আমরা গভীর ভাবে নিজেদের দিকে তাকালে আশ্চর্য্যের সঙ্গে দেখব যে, আমাদের নিজেদের প্রতি, যে জগতে আমরা বাস করি সেই জগতের প্রতি এবং যাঁদের সঙ্গে মিশছি তাঁদের প্রতি আমরা একটা তীব্র অসন্তোষের ভাব পোষণ করি। এই অসন্তোষ আমাদের মধ্যে এক প্রকার মানসিক সংঘাত ও চাপ সৃষ্টি করে—এবং তা বর্তমান বিশ্বে ক্রমেই বেড়ে চলেছে। অস্বাভাবিক মানসিক সংঘাত ও চাপ আমাদের মন ও শরীরকে অসুস্থ করে তোলে। এর কারণ যাই হোক, আমাদের এই বাহ্যিক জীবন যাপন প্রণালী উদ্ভূত অসন্তোষের ফলেই এই মানসিক ও শারীরিক অসুস্থতা ঘটে থাকে। আমাদের জীবন তখন অর্থহীন ও উদ্দেশ্যহীন বলেই মনে হয়। যখন আমরা নিজেদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ি, তখন অন্যদের মধ্যেও শান্তির পরিবর্তে অশান্তি সৃষ্টি করে বসি। শারীরিক রোগের মতো মানসিক রোগও সংক্রামক হতে পারে। আমরা হয়তো সঠিক কর্ম পেতে পারি, কিন্তু ঐ কর্ম সম্পাদনে আমাদের ভুল মানসিকতা এসে পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে ঐ কর্মের প্রতি আমাদের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে। অথবা এমনও হতে পারে যে আমরা যে কর্ম করছি তা আমাদের বিশেষ প্রতিভাকে কাজে লাগাতে পারল না। এর ফলে হতাশার সৃষ্টি হয় এবং এই হতাশা থেকে অদ্ভুত ও অনেকসময় ক্ষতিকর মনোভাব এসে পড়ে। হয়তো আমরা খুব বেশি অন্যের উপর নির্ভর করি। অথবা আমরা ভাবি যে, আমাদের চারপাশেই বুঝি শত্রুতা চলছে এবং ঐ কাল্পনিক শত্রুদের সঙ্গে লড়াই করে আমাদের শক্তি ক্ষয় করি। হয়তো আমরা নিজেদের অন্যান্যদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলি, এবং নিজেদের সম্বন্ধে বিরাট এক ভাবমূর্তি গড়ে তুলে মূর্খের স্বর্গে বাস করি। মানসিক রোগের সব থেকে খারাপ লক্ষণ হলো নিজেদের ঘৃণা করতে আরম্ভ করা। আর তখনই জীবন হয় দ্বিগুণ দুঃখের।
এর প্রতিকার কি? এ বিষয়ে আমরা কি কি করতে পারি? মনোবিজ্ঞানীরা বলেন যে, সার্থক ভাবে বেঁচে থাকার জন্য কোন আদর্শ গ্রহণ করতে পারার পূর্বে আমাদের নিজেদের স্বভাব সম্বন্ধে সম্যক ধারণা করে নিতে হবে। নিজেদের স্বভাব সম্বন্ধে ধারণা পরিবর্তন করতে পারলে আমরা নিজেদেরও পরিবর্তন করতে পারি। এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই আসে আমাদের শক্তি প্রয়োগের সার্থক পথ খুঁজে পাবার পূর্বেই। আমাদের নিজেদের সম্বন্ধে ধারণা কি ভাবে বদলান যায়? মনোবিজ্ঞানী বলেন যে, মনের সমীক্ষণের দ্বারা এই ধারণার পরিবর্তন সম্ভব। অবশ্য এর জন্য আমাদের মনোবিজ্ঞানীর কাছে পরীক্ষা দেবার জন্য সম্মত হতে হবে। বুদ্ধিগম্য প্রশ্নের মাধ্যমে মনোবিজ্ঞানী আমাদের ব্যক্তিত্বের গভীরতা বুঝতে চেষ্টা করতে পারেন। আমাদের অজ্ঞাত মানসিক জটিলতা জানতে পেরে আমাদের বলে দিতে পারেন কার্যতঃ আমাদের ভুল কোথায়।
স্বামী যতীশ্বরানন্দের ‘ধ্যান ও আনন্দময় জীবন’ থেকে