পারিবারিক ধর্মকর্ম পালনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ। সন্তানের কর্মসাফল্যে গর্ব। গবেষণায় অগ্রগতি। ... বিশদ
হুগলি জেলার গাংপুর গ্রামের নাম শুনেছেন? এমন প্রশ্নে অনেকেই হয়তো নেতিবাচক উত্তর দেবেন। কিন্তু যদি বলি রাবড়িগ্রাম চেনেন কি না? তাহলে উত্তরটা না থেকে হ্যাঁ-তে রূপান্তরিত হতে বেশি সময় লাগবে না। হুগলির এই গ্রামটি স্রেফ জীবিকার জন্যই বিখ্যাত হয়ে গিয়েছে। একটা গোটা গ্রাম, যেখানে প্রায় সব ঘরেই রাবড়ি তৈরি ও বিক্রি করা হয়। কলকাতার বিভিন্ন মিষ্টির দোকানে রাবড়ির সাপ্লাই আসে এই রাবড়ি গ্রাম থেকেই। গ্রামের মহিলারা তা বানাতে সিদ্ধহস্ত।
রাবড়ি গ্রামে মোটামুটি একশো ঘর, সকলেই রাবড়ি বানানোর পেশায় যুক্ত। আগে কাঠকয়লার উনুন সাজিয়ে রাবড়ি বানানো হতো। এখন অনেকেই গ্যাসে বানান এই মিষ্টি। অনেকে আবার এখনও পুরনো পদ্ধতিতেই আটকে রয়েছেন। গ্রামের বউ সোমা মালতির দিন শুরু হয় ভোর চারটে বাজতে না বাজতেই। রাবড়ি বানানোর পেশায় যুক্ত হলেন কেন? আসলে বাঙালি আর মিষ্টি শব্দ দুটো যেন এক অপরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। সেটা জেনেই যেন তিনি বললেন, ‘বাড়িতে অতিথি এলে জল মিষ্টিই তো দেওয়া হয়। যে কোনও শুভ কাজে মিষ্টি লাগে। আবার খাওয়াদাওয়ার শেষ পাতেও মিষ্টি খেতে ভালোবাসেন অনেকে। সে কারণেই এই পেশায় যুক্ত হলাম।’
জন্মলগ্নে সেই যে কানে মধু ঢেলে দেওয়ার রীতি, তারপর থেকেই মিষ্টত্ব বাঙালির রন্ধ্রে রন্ধ্রে। খাদ্যাভ্যাসেও সেই রেশ থেকেই গিয়েছে। ফলে বঙ্গদেশে মিষ্টির নামে গ্রামের নাম নেহাত আশ্চর্যের নয়। বাড়ির হেঁশেলে বাঙালি গিন্নিদের অগাধ অধিকার। পঞ্চব্যঞ্জন বানানোয় তাঁরাই মাস্টার শেফ। কিন্তু ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেও কি চিত্রটা একইরকম? সোমা বললেন, ‘রাবড়ি গ্রামে আমরা যারা রাবড়ি বানাই এবং বিক্রি করি তারা ব্যবসাটাকে দুটো ভাগে ভাগ করেছি। বাড়ির মেয়ে বউরা মূল রান্নার কাজটা সামলাই। আর পুরুষদের কাজ হল সাপ্লাই আনা থেকে দোকানে দোকানে মাল ডেলিভারি দেওয়া। সাধারণত এটাই ব্যবসার ধরন। তবে এর মধ্যেও কখনও অদলবদল ঘটে। একটা কথা ঠিক যে রাবড়ি গ্রামের সব পরিবারের সকলেই কম বেশি হেঁশেলঘরের এক্সপার্ট। অতএব রাবড়ি বানাতে সকলেই পটু। অনেক সময় এমনও হয় বাড়ির আর পাঁচটা কাজ সামলাতে গিয়ে গিন্নিরা হয়তো রাবড়ি রান্নায় হাত লাগাতে পারলেন না। তখনকার মতো ঠেকনা দেওয়ার কাজটা বাড়ির পুরুষরাই করেন।’ ভোর চারটে থেকে উঠে কী করেন সোমা? প্রশ্ন করলে খানিক অবাক হয়েই বললেন, ‘ওমা কাজের কী আর শেষ আছে! চারটে থেকে ঘরের সাধারণ রান্নার পাট সেরে ফেলি। তারপর সকাল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ শুরু হয় রাবড়ি তৈরি।’
