পুরনো রোগের বৃদ্ধিতে স্বাস্থ্যহানির সম্ভাবনা। ব্যবসায় শুভত্ব বজায় থাকবে। আর্থিক প্রগতিও হবে। ... বিশদ
স্কুলে গরমের ছুটি। আমাদের বাড়ির রাস্তার দিকের ঘরটার জানলা খুলে রেখে আমরা তিন ভাইবোন ভাতঘুমে। মা পাশের ঘরে রেডিওয় ‘মহিলা মহল’ শুনছে। ঠিক এমন সময়, ফি দুপুরে অবধারিতভাবে তনুজাদির আগমন। এসেই জানলায় টোকা দিয়ে আওয়াজ, ‘বাংলার পাঁচ’! আমের সাঙ্কেতিক শব্দ। এরপর তনুজাদির নেতৃত্বে আমরা তিন ভাইবোন চুপিসাড়ে চলে যেতাম অনাথ মেসোমশায়ের বাগানে আম চুরি করতে। দুষ্টুবুদ্ধির চ্যাম্পিয়ন তনুজাদি ওই হাড়কিপটে অনাথমেসোর নাম দিয়েছিল ‘আমাশয়’, আম আর মেসোমশায়ের সন্ধি!
আমার দিদির সহপাঠী তনুজাদি অবশ্য আসল চ্যাম্পিয়ন ছিল দৌড়ের মাঠে, একশো আর দু’শো মিটারে ডিস্ট্রিক্টে ‘ফাস্টেস্ট ফিমেল!’ কিন্তু পরীক্ষার খাতায় সে গুড়ে বালি। তনুজাদি নিয়ম করে বাংলায় ফেল করত। যদিও জীবনের এই সামান্য ব্যর্থতাটাকে সে ‘সত্যরে লও সহজে’ হিসেবেই গ্রহণ করেছিল। একবার ওদের বাংলা পরীক্ষায় বাক্যরচনা এসেছিল ‘আম’। তনুজাদি লিখেছিল,‘আকবর দেওয়ান-ই-আম চালু করেছিলেন’। দৌড়ের বাইরে এই আমই ছিল তনুজাদির নেশা। ও গপ্প দিত, জন্মকোষ্ঠীতে নাকি ওর নাম লেখা আছে আম্রপালি! ওর এই আমড়াগাছির সুযোগে অনাথমেসোর ছেলে তুহিনদা ‘খুলে আম’ প্রেম নিবেদন করেছিল তনুজাদিকে। এক দুপুরে গাছ থেকে খসে পড়া তাজা আম বাগিয়ে ধরে সে আমতা আমতা করে তনুজাদিকে বলেছিল, ‘খাবে?’ তনুজাদি জবাব দিয়েছিল, ‘আম খেতে পারি, কিন্তু প্রেম করতে পারব না!’ বেচারা তুহিনদার আম আর ছালা, দুই-ই গিয়েছিল বটে, কিন্তু সেটা বাহ্যত। আর ‘চোলি কে পিছে?’ প্রত্যহ অনাথমেসোর বাগান থেকে চুরি করা আম পেট পুরে খেয়ে সারাটা বিকেল তনুজাদি মন দিয়ে আম আঁটির ভেঁপু বানাত। কার জন্য? মুখ ফুটে কিছু বললে না কেন, তনুজাদি? তুমি না স্পোর্টসম্যান! অবশ্য তুহিনদারও আর একবার ‘ট্রাই’ নেওয়া উচিত ছিল! মেয়েদের মন না বুঝলে তুমি আমের মর্ম কী করে বুঝবে, তুহিনদা?
দিদিদের ইস্কুলের যূথিকা দিদিমণি সেবার বাংলা ক্লাসের সবাইকে তনুজাদির সেই ‘আম’ বাক্যরচনার রসাল খবর দিয়েছিলেন। তারপর একটা মিষ্টি হাসি হেসে উনি বলেছিলেন, একমাত্র এই আমের ব্যাপারেই ভারত-পাকিস্তান এক। এই দুই দেশেরই জাতীয় ফল আম, সঙ্গে ফিলিপিন্সও আছে। আর চীন দেশের মাও সে তুং বলতেন, আম হল আমজনতার রূপক। সেজন্যই চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রতীক হল আম। সেদিনের আম দরবারেই তিনি বলেছিলেন, আমের জন্ম ব্রহ্মদেশে। তবে সারা বিশ্বে আম ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তিন ভূপর্যটক, হিউয়েন সাং, ইবন বতুতা আর ভাস্কো দা গামা। আর সেই আমেই আমোদিত হয়েছিলেন মোগল সম্রাটরা। আকবরই ছিলেন আমের পহেলা এক্সপোর্টার। তিনিই রপ্তানি করেছিলেন তোতাপুরি আম!
সবচেয়ে বড় কথা, বটানির ভাষায় আম পাথুরে ফল হলেও, এই ফ্রুটটি নিয়ে পদ্য আছে আমির খসরু আর কালিদাসের! তাজ্জব ব্যাপার, সারা জীবনে এই একটিমাত্র ক্লাসেই ফার্স্ট বেঞ্চে তন্ময় হয়ে বসেছিল ডাকাবুকো তনুজাদি, যাকে আমার মা ডাকত ‘ডানপিটেনি’ বলে!
