পারিবারিক ধর্মকর্ম পালনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ। সন্তানের কর্মসাফল্যে গর্ব। গবেষণায় অগ্রগতি। ... বিশদ
চাঁদনী অরোরা আর সীমা মারথি একটা রেস্তরাঁ চালান রাজস্থানের যোধপুরে। রেস্তরাঁটির বিশেষত্ব, তা পুরোপুরি মহিলাচালিত। রাঁধুনি থেকে ওয়েটার, এমনকী ঠিকে কাজের লোক সকলেই মহিলা। রাজস্থানে এই দক্ষিণ ভারতীয় রেস্তরাঁটি ইতিমধ্যেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তার একটা কারণ যেমন খাবারের বৈচিত্র্য অন্য কারণটি অবশ্যই মহিলাদের পরিচালনা, বললেন সীমা। তাঁর কথায়, বাড়ির হেঁশেল যখন মেয়েরাই সামলায় তখন রেস্তরাঁতেই বা সেই ধারা বজায় রাখা যাবে না কেন? এই ভাবনা থেকেই প্রথম সীমা ও চাঁদনী মহিলা পরিচালিত রেস্তরাঁ শুরু করার কথা ভেবেছিলেন। তখন অবশ্য পুরোটাই মহিলাদের দিয়ে চালাবেন কি না, তা নিয়ে সামান্য সংশয় ছিল। চাঁদনী বললেন, রেস্তরাঁর রান্না মানেই বড় হাঁড়ি, কড়াই, তাওয়া, চাটু ইত্যাদি। অনেকের রান্না, পর পর অর্ডার সামলানো —সবমিলিয়ে বেশ ভারী কাজ। এত কাজ মেয়েরা একা সামলাতে পারবে কি না সেই নিয়ে একটু চিন্তা ছিল মনে।
কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁরা ভাবলেন, একাধিক মহিলাকে যদি কাজে লাগানো যায় তাহলে ভাগেযোগে ভারী কাজ সবই তারা সামলাতে পারবে। সেইমতোই রেস্তরাঁর পরিকল্পনা করা হয়।
এই রেস্তরাঁয় বাড়ির গৃহিণী থেকে রান্নার লোক, সবাইকে কাজে লাগিয়েছেন সীমা ও চাঁদনী। তাঁদের কথায়, ‘মহিলারা সবক্ষেত্রেই নেপথ্যে থাকেন। আড়ালে কাজ করেন। তাই প্রশংসার বেলায় ভাঁড়ার শূন্য। এই গতানুগতিকতা থেকে মেয়েদের বের করে এনে তাদের কাজটা সর্বসমক্ষে তুলে ধরাই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য। সেই কারণেই মহিলা পরিচালিত রেস্তরাঁ চালু করার কথা প্রথম ভাবনায় আসে।’ এর ফলে মহিলাদের রোজগারের একটা পাকা পথও তৈরি করতে পেরেছেন তাঁরা। এখানে কর্মরত মহিলারা কাজ করে ভীষণ খুশি। তাঁদের কথায়, ‘রান্না আমাদের সহজাত অভ্যাস। কিন্তু তার মাধ্যমে যখন লোকের মুখে তৃপ্তির হাসি ফোটাতে পারি তখন সত্যিই ভালো লাগে।’
সীমা ও চাঁদনী বলেন, মহিলারা অভ্যর্থনাতেও বেশ পারদর্শী। তাদের কাজে আন্তরিকতার ছোঁয়া থাকে। তাই সব মিলিয়ে রেস্তরাঁর কাজটা সকলে ভালোই সামলাতে পারছে। ঘরোয়া কাজে পটু মহিলাদের দিয়ে রেস্তরাঁ চালানোর কাজে লাগানোর জন্য কোনও পেশাদারি প্রশিক্ষণ কি প্রয়োজন হয়? এর উত্তরে সীমার জবাব, রাঁধুনিদের অবশ্যই শেফ স্পেশাল ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। আর বাকি কাজ হাতেকলমে করতে করতেই তাঁরা শিখে ফেলেছেন।
বয়স্ক মহিলাদের স্বনির্ভরতার খোঁজ
১৫ জুন ছিল ‘ওয়ার্ল্ড এল্ডারলি অ্যাবিউজ অ্যাওয়্যারনেস ডে’। এই দিনটিকে মনে রেখে একটি কর্মশালার আয়োজন করে হেল্পএজ ইন্ডিয়া। কর্মশালার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন বয়স্ক মহিলারা। হেল্পএজ ইন্ডিয়ার প্রতিনিধিকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন বয়স্ক মহিলারা অধিকাংশই স্বনির্ভর নন। একটা বয়সের পর তাই সন্তানের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন তাঁরা। সেই ক্ষেত্রে তাঁদের অনেকেই হেনস্থার শিকার হন। পরিসংখ্যান বলে, আমাদের রাজ্যে বিধবা মহিলার সংখ্যা ৪২ শতাংশ। এঁদের মধ্যে মাত্র ১৪ শতাংশ স্বনির্ভর। বাকিরা সকলেই সন্তানের উপর নির্ভরশীল। এই পরনির্ভর মহিলারা সুরক্ষার অভাব বোধ করেন। এঁদের মধ্যে অনেকেই নির্যাতনের শিকারও হন। কিন্তু মনে মনে একটা ভয় কাজ করে বলে তাঁরা নির্যাতনের প্রতিবাদ করেন না। তাছাড়া গ্রাম্য অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত মহিলাদের মানসিক জোরও কম। প্রতিবাদ করার কথা তাঁদের অনেকের মাথাতেও আসে না। তাছাড়া প্রতিবাদ করার সঠিক জায়গাও তাঁদের জানা নেই। সব মিলিয়ে লাভের লাভ কিছুই হয় না। এই ধরনের সমস্যাগুলো খতিয়ে দেখার জন্যই কর্মশালার আয়োজন করে হেল্পএজ ইন্ডিয়া। তাদের কথায়, ‘আমাদের সমাজে মহিলাদের কিছু বাঁধাধরা ভূমিকা আছে। তাঁরা ঘরকন্নার কাজ করেন। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাঁদের দেওয়া হয় না। তাঁদের প্রতি যদি অত্যাচার বা অনাচারও হয় তবু সেটা মুখ বুজে সহ্য করাই তাঁদের ভবিতব্য। এই ধারণাগুলো ভাঙার সময় এসেছে। কিন্তু তা করতে গেলে সামাজিক বাধার সম্মুখীন হতে হয়।’ মহিলাদের এই পরনির্ভরতার অন্ধকার থেকে বের করে আনতে সচেষ্ট হেল্পএজ ইন্ডিয়া। সেই বিষয়ে কর্মশালার আয়োজন তো বটেই এমনকী ইচ্ছুক মহিলাদের স্বনির্ভর করার প্রচেষ্টাও তারা চালিয়ে যাচ্ছে অবিরাম। পাশাপাশি বয়স্ক মহিলাদের মনের জোর বাড়িয়ে তোলার জন্য আলোচনাচক্রেরও আয়োজন করছে তারা।
মায়েদের পাঠশালা
রাত আটটার লোকাল ট্রেন চলে যায় পাঠশালার গা ঘেঁষে। একপাশে চট বিছিয়ে পড়াশোনা করে রেললাইনের ধারের বস্তির ছেলেমেয়েরা। রুটিন মেনে রোজ তাদের পড়াতে আসেন কিছু মানুষ। অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ক অফিসার, রেলকর্মী থেকে সরকারি দপ্তরে কর্মরত সবাই, পড়াতে আসেন। কিছু ছাত্র-ছাত্রীও আছে এই দলে। সেই লকডাউন শিথিল হওয়ার পরেও যখন স্কুল চলেছে অনলাইনে তখন থেকেই ওঁরা খুলেছে পাঠশালা— সংবেদ পাঠশালা। স্কুলছুট ছেলেমেয়েদের নিয়ে পড়ার আসর। আর সেখানেই বসছে মায়েদের পাঠশালা। শ’খানেক ঘর আছে টালির চাল ঘেঁষাঘেঁষি। সারাদিন এর ওর বাড়ি কাজ করার পর সময় করে ঠিক চলে আসে তারা মায়েদের পাঠশালায়। ব্যাঙ্কের পাশ বই আপডেট করানো থেকে সই করা এসব শেখান ব্যাঙ্কের অফিসার বা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকুরেরা। পাশাপাশি কিছু প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। ব্যাগ তৈরি, আচার তৈরি ইত্যাদির ট্রেনিং। অর্পিতা মেটে, রেশমা খাতুন, সীমা মণ্ডল, পূর্ণিমা মণ্ডলের দল সব মেতে উঠেছে নতুন জীবনের স্রোতে। ঝগড়াঝাঁটি ভুলে একসঙ্গে কাজ করার আনন্দে। সুন্দর সুন্দর ব্যাগ তৈরি করে নিজেরাই অবাক। সেগুলো দ্রুত বিক্রি হওয়ার পর হেসে গড়িয়ে পড়ে ওরা। ভাবেইনি কলতলার ঠোকাঠুকির বাইরেও একটা জীবন আছে। যে জীবন আত্মপ্রতিষ্ঠার, আত্মসম্মানের। রেশমা খাতুন বাড়ি বাড়ি রান্নার কাজ ছেড়ে ব্যাগ তৈরি করার কাজে মেতেছে। তাঁর কথায়, বাড়িতে থাকলে যখন রোজগার আর ছেলেমেয়েদের দিকে নজরদারি দুই-ই সম্ভব, তখন তা-ই ভালো। সংবেদ চন্দননগর-এর পাঠশালায় মায়েদের আত্মপ্রতিষ্ঠার গতি ক্রমবর্ধমান। চোখে এক ঝাঁক স্বপ্ন নিয়ে রোজ সন্ধ্যায় বসে পাঠশালা। ছেলেমেয়েদের সঙ্গেই লেখাপড়া শিখছেন মায়েরা। তাদের দিশা দেখাচ্ছে কিছু নাছোড় সংবেদী মানুষ। সংবেদী পাঠশালার দেখানো পথে ওরা একদিকে স্বনির্ভর হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। স্বাস্থ্যশিবিরে নিজের ও পরিবারের স্বাস্থ্য সচেতনতার শিক্ষা নিচ্ছে। পাল্টে ফেলছে নিত্যদিনের যাপন-কথা। অপরদিকে নিজেরাই রক্তদান করছে রক্তদান শিবিরে। দূরারোগ্য রোগের পরীক্ষা করাচ্ছে। গান শিখছে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গলায় তুলছে রবীন্দ্রনাথের গান। রাখী মণ্ডল জানালেন, সংবেদ পাঠশালা আমাদের এলাকার সবকিছু পাল্টে দিয়েছে। তাঁরা মেলা করছেন। সব বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। হাতে পয়সা আসছে। সম্মান নিয়ে বাঁচতে শিখছেন। সংবেদ চন্দননগরের কর্মকর্তা বলেন, এই ছোট্ট এলাকায় কাজ করে প্রমাণ করতে চাইছি সদিচ্ছা ও সঠিক পরিকল্পনা থাকলে সার্বিক উত্তরণ সম্ভব।