রাবড়ি গ্রামের বাড়িগুলোর ধাঁচ প্রায় সব একইরকম। একটা বড় ঘরে রাবড়ি রান্নার আয়োজন। ঘরের মেঝেতে বিরাট উনুন বসানো। সেই উনুন কাটার কাজটাও বাড়ির মেয়েরাই করেন। তারপর তা দৈনন্দিন দেখভালও তাদেরই দায়িত্ব। উনুনটা রোজ কাঠকয়লা দিয়ে সাজানোই একটা পর্ব, বললেন রাবড়ি গ্রামের আর এক কন্যা মীরা। অনেকেই রাতে শুতে যাওয়ার আগেই উনুন সাজিয়ে রেখে দেন। এখন আবার গ্যাসেও রাবড়ি তৈরি হচ্ছে এই গ্রামে। মীরার কথায়, ‘অনেক সময় এই বিশাল কড়াই উনুনে চড়ানোর সময় বাড়ির পুরুষদের সাহায্য লাগে। কড়াই এমনিতেই বেশ ভারী। তারপর যখন রাবড়ি বানানো হয়ে যায় তখন তা নামাতেও পুরুষরা সাহায্য করে। কিন্তু বাকি খুন্তি নাড়া থেকে হাওয়া দেওয়ার কাজ সবই মেয়েদের। সারাদিন উনুনের সামনে কোমর বেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে খুন্তি নাড়া আর উনুনের গোড়ায় হাওয়া দেওয়াও কিন্তু মুখের কথা নয়। কোমর ধরে আসে। অথচ সরে আসার উপায় নেই। অনেক ঘরেই মহিলারা এখন উনুনের সামনে উঁচু বেদি বানিয়ে নিয়েছেন কাজের সুবিধের জন্য। কিন্তু তাতে একটু সমস্যাও হয়। কড়াই থেকে খুন্তি বা হাওয়া করার জন্য হাতপাখা সব কিছু নিজের আয়ত্তে থাকে না।’
সোমা বললেন রাবড়ির স্বাদ নাকি গোরুর দুধেই সবচেয়ে ভালো হয়। কিন্তু সবসময় গোরুর দুধের রাবড়ি বানানো সম্ভব হয় না। তাঁরা মোষের দুধ দিয়েও তাই রাবড়ি বানান। দুধ যত ঘন হতে থাকে ততই তার সরের স্তরও বাড়তে থাকে। ঠিক কতটা সর পড়লে তা খুন্তি দিয়ে তোলা হবে, কখন তুলতে শুরু করলে সর ভেঙে যাবে না, কতক্ষণ নাগাড়ে হাওয়া দিতে হবে, খুন্তি নাড়ার সময়ই বা কখন থেকে শুরু হবে— এগুলো সবই নিখুঁত হিসেবে করতে হয়। অঙ্কের মতো সময় নির্ধারণ করে এই কাজগুলো করতে হয়। করতে করতে অনেকটাই অভ্যাস হয়ে যায়। তবে তারও মধ্যে হাতের গুণও থাকে, জানালেন মীরা।
সোমারা রাবড়ি গ্রামের পুরনো বাসিন্দা। মোটামুটি ষাট বছর ধরে তাঁরা রাবড়ির ব্যবসায় যুক্ত। বললেন, ‘একটা মাপ তৈরি হয়ে গিয়েছে মনে মনে। প্রতি সাত কেজি দুধ জ্বাল দিলে দু’কেজি রাবড়ি তৈরি হয়। তাতে চিনির পরিমাণ কিন্তু খুবই কম। চিনিটা শুধু স্বাদ বাড়ানোর জন্য দেওয়া হয়। না হলে রাবড়ি নামানোর পর একটা টকসা ভাব আসতে পারে’, বললেন সোমা। মোটামুটি কত কেজি রাবড়ি বানান তিনি দিনে? সোমা জানালেন, তাঁদের গ্রাম থেকে ঘর প্রতি দিনে মোটামুটি পঁচিশ কেজি রাবড়ি বানানো হয়। তারপর তা বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করা হয়। কলকাতার দোকানেই রাবড়ির বিক্রি বেশি। তবে রাজ্যের অন্যান্য জেলাতেও একেবারে যায় না, তা নয়। কলকাতায় নাকি কিছু দোকান আছে যেখানে রাবড়ি যেমন কেনা হয় তেমনই বিক্রি করা হয়, কেউ আবার তার সঙ্গে নানা উপাদানও মেশায়। যেমন পেস্তা, বাদাম ইত্যাদি। এই ধরনের গার্নিশের কথা আলাদা, কিন্তু ফ্লেভার যা মেশানো হয় তা সবই রাবড়ি বানানোর সময়ই দিতে হয়।
রাবড়ির ফ্লেভার বিষয়ে বিস্তারে জানালেন মীরা। শীত ও গ্রীষ্মকালে রাবড়িতে ফ্লেভার মেশানো হয়। তবে এই রেওয়াজ খুব বেশি দিনের নয়। মেরেকেটে বছর পনেরো হবে। শীতে খেজুর গুড় মিশিয়ে রাবড়ি বানানো হয়। তবে ফ্লেভার কিন্তু একেবারে শেষে মেশাতে হয়। রাবড়ি পুরোপুরি তৈরি হয়ে গেলে তখন গুড় মেশানো হয়। তারপর আঁচে একটুক্ষণ বসিয়ে রাখা হয় যাতে সবটা একসঙ্গে মেশে। গরমকালে আবার আমের রস মেশানো হয়। নিয়ম ওই একই। কিন্তু আমের ক্ষেত্রে বিশেষ সচেতনতা দরকার। খুব মিষ্টি আম না হলে তা রাবড়িতে মেশানো যায় না। তবে এই যে গুড় বা আম যাই মেশানো হোক না কেন, তা অল্প করে নিয়ে প্রথমে একটু রাবড়ির দুধে মেশানো হয়। খানিকক্ষণ রেখে দিলেই বোঝা যায় দুধ ঠিক আছে কি না। ঠিক থাকলে বাকি গুড় বা আমের রস রাবড়ির সঙ্গে মিশিয়ে তাতে ফ্লেভার আনা হয়।
