্র্যাক্ট পাই। এবং এক একটা কনট্র্যাক্ট অনুযায়ী লেবারও ভিন্ন হয়। এক্ষেত্রে সৌভাগ্যই বলতে হবে, কারণ অনেক মহিলা কনট্র্যাক্টরের কাছেই শুনেছি লেবার খাটাতে তাঁদের দম বেরিয়ে যায়। আমার সেটা কখনও হয়নি। লেবারদের ধমকও দিয়েছি, কাজ ঠিক সময়ে শেষ করানোর জন্য তাড়া লাগিয়েছি, তাই নিয়েও কেউ ঝামেলা করেনি।’
ধারণা তৈরি
বাড়ির মডিউলার কিচেন সাজানোর জন্য কি পেশাদারি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন কাকলি? বললেন, সে অর্থে পেশাদারি প্রশিক্ষণ নয়, তবে অনলাইন কিছু সাহায্য নিয়েছেন। তাঁর মতে দেখার চোখ আর ভাবনা, এই দুটোই মডিউলার কিচেনের লে-আউটের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কোন মাপের রান্না ঘরে কেমন ক্যাবিনেট মানানসই হবে, সেটা নিজের ভাবনার মাধ্যমেই স্থির করতে হয়। আর বাকি কেমন রঙের সানমাইকা লাগানো হবে, কাচ ও কাঠের মিলমিশ কতটা হলে ভালো লাগবে ইত্যাদি অভিজ্ঞতা থেকেই বোঝা যায়। ইন্টিরিয়রের বইপত্র ঘাঁটলেও ধারণা স্পষ্ট হয়। বাকিটা হাতেকলমে শিখতে হয়।
বাড়ির রঙের প্যাটার্নের ক্ষেত্রেও কাকলি অনেক পড়াশোনা করেছেন। কাজ করতে গিয়ে বুঝেছেন ঘর যদি একটু বড় না হয়, তাহলে দেওয়ালে চড়া রং না করাই ভালো। তাতে ঘর আরও চাপা লাগে। সেই মতো রং নির্বাচনের ক্ষেত্রে ক্লায়েন্টকে পরামর্শ দেন তিনি। এছাড়া ঘরের রঙের ক্ষেত্রে আরও একটা বড় ফ্যাক্টর কয়েছে বললেন কাকলি, তা হল জানলার আয়তন ও পজিশন। ঘরে যদি দু’দিকে জানলা থাকে তাহলে দেওয়ালের রঙে একটু ছাড় দেওয়া যায়। অথবা একটাই জানলা যদি দেওয়াল জোড়া হয় তাহলেও তার উল্টোদিকের দেওয়ালে চড়া রং বা টেক্সচার মানিয়ে যায়। এই ধারণাগুলো কাজের ক্ষেত্রে খুবই প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায় জানালেন তিনি। ভাবনামাফিক রং করার পর যখন বাড়িটা ঝলমল করে ওঠে তখন নিজের মনেও একটা সন্তুষ্টি আসে আর লেবারদের মধ্যে একটা শ্রদ্ধা কাজ করে বলে মনে করেন কাকলি।
হাত মিলিয়ে কাজ
কনস্ট্রাকশনের ব্যবসা অর্চনা আগরওয়ালের পারিবারিক। ছোট থেকেই তাই চুন, বালি, সিমেন্টের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল তাঁর। পরবর্তীকালে এই ব্যবসারই ভিন্ন ধরন নিয়ে কাজ শুরু করেন অর্চনা। মহিলা কনট্র্যাক্টরদের অন্যতম হিসেবে শহরে এখন পরিচিত তিনি। বললেন, ‘আমি নিজের টিমের সঙ্গে হাত লাগিয়ে কাজ করি। কোনও বাড়ির ইন্টিরিয়র সাজানো থেকে তা রং করা কোনও কিছুতেই পিছিয়ে থাকি না। প্লাই বোর্ড কাটার ক্ষমতা থেকে রোলার ব্রাশ চালিয়ে দেওয়াল রং করা সবই আয়ত্তে এনেছি। আর এটাই আমার ব্যবসার সাফল্যের চাবিকাঠি।’
কাজের মধ্যেই নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পান অর্চনা। খুব কঠিন সময়েও কাজই তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। কাজের মাধ্যমেই স্বামী ও সন্তানের মৃত্যুযন্ত্রণা ভুলেছেন তিনি। লম্বা ছুটি কাটিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন অর্চনারা সপরিবার। পথ দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন তিনি। জ্ঞান ফিরতে শুনলেন স্বামী ও কন্যার মৃত্যু সংবাদ। বেঁচে থাকার স্পৃহাই ছিল না তাঁর। কিন্তু সুস্থ হওয়ার পর নিজেকে ব্যবসার কাজে সঁপে দিয়েছিলেন সম্পূর্ণ। দশ বাই দশ-এর ছোট্ট অফিসঘরটাই বাড়ি হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁর। আর কর্মীরা আত্মীয়। তাঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে আর কাজের ভরসায় জীবনটাকে আবারও একটু একটু করে গুছিয়েছেন অর্চনা।
কাজে মন
এই কাজে সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা অর্চনার বাবা। বললেন, ‘বাবার কাছেই শিখেছি মন দিয়ে কোনও কাজ করলে সাফল্য আসবেই। তাই জীবন যখন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যায়, তখনও কাজ থেকে মন সরাইনি। তাই বোধহয় বেঁচে আছি। যন্ত্রের মতো কাজ করতে পারি। নিজের ভাবনা চিন্তা কাজে লাগিয়ে অন্যের গৃহকোণটুকু সাজিয়ে তোলার মধ্যেই আনন্দ পাই। সেটাই আমার বেঁচে থাকার রসদ।’
সীমা, কাকলি বা অর্চনার মতো শহরে আরও অনেক মহিলা কনট্র্যাক্টর রয়েছেন। নিজেদের যোগ্যতায় প্রতিষ্ঠার লড়াইটা তাঁরা করে চলেছেন অবিরাম। নিজেদের গ্রুপও তৈরি করেছেন। তাতে আলোচনা হয়। একে অপরকে সাহায্যও। নিজেদের ফোরামটা এগিয়ে নিয়ে যেতে কী কী করা দরকার, তা ভাবেন তাঁরা। এইভাবে মহিলারা কাজের পরিধি বাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। একটা ব্যাপারে তাঁরা সকলেই একমত, একে অন্যের বিরুদ্ধে না গিয়ে যদি পরিপূরক হওয়া যায় তাহলেই একমাত্র নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব।