পুরনো রোগের বৃদ্ধিতে স্বাস্থ্যহানির সম্ভাবনা। ব্যবসায় শুভত্ব বজায় থাকবে। আর্থিক প্রগতিও হবে। ... বিশদ
এইভাবেই ছয় বছরে পড়লেন হেলেন। তাঁদের রাঁধুনির মেয়ে বছর দু’য়েকের বড় মার্থা আর কুকুর বেলি ছিল হেলেনের খেলার একমাত্র সঙ্গী। নিজের মতো করে হেলেন কিছু ইশারা তৈরি করে নিয়েছিলেন, যা শুধুমাত্র তাঁর বাড়ির লোকজনই বুঝতে পারত। যেমন— নিজের গালে হাত দিলেই হেলেনের মা বুঝতে পারতেন যে, হেলেন তাঁকেই খুঁজছেন! আবার কাউকে পছন্দ না হলে হেলেন তাঁকে হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিতেন। ঠিক তেমনই কারওর সান্নিধ্য চাইলে তাঁর হাত ধরে নিজের দিকে টেনে নিতেন। এছাড়া কানে না শুনতে পেলেও হাঁটার সময় সকলের পায়ের ভাইব্রেশন থেকেই তিনি ঠিক বুঝতে পারতেন যে, কে আসছে— মা না বাবা, না অন্য কেউ! অন্যরা যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলতেন, তখন হেলেন তাঁদের ঠোঁট ছুঁয়ে বোঝার চেষ্টা করতেন তাঁরা কেমন করে ঠোঁট নাড়ছে। তারপর নিজেও সেগুলো নকল করতে চেষ্টা করতেন ঠোঁট নেড়ে নেড়ে! কিন্তু তা সত্ত্বেও কিছুই যখন বোঝাতে পারতেন না, তখন এক অসহায় ক্রোধে ফেটে পড়তেন তিনি!
একদিন পিসি তাঁকে তোয়ালে দিয়ে একটা পুতুল তৈরি করে দিয়েছিলেন। তাতে নাক-চোখ-মুখ কিছুই ছিল না। হেলেন একবার নিজের মুখে হাত দিয়ে আর একবার পুতুলটার মুখে হাত দিয়ে এই অসঙ্গতিটা কিন্তু ঠিক টের পেয়ে গিয়েছিলেন! তাই এই অসঙ্গতি দূর করার উদ্দেশ্যে তিনি তৎক্ষণাৎ হাতড়াতে শুরু করল এদিক ওদিক। হঠাৎই ওর হাত পড়ল পিসির কোটের বোতামের উপর। যা খুঁজছিল তা পেয়ে যাওয়া মাত্র হেলেন বোতাম দুটো টেনে ছিঁড়ে নিলেন! পিসি চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ আরে! হেলেন যে আমার কোটের বোতাম দুটো ছিঁড়ে নিল!’
তাঁর বাবা-মা চমকে তাকিয়েই বিস্মিত হয়ে গেলেন, যখন দেখলেন হেলেন সেই বোতাম দুটো পুতুলের চোখের জায়গাটাতে বসিয়ে দিয়েছেন আর হাত দিয়ে ইশারা করছেন ও দুটো সেলাই করে দেওয়ার জন্য! সেদিন উপস্থিত সবাই কিন্তু বুঝতে পেরেছিলেন যে, ভয়াবহ ব্রেন-ফিভার বা মেনিনজাইটিস অসুখটা হেলেনের দৃষ্টি আর শ্রবণশক্তি কেড়ে নিলেও তাঁর বুদ্ধিকে কিন্তু কেড়ে নিতে পারেনি!
এরপর টেলিফোনের আবিষ্কর্তা ডঃ আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের কাছে পরামর্শের জন্য বাবা-মা নিয়ে গেলেন মেয়েকে। উনি পরীক্ষা করে বুঝতে পারলেন যে, মেয়েটি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। তাঁরই পরামর্শে হেলেনের মা-বাবা যোগাযোগ করলেন বোস্টনের পার্কিন্স ইনস্টিটিউট ফর দ্য ব্লাইন্ডের সঙ্গে। সেখান থেকে ছয় বছর আট মাসের হেলেনের ‘টিচার’ হয়ে এলেন কুড়ি বছরের মিস অ্যানি সুলিভান।
খাওয়ার সময় টেবিলের চারপাশে ঘুরে ঘুরে প্রত্যেকের প্লেট থেকে হাতে করে খাবার তুলে নিয়ে নিজের মুখে পুরে দেওয়ার একটি বদঅভ্যাস গড়ে উঠেছিল হেলেনের মধ্যে। কেউ বাধা দিলেই তিনি রেগে যেতেন। তখন তাঁকে শান্ত করার জন্য বাড়ির লোককে তৎক্ষণাৎ তাঁর মুখে লজেন্স পুরে দিতে হতো! অ্যানি সুলিভান আসার পর, তিনি হেলেনকে নিজের হেফাজতে নিয়ে তাঁকে শেখানোর চেষ্টা করলেন কীভাবে টেবিলে বসে চামচের সাহায্যে খেতে হয়। সেই সঙ্গে ‘সাইন অ্যালফাবেট’ হেলেনের হাতের পাতায় নিজের আঙুল দিয়ে লিখে ওকে ভাষা সম্পর্কে ধারণা দেওয়ারও চেষ্টা করতে শুরু করলেন। যদিও হেলেন কিছুতেই বুঝতে পারতেন না ওর হাতে মিস সুলিভান কেন আঙুল দিয়ে টোকা দিচ্ছেন! আর তাই বিরক্ত হয়ে একদিন তিনি মিস সুলিভানকেও মায়ের মতোই ঘরের মধ্যে বন্দি করে চাবি লুকিয়ে ফেলেছিলেন! মেয়ের এই দুষ্টুমি টের পেয়ে শেষপর্যন্ত তাঁর বাবাকেই মই বেয়ে উঠে জানলা দিয়ে মিস সুলিভানকে বের করে আনতে হয়েছিল!
অ্যানি সুলিভান বহু চেষ্টা করেও যখন হেলেনকে বোঝাতে ব্যর্থ হলেন যে, প্রত্যেককটা বস্তুরই নাম আছে, তখন একদিন অপারগ হয়ে ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে এলেন বাড়ির ওয়েল হাউসে। শুরু করলেন হ্যান্ড পাম্পের হাতল পাম্প করতে। কলের মুখ দিয়ে জল পড়তে শুরু করা মাত্রই তিনি হেলেনের একটা হাত টেনে ধরলেন সেই পড়ন্ত জলের নীচে। একই সঙ্গে তাঁর অন্য হাতে নিজের আঙুল দিয়ে সাইন অ্যালফাবেটের সাহায্যে লিখলেন ‘ও-য়া-টা-র’। হেলেন এই প্রথম থমকে গেলেন! সুদূর কোন বিস্মৃতির অতল থেকে যেন খুঁজে পেলেন ওঁর জীবনের প্রথম দিকে স্বাভাবিক অবস্থায় শেখা সেই ‘ওয়াটার’ শব্দটি! হেলেন হঠাৎই উপলব্ধি করলেন যে, এটা সেই ‘ওয়াটার’! তিনি জিভ ঠেকালেন সেই জলে! বুঝতে পারলেন যে, এটার নামই তাহলে ওয়াটার! মুহূর্তের মধ্যে হেলেনের চেতনা জেগে উঠল! তিনি বুঝতে পারল যে, পৃথিবীর সব কিছুরই তাহলে নাম আছে!
উত্তেজনায় অ্যানি সুলিভানের দিকে হেলেন তাঁর হাত বাড়িয়ে দিলেন। তাঁর মনে তখন একটাই প্রশ্ন, এই মানুষটি ওঁর কে হয়? হেলেনের হাতে যে মুহূর্তে মিস সুলিভান লিখলেন ‘টিচার’। ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই হেলেন কেলার পেয়ে গেলেন তাঁর জীবনের চিরবন্ধুকে!
অসাধ্যসাধন করেছিলেন মিস সুলিভান! সারা ফুলারের সাহায্যে ১১ বছরের হেলেনকে কথা পর্যন্ত বলাতে সফল হয়েছিলেন! ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়াশোনা করে হেলেন হয়েছিলেন বিশ্বের প্রথম মূক-বধির গ্র্যাজুয়েট! পরে তিনি লিখেছিলেন, ‘দ্য স্টোরি অব মাই লাইফ’, ‘আউট অব দ্য ডার্ক’-এর মতো অনেক বই। পেয়েছিলেন বহু পুরস্কার ও সম্মান। মার্ক টোয়েন তাঁর সম্পর্কে একসময়ে বলেছিলেন ‘দ্য মিরাকল ওয়ার্কার’। বিশ্বের বিস্ময় সেই হেলেন কেলারের জন্ম হয়েছিল ১৮৮০ সালের ২৭ জুন। আবার ১৯৬৮ সালের এই জুন মাসেরই ১ তারিখে হয়েছিল তাঁর জীবনাবসান।