সাদা রাবড়ির তুলনায় কি ফ্লেভার দেওয়ার রাবড়ির কদর বেশি? মীরা ও সোমা দু’জনেই বললেন সাদা রাবড়ির কদরই বেশি। যাঁরা রাবড়ি খেতে ভালোবাসেন, তাঁরা সবসময়ই সাধারণ রাবড়ির খোঁজ করেন। রাবড়ি গ্রামের পরিচিতি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই এটি একটা পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। আশপাশের তো বটেই, এমনকী কলকাতার লোকেরা আসেন এই গ্রামে রাবড়ি বানানো দেখতে, চাখতে ও কিনতে। তখনই সোমারা দেখেছেন সাদা রাবড়ি যত লোক কেনেন, ফ্লেভার দেওয়া রাবড়ি তার অর্ধেকও কেনেন না। ফ্লেভারের মধ্যেও আবার পছন্দের তারতম্য আছে। নতুন গুড়ের রাবড়ি যতটা জনপ্রিয় আমের রাবড়ি ততটা নয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সোমার ননদটিও বৌদির সঙ্গে সমানে রাবড়ি তৈরি কাজ করেন। তাঁর কথায়, শীতে রাবড়ির চাহিদা অনেক বেশি থাকে। ওই সময় দুধের কোয়ালিটিও ভালো হয়। ঘন দুধ থেকে রাবড়ি বানালে তার স্বাদই অন্যরকম হয়ে যায়। এই প্রসঙ্গে একটা মজার গল্প বললেন তিনি, ‘তখনও আমাদের গ্রাম খুব একটা বিখ্যাত হয়ে ওঠেনি। বড়দিনের সময় সে বছর জাঁকিয়ে শীত পড়েছিল। আমরাও একটা মেলার আয়োজন করেছিলাম। রাবড়িই সেখানে মূল আকর্ষণ, তাছাড়া অন্যান্য খাবারও ছিল। লোকে তো রাবড়ি তৈরি আর বিক্রি একইসঙ্গে দেখার সুযোগ পেয়ে ভিড় জমিয়ে ফেলল মেলায়। এত বিক্রি হল যে শেষকালে আর সাপ্লাই দেওয়া যাচ্ছিল না। সময়ের আগেই রাবড়ির স্টলের ঝাঁপ ফেলতে বাধ্য হয়েছিলাম আমরা।’
জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে দায়িত্ব বেড়ে গিয়েছে বহুগুণ, জানালেন সোমা। দুধের মান যেন সর্বশ্রেষ্ঠ হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হয় সবসময়। এখন আবার রাবড়ি বানানোর সময়ও সতর্ক থাকেন তাঁরা। সরটা ঠিক কখন কড়াইয়ের গা থেকে খুন্তি দিয়ে ছাড়াবেন সে দিকে বিশেষ নজর দিতে হয়। ‘সময়ের গোলমাল হলে সর ভেঙে যায়। তখন রাবড়ির সেই স্বাদ আনা যায় না,’ বললেন তিনি।
তবে সোমা, মীরাদের একটা বড় চিন্তা কাজ করে মনে মনে। বললেন, ‘রাবড়ি তৈরি আমাদের গ্রামের সংস্কৃতি। একটা ঐতিহ্য। এই শিল্প আমরা বাঁচিয়ে রাখতে চাই। কিন্তু ভয় হয়, আমাদের সঙ্গেই বোধহয় শিল্পটাও বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আগামী প্রজন্ম আর রাবড়ি বানানোর কাজে মন দিতে চায় না। এত পরিশ্রমের কাজ তারা করতে নারাজ। তাদের বক্তব্য যতটা খাটনি, তত আয় হয় না। ফলে অন্য কাজের সন্ধান করতে আগ্রহী তারা। কিন্তু একটা শিল্প বিলুপ্ত হয়ে যাবে এটা ভাবলেও মন খারাপ হয়ে যায়।’
ভোজনবিলাসী তো বটেই ভ্রামণিকদের মনেও নেশা ধরানো এই গ্রামের মেয়েরা আজও ঘরের চার দেওয়ালের অন্তরালেই দিন কাটাচ্ছেন। গ্রামের পরিচিতি বাড়ছে তবু তাঁদের জীবনে শহুরে ছাপ পড়ছে কই! তাঁরা অবশ্য এতেই
খুশি। রাবড়ির কারিগররা হেসে বললেন, ‘মিষ্টি আমাদের ঐতিহ্য। আর তার মধ্যে আবার রাবড়ি তৈরি একটা শিল্প। আমরা তেমন ভাবেই ভাবতে ভালোবাসি। এই শিল্পের কদর যে বাড়ছে তাতেই আমরা খুশি।’