তবে তনুজাদির ‘আসলি দিদিমণি’ ছিল আমাদের পাড়ার মলিনামাসি। মায়ের ইস্কুলেরই ইতিহাসের টিচার। প্রতিদিন বিকেলে নিজেদের বাড়ির ছাদে পাড়ার ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটা ‘ফ্রি স্কুল’ বসাত মলিনামাসি। পাঠ্যতালিকা বহুমুখী, তবে গরমকালে দুই মাসব্যাপী অবশ্যপাঠ্য ছিল ‘আম’! মলিনাদির কাছেই শুনেছিলাম, যুদ্ধটুদ্ধ ছেড়ে বাকি জীবনটা আমবাগান নিয়েই ছিলেন সম্রাট অশোক। আর জৈনদের ‘জাগ্রত দেবী’ অম্বিকার বহুপূজিত ছবিটা হলো ‘গডেস আন্ডার দি ম্যাঙ্গো ট্রি’! আবার আম খেয়ে বিন্দাস হয়েই সিংহাসনের চূড়োয় ‘গোল্ডেন ম্যাঙ্গো’ লাগিয়েছিলেন আলাউদ্দিন খিলজি। সো, হিস্টোরিক্যালি আম হল সেকুলার ফ্রুট! অ্যান্ড অ্যাবাভ অল, আর এন টেগোর ব্রেকফাস্ট করতেন আমসত্ত্ব, কলা আর দুধ দিয়ে! জীবনে শুধু একদিনই আমি মলিনাদির ওই মজাদার ‘আমেচার’ ক্লাসটায় ডুব মেরেছিলাম।
সেদিন দুপুরে আমি যখন অনাথমেসোর বাগানে ঢিল ছুঁড়ে আম পারছিলাম, ঠিক তখনই মানু এসেছিল। ও ছিল হেব্বি দেখতে, হাসলে গালে টোল পড়ত। এসেই মানু আমাকে বলল, প্রতিদিন ছাদে দাঁড়িয়ে থাকি। তুই সাইকেল চালিয়ে চলে যাস। একবারও তাকাস না কেন?
আমি চুপ, দীর্ঘক্ষণ। চুপ কোথায়? আমি মনে মনে বললাম,‘এ মণিহার আমার নাহি সাজে’! অনেকক্ষণ পরে মানু বলল, কি, কিছু বলবি না, তাই তো? আমি চুপ, বহুক্ষণ। চুপ কোথায়? আমি মনে মনে মান্নার গান গাইলাম,‘গভীর হয় গো যেখানে ভালবাসা, মুখে তো সেখানেই থাকে না কোনও ভাষা’! মানু কিছুই শুনতে পেল না। একবারও পিছন ফিরে না তাকিয়ে ও চলে গেল। যাওয়ার সময় রঘুজেঠুর মুদি দোকান থেকে আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে সবুজ রঙের আমলজেন্স কিনল। তারপর আমবাগানে সন্ধ্যা নামল। সৌমেন মুখোপাধ্যায়ের বইয়ের মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল ‘এক আকাশ তারা’!
এরপরেও গরমের দুপুরে মানু অবশ্য মাঝেমধ্যে আমাদের বাড়িতে আসত। মা তখন উঠোনে শীতলপাটি বিছিয়ে বসেছে। আমার দিদি আর মানু মিলে হাপুস হুপুস করে খেত মায়ের হাতে তৈরি আমের আচার। কাচের বয়ামে হলুদ নদীর মতো আমতেল বয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে অ্যাকোরিয়ামের রঙিন মাছের মতো ভাসছে মায়াবী আমের স্নিগ্ধ অণু পরমাণু। মানু একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকত আমার দিকে। আর আমি?
মনে নেই। শুধু মনে আছে, হাতপাখা নাড়াতে নাড়াতে মা আমাদের তিন ভাইবোনকে বলত, ‘ঢাকার বাড়িতে তগো বাপ খিরসাপাতি আমের গাছ পুঁইতছিল। সে গাছ বড় হওনের আগেই তারা উদ্বাস্তু হইল। আমাগো জন্মভূমি অহন অন্য দ্যাশ। তবে স্বাধীন বাংলায় জাতীয় বৃক্ষ হইল আমগাছ। মরণের আগে এইটা শুইন্যা তগো বাপ খুব খুশি হইছিল’!
মা, আমিও এখন একপ্রকার ‘উদ্বাস্তু’-ই। স্মৃতির চেয়ে বড় সহিস তো আর কিছু নেই। চাবুক মেরে সময়ের ঘোড়া ছুটিয়ে দেয় সে। আমেরিকায় আমি আমের গন্ধ পাই না, বর্ণ পাই না, স্বাদও নিই না। শুধু মাঝেমধ্যে, কোনও গরমের দুপুরে আমার চোখের সামনে উড়তে থাকে ‘আমপাতা জোড়া জোড়া’! কাচের বয়ামে ভাসতে থাকে খণ্ড বিখণ্ড বাংলার মতো আমের টুকরো। আমবাগানের সেই আশ্চর্য ক্লোরোফিল আর মুগ্ধ ফোটন কণার মতো আমার মা-ও চলে গেছে কত দূরে! ‘ভেবেছিনু মনে মনে দূরে দূরে থাকি, চিরজন্ম সঙ্গোপনে পূজিব একাকী’!