পারিবারিক ধর্মকর্ম পালনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ। সন্তানের কর্মসাফল্যে গর্ব। গবেষণায় অগ্রগতি। ... বিশদ
নন্দিতার টোকায় বেশ জোর, এককালে নাকি ভালোই খেলত ক্যারামটা। তার চোস্ত টোকায় নাকি স্ট্রাইকারটা দিশে না পেয়ে হুড়মুড় করে ঘুঁটিগুলো পাঠিয়ে দিত পকেট বরাবর। তবু রিক্তর চোখের পাতা খোলে না। শুধু তার নাসিকাগর্জনে সামান্য ক্ষান্তি। তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে পুনর্বার শুরু হল নাসিকাগর্জন। নন্দিতা তার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ওল্টায়। তারপর কুঞ্চন তোলে তার নিখুঁত করে ছাঁটা ও আঁকা ভ্রূযুগলে। তার তর্জনী অতঃপর বেঁকে যায় ধনুকের মতো, একটু জোরেই টোকা দেয় রিক্তর নাকে। রিক্তর নাসাগ্র হয়ে উঠল রক্তিমতর। সেই সঙ্গে মুখে, ‘উহ্, সকালে একটু ঘুমোতেও দেবে না নাকি’ বলে নাসিকাগর্জনে আবার একটু ব্রেক দিয়ে এপাশে ফিরে শোওয়া।
নন্দিতা ঝট করে উঠে পড়ে বিছানা থেকে, তারপর রিক্তর ঘুম–সাঁটানো চোখের দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘আজকের দিনেও এত ঘুম ঘুমোলে চলবে?’
পরক্ষণে রিক্তর ঘুমন্ত ঠোঁট ফুঁড়ে বেরিয়ে এল কয়েকটা গা-জ্বালানো শব্দের উচ্চারণ, ‘আমার ঘুম দেখলেই তোমার এত গা-জ্বালা করে কেন?’
নন্দিতার ঠোঁটের কাছে কিছু নাতিশীতোষ্ণ সংলাপ চলে এসেছিল, কিন্তু কোনওক্রমে নিবৃত্ত করে নিজেকে। আজ সকালে উঠেই কলহ করার বাসনা নেই তার। রিক্তর ঠুক-ঠুক কথার পৃষ্ঠে কথা বলতে গিয়ে রোজই কিছু টক-ঝাল-তেতো সংলাপ পরিবেশন করতে হয় নন্দিতাকে। তাতে রিক্ত তাকে মিষ্টি মিষ্টি কণ্ঠে বলেছে, ‘দেখো, তোমার ওই সুন্দর বদনখানি থেকে যে শব্দসম্ভারের উৎসারণ ঘটে, তাতে তোমাকে কলহপরায়ণা উপাধি দেওয়াই যায়।’
নন্দিতা বেশিরভাগ সময়েই রিক্তর এই হুলক্ষেপণকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু রিক্তর তাতে বিন্দুমাত্র উৎসাহ কমে না। অনেকক্ষণ পর নন্দিতা ধৈর্য হারিয়ে কিছু একটা উত্তর দিলেই স্বামীর কাছ থেকে উড়ে আসে নানান কটাক্ষ।
আজও নন্দিতা সিদ্ধান্ত নিয়েছে রিক্তর শত প্ররোচনাতেও মেজাজ হারাবে না কিছুতেই। অতএব দরজা খুলে বাইরের দিকে পা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় সে। ছিটকিনি খুলতে খুলতে খুব শান্ত মেজাজে বলল, ‘আজ আমাদের একটা শুভদিন। চোদ্দোই মে। তিরিশে বৈশাখ। এমন দিনেও তোমার ঝগড়া করতে ইচ্ছে করছে!’
পিছন থেকে রিক্ত অমনি বলে ওঠে ‘ও, তা হলে তো একটা গ্রেট ডে। তা, ইয়ে মানে কততম?’
নন্দিতা থমকায়, ‘সেটাও তোমার মনে নেই?’
রিক্ত বলল, ‘ধুর, কতকাল হয়ে গেল আমাদের বিয়ে হয়েছে। সেই মান্ধাতার ঠাকুরদার আমলে—’
নন্দিতা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল, ‘তা হলে ধরে নাও এবার শতবার্ষিকী।’
—সেন্টিনারি! বাহ্, বেশ বলেছ তো। তাহলে তো আমাদের দু’জনের ফোটোটায় একটা মালাটালা পরাতে হয়।
নন্দিতা ঝপাং করে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বলল, ‘তা হলে দু-একটা মালা কিনে নিয়ে এসো। বাড়িতে তো আর মালা তৈরি হয় না। যাও, বাজার গিয়ে মালা কিনে আনো’
....
নন্দিতার এখন কিছু নৈমিত্তিক সাংসারিক কাজ থাকে। বাইরে বেরিয়ে তরতর করে নেমে এল নীচে। ছুটির দিনগুলোর রুটিন একটু অন্যরকম খাতে বয়। রিক্ত ঘুম থেকে উঠে চোখমুখ ধুয়ে ডাইনিংরুমে নেমে আসতেই নন্দিতা বলল, ‘যাক ঘুমমশাই তা হলে চলে গেলেন!’
ততক্ষণে রিক্ত মুখহাত ধুয়ে ঘরের কোণের চেয়ারটিতে বসে। রোজই কোনও বই বা খবরের কাগজে মুখ লুকোয়, যেন নন্দিতার সঙ্গে চা-টা খেতে হয় তাই খাওয়া। নইলে প্রায় দিনই একটা বাক্যও ব্যয় না করে চায়ের কাপ নিঃশেষ করে। যা বলার নন্দিতাই বলে যায়।
কিছু সাংসারিক কাজের কথা বলতেই হয়। রিক্ত বেশিরভাগ সময়েই হ্যাঁ হুঁ করে চালায়। কোনও দিন তাকে বেশি অন্যমনস্ক দেখলে নন্দিতা চটেমটে বলে, ‘সংসারটা আমার একার নয়। সংসারে বাস করতে গেলে একটু বই থেকে চোখ নামনোরও দরকার আছে। গায়ে হাওয়া লাগিয়ে কদ্দিন চলবে।’
আজও রিক্ত খবরের কাগজে মুখ ঢেকে চায়ের কাপে ঠোঁট ডোবাতেই নন্দিতা বলে ওঠে, ‘একটা দিন খবরের কাগজ কম পড়লে পরীক্ষায় ফেল করবে না।’
খবরের কাগজ থেকে মুখ না নামিয়েই রিক্ত বলল, ‘কী আনতে হবে বাজার থেকে? মাংস?’
—হ্যাঁ।
—আর কিছু?
রিক্তর নির্বিকার উচ্চারণে ছটফটিয়ে ওঠে নন্দিতা, ‘আর দু’ডজন রজনীগন্ধার স্টিক আর একটা বড় দেখে গোড়ের মালা এনো।’
নন্দিতার গলায় অন্যরকম সুর বাজতে দেখে রিক্ত খবরের কাগজ নামাতে বাধ্য হয়।
নন্দিতা পর মুহূর্তে বলল, ‘বিবাহবার্ষিকী তো আর পালন হচ্ছে না। হচ্ছে শতবার্ষিকী উদ্যাপন। দেওয়ালে টাঙানো আমাদের দু’জনের ওই ফোটোটা, ওটা পেড়ে টেবিলে রাখছি। ওর সামনে ধূপ–দীপ জ্বেলে, দুপাশে দু–গুচ্ছ রজনীগন্ধা রেখে, ফোটোর গলায় গোড়ের মালাটা দিয়ে দিও। তাতে তোমার হবে কি না জানি না, তবে অন্তত আমার আত্মার শান্তি হবে।’
রিক্ত আরও ঠান্ডা গলায় বলল, ‘বাড়িতে ভালো ধূপ আছে তো? না সেটাও বাজার থেকে কিনে আনতে হবে?
নন্দিতা ধুপধাপ পায়ে মিলিয়ে গেল রান্নাঘরের দিকে।
বাজার থেকে রিক্ত সত্যিই রজনীগন্ধা আর গোড়ের মালা নিয়ে এসে বলল, ‘ফোটোটা এখনও দেওয়াল থেকে নামাওনি?’
নন্দিতার কান্না পেয়ে গেল। কান্নার দমক থামিয়ে বলল, ‘এতটা যখন কষ্ট করতে পেরেছ, তখন বাকি কাজটা নিজেই করো। ফোটোটা নামিয়ে মুছে সাফসুফ করে ফুল দিয়ে ভালো করে সাজাও।’
এরপর রিক্তর উদ্দেশে কিছুক্ষণ নির্বাক ছবির পোজে লাভাক্ষেপণ করে বলল, ‘গাঁটছড়ায় বাঁধা সম্পর্কটা একটা সুতোয় এসে ঠেকেছে। যে কোনও সময় পট করে কেটে যাবে।’
নন্দিতা ততক্ষণে দুপুরের রান্না নিয়ে বসেছে। এখন টানা ঘণ্টাদুয়েক রান্নাঘরে তার লড়াই। কিন্তু রান্নায় তার একটুও হাত উঠছে না। বিয়ের পর কয়েকটি বিবাহবার্ষিকীর দিনে ছুটি নিয়েছিল রিক্ত। দুপুরে একটা দামি হোটেলে খাবার খেয়ে বিকেলের শোয়ে সিনেমা দেখেছিল। তারপর সন্ধেটা এখানে-ওখানে কাটিয়ে ঘরে ফিরেছিল রাত ন’টা নাগাদ।
তবু তার পরের দুটো বিবাহবার্ষিকী ইভনিং শোয়ে সিনেমা দেখে হোটেলে ডিনার সেরে পালন করেছিল তাদের আকাঙ্ক্ষিত দিনটি। কিন্তু কখন যে একসময় তাদের সম্পর্ক আন-রোমান্টিক হতে শুরু করল তা বুঝতে পারেনি। নন্দিতা নিয়ম করে মনে করিয়ে দেয় তাদের জীবনের এই বিশেষ দিনটির কথা। চেষ্টা করে কী করে আর একটু বৈচিত্র্য আনা যায় একঘেয়ে জীবনে। কিন্তু প্রতি বছর এই দিনটিতে রিক্তর কাজ পড়ে যায় অফিসে। সিনেমা দেখার সময়টাও পায় না।
তবে এ বছরই প্রথম তাদের বিবাহবার্ষিকীর দিনটা ছুটির দিন পড়ে যাওয়ায় নন্দিতা ভেবেছিল তারা দিনটা একটু অন্যরকমভাবে কাটাবে। কিন্তু—
এরকমই একটা ‘কিন্তু’ দিয়েই তাদের আজকের দিনটা শুরু। বরং আরও উস্কে দিতে রিক্ত বলল, ‘কই, ফোটোটা নামিয়ে ধূপ জ্বালাবে বললে যে—’
নন্দিতার চোখ ফেটে জল আসছিল, বলল, ‘সত্যিই তা হলে আজ শোকদিবস পালন করবে।’
রিক্ত ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসি ঝুলিয়ে বলল, ‘সেরকমই ভাবছি। ঠিক করেছি, এ বছর আমরা নতুনভাবে বিবাহবার্ষিকী পালন করব।’
—নতুনভাবে?
—হ্যাঁ, কয়েক মিনিট নীরবতা পালন করব লাঞ্চের সময়।
—মাত্র কয়েক মিনিট!
—হ্যাঁ। এক মিনিট যে কত দীর্ঘ সময় তা বোঝা যায় নীরবতা পালনের সময়। মনে হয় না, সময় যেন কাটছেই না আর কয়েক মিনিট তো অনন্ত সময়। বেশ নতুন রকম না?
কোনও ক্রমে চা খেয়ে রিক্ত বলল, ‘যাই, অনেকদিন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারা হয় না।’ এই বলে বেরিয়ে গেল পাড়ার ক্লাবে।
নন্দিতা গম্ভীর হয়ে রইল। দুপুরে খাওয়ার টেবিলে যেন জমলই না আজ। সাধারণত যে কোনও ছুটির দিনে নন্দিতাই ডাইনিং টেবিলে নানারকম মজা করে মাতিয়ে তোলে খাওয়ার আসর। আজ কোনও উৎসাহই পাচ্ছিল না খেতে বসে।
রান্নাঘরের কাজ সেরে নন্দিতা যখন দুপুরে শুতে এল ঘরে, এসে দেখল, পুপুন খেয়েদেয়ে এসে নিজের মনে খেলা করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। রিক্তকে বেশ আলতো-হাসি মাখানো মুখে আবিষ্কার করল হঠাৎ। কী জানি রিক্তর মতিগতি বদলে গেল নাকি? ভাবল হয়তো কিছু একটা ভালো প্রস্তাব দেবে রিক্ত।
—আজ দুপুরে টিভিতে ‘অপুর সংসার’ দিয়েছে। আমার অনেকদিনের ইচ্ছে ছবিটা আর একবার দেখার। সেই কবে অল্প বয়সে দেখেছিলাম চলো, দেখি। ওদের টিভি থাকে একতলার ড্রয়িংরুমে। রিক্তর প্রস্তাবে নন্দিতা মুখখানা ব্যঙ্গের হাসিতে ভরিয়ে তোলে, ‘আমি চার-পাঁচবার দেখেছি। তোমার যখন দেখার ইচ্ছে তুমি দেখো গে যাও। নিজের সংসার তো রোজই দেখো। দুপুরের মহার্ঘ সময় বউয়ের সঙ্গে গল্প করে নষ্ট করার চেয়ে অপুর সংসার দেখা অনেক বেশি উপভোগ্য।’
রিক্ত নীচে চলে যেতে নন্দিতার সামনে বিকেলটা প্রায় একটা গড়ের মাঠ। একা-একা এতখানি শূন্যতা পেরনো বেশ কঠিন। বিছানায় গড়াগড়ি খেতে-খেতে একটা কবিতার বই নিয়ে ওল্টাতে বসে।
বইটা সদ্য পেয়েছে তার এক বান্ধবীর কাছ থেকে। সব কবিতাই প্রেমের। প্রেমের বলেই কবিতাগুলো পড়তে শুরু করে। সে নিজে ভারী রোমান্টিক স্বভাবের।
সে কথা জানিয়ে নন্দিতা প্রায়ই বলে, ‘তুমি একেবারেই রোমান্টিক নও।’
রিক্ত আবার রোমান্টিক শব্দটাই যেন শোনেনি এমন মুখ করবে শব্দটা শুনলে। বলে, ‘তুমি কি রোমান্টিক? তুমি তো ডমিনেটিং।’
নন্দিতা বলেছিল, ‘যাদের বর ম্যাদামারা হয়, তাদের বউদের এরকম একটু ডোমিনেটিং হতে হয়।’
আজ অপুর সংসার দেখে রিক্ত যখন উপরে এল, বিকেল চারটে। নন্দিতা তখন গোসাঘরে খিল দেওয়ার মতো শুয়ে আছে বিছানায়। ঘরে উঁকি দিয়ে রিক্ত বলল, ‘জানো, রঙ্গনরা পুরী গেছে।’
রঙ্গন হল রিক্তর স্কুলজীবনের বন্ধু। নন্দিতা নিস্পৃহকণ্ঠে বলল, ‘ওহ।’
—এই সময় পুরী! যা গরম ভাবা যায়।
নন্দিতা তেমনই নির্বিকার। অবশ্য, মুখে বলল, ‘কেন ভাবা যাবে না। আমাকে নিয়ে গেলেও যাব।’
—এখন পুরীতে! মে মাসে পুরী জ্বলছে। মরে যাব।
—তাতে অসুবিধে কী আছে। তিলে তিলে মরার চেয়ে একেবারে মরাই তো ভালো। তাই না?
রিক্ত অম্লান বদলে বলল, ‘এই গরমে যেতে হলে কালিম্পংয়ে যেতে হয়।’
নন্দিতা বলল, ‘হ্যাঁ, ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখো।’
—এখন লাখ টাকার কোনও দাম নেই। স্বপ্ন দেখতে হলে কোটি টাকার স্বপ্ন দেখতে হয়।
—তা হলে কোটি টাকার স্বপ্ন দেখো।
নন্দিতা মুখ ঝামটা দেয়।
রিক্ত হেসে বলল, ‘ইচ্ছে করলে কোটি টাকার স্বপ্ন আমরা দু’জনেই দেখতে পারি।’
এই বলে ওয়ারড্রোব খুলে শার্টের পকেট থেকে একটা টিকিট বের করল। ট্রেনের টিকিট। এই বৈশাখ মাসে মুখে আষাঢ়ের মেঘ মেখে শুয়ে থাকা নন্দিতার পাশে টিকিটটা রেখে বলল, ‘দু’মাস আগে এক এজেন্টের কাছে টিকিট কাটতে দিয়েছিলাম, পইপই করে বলেছিলাম আজকের সন্ধের দার্জিলিং মেলের তিনটে টিকিট কাটতে। শেষে বলল, ফোর্টিন্থ মে পেলাম না, ফিফটিনন্থ আছে, নেব? বললাম, অগত্যা তাই নাও। ফাইভ ডেজ ফোর নাইটস।’
টিকিটটা তুলে দেখে তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠল নন্দিতা, টিকিটটা ভালো করে পরখ করে বলল, ‘সত্যি নিউ জলপাইগুড়ির টিকিট কেটেছ!’
রিক্তর মুখে মিটিমিটি হাসি, বলল, ‘টিকিটটা পড়েও মনে হচ্ছে সত্যি নয়। কাল সকালের মধ্যে ব্যাগ-বাক্স গুছিয়ে নেবে। আমি ছ’দিনের ছুটি নিয়েছি। বিবাহের শতবার্ষিকী বলে কথা।’
অঙ্কন : সোমনাথ